পুতিন-ট্রাম্পেই ‘বাজি’ মোদির

  • আগামী নভেম্বরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্প ক্ষমতায় আসতে যাচ্ছেন, এ ধারণা করছে মোদি প্রশাসন।

  • ভারতের কাছে অস্ত্র ও অন্যান্য প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের সবচেয়ে বড় সরবরাহকারী মস্কো।

ভ্লাদিমির পুতিন, নরেন্দ্র মোদি ও ডোনাল্ড ট্রাম্পছবি: রয়টার্স/এএফপি

ভারতের প্রধানমন্ত্রী যখন কোনো বিশ্বনেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন, তাঁকে প্রায়ই আলিঙ্গন করতে দেখা যায়। গত সপ্তাহে রাশিয়া সফরে গিয়ে দেশটির প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গেও তিনি আলিঙ্গন করেন। তবে ওয়াশিংটন ও কিয়েভ এর প্রকাশ্য সমালোচনা করেছে। টানা কয়েক দিন বিবৃতি দিয়ে মোদির রাশিয়া সফরের সমালোচনা করেছেন মার্কিন কর্মকর্তারা। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার বলেন, ভারত ও রাশিয়ার সম্পর্ক নিয়ে ওয়াশিংটনের উদ্বেগ রয়েছে; কিন্তু মোদি প্রশাসন ধারণা করছে, আগামী নভেম্বরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ক্ষমতায় ফিরবেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। পরিস্থিতি তখন পাল্টে যাবে।

পুতিনের সঙ্গে মোদির সাক্ষাতে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি সরাসরিই তাঁর হতাশার কথা জানিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, বিশ্বনেতারা যে শান্তি প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন, পুতিন ও মোদির মধ্যে আলিঙ্গন দেখাটা এ সময় তার জন্য বড় ধাক্কা। এখন প্রশ্ন উঠছে, ভারত কি মোদির সফরের ভূরাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া বুঝতে ভুল করেছে? তৃতীয় মেয়াদে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েই প্রথম পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কে কি কোনো প্রভাব পড়বে? দীর্ঘদিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখার পরও কেন রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক রাখাটা ভারতের জন্য এত গুরুত্বপূর্ণ?

মস্কো সফরে পুতিনকে জড়িয়ে ধরেছেন মোদি। ট্রাম্পকে সমবেদনা জানিয়ে তাঁকে ‘আমার বন্ধু’ বলে মন্তব্য করেছেন।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, এ প্রশ্নগুলোর উত্তর আছে পুরোনো ইতিহাসের মধ্যেই। এর মধ্যে রয়েছে একাধিক জটিল সম্পর্কে নয়াদিল্লির ভারসাম্য রাখার সক্ষমতা, ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় ফিরতে পারেন ও রাশিয়ার ওপর নমনীয় হতে পারেন এর ওপর বাজি ধরার মতো বিষয়গুলো।

বন্ধু ডোনাল্ড ট্রাম্প

যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ায় গত শনিবার নির্বাচনী প্রচারে গেলে ট্রাম্পকে হত্যার চেষ্টা চালানো হয়। এতে ট্রাম্পের কানে গুলি লাগে। এ ঘটনায় নির্বাচনী প্রচারে অংশ নেওয়া এক ব্যক্তি মারা গেছেন এবং দুজন আহত হয়েছেন। এ ঘটনার পর বিশ্বজুড়ে অনেক নেতা তাঁদের প্রতিক্রিয়া জানান। এর মধ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ওই হামলার নিন্দা জানান। এ সময় তিনি ট্রাম্পকে ‘আমার বন্ধু’ হিসেবে উল্লেখ করেন।

ট্রাম্পের সঙ্গে মোদির সম্পর্ক আগে থেকেই উষ্ণ। কয়েক বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের হিউস্টন ও ভারতের আহমেদাবাদে দুই নেতা একত্রে সরকারি অনুষ্ঠানে হাজির হয়েছিলেন। ভারতের একজন সরকারি কর্মকর্তা বলেন, আগামী নভেম্বরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্প ক্ষমতায় আসতে যাচ্ছেন—এ ধারণা করছে মোদি প্রশাসন। যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্যে জরিপে এগিয়ে রয়েছেন ট্রাম্প। এর বাইরে গত শনিবার ট্রাম্পের ওপর গুলির ঘটনায় তাঁর অবস্থান আরও মজবুত হয়েছে। অন্যদিকে নিজ দলের পক্ষ থেকে চাপে রয়েছেন বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।

ভারতীয় ওই কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদে ট্রাম্পের ফেরা পূর্বনির্ধারিত বলে মনে হচ্ছে এবং প্রধানমন্ত্রী মোদি এতে খুশি হবেন। ট্রাম্প জিতলে ভারতের জন্য একদিক দিয়ে সুবিধা হতে পারে; আর তা হচ্ছে মস্কোমুখী হওয়ায় বর্তমানে যে চাপে রয়েছে নয়াদিল্লি, সে চাপ কমে যাবে।

আলবানি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক ক্রিস্টোফার ক্ল্যারি বলেন, দ্বিতীয় মেয়াদের ট্রাম্প প্রশাসন দিল্লি-মস্কোর সম্পর্কের উদ্দেশ্যের বিষয়টি নিশ্চয়ই গুরুত্ব দেবে না।

ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের প্রশাসন রাশিয়ার চেয়ে ওয়াশিংটনের সঙ্গে বেইজিংয়ের প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিষয়টিতে কৌশলগত বেশি গুরুত্ব দিয়েছিল। ভারতের সঙ্গে তাদের এ দৃষ্টিভঙ্গিতে মিল রয়েছে।

দারুণ ভারসাম্য

ভারত ও রাশিয়ার সম্পর্কের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। স্নায়ু যুদ্ধের সময় থেকে দিল্লি ও মস্কোর সম্পর্ক গভীর। ঐতিহাসিকভাবে, ভারতের কাছে অস্ত্র ও অন্যান্য প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের সবচেয়ে বড় সরবরাহকারী মস্কো।

২০২২ সালে ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা শুরুর পর ভারত ব্যাপকভাবে রুশ তেল কিনতে শুরু করে। বর্তমানে ভারতের সবচেয়ে বড় জ্বালানি তেল সরবরাহকারী রাশিয়া। এ তেল কেনাকে কেন্দ্র করে পশ্চিমা বিশ্বে সমালোচনার মুখে পড়েছে ভারত। তাদের অভিযোগ, এতে যুদ্ধকালীন অর্থনীতি টিকিয়ে রাখতে পারছে রাশিয়া। তবে ভারত এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তবে একই সঙ্গে ভারত পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গেও সম্পর্ক শক্তিশালী করার চেষ্টা করছে। তাদের লক্ষ্য—যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখা, যাতে তারা চীনের হুমকি থেকে নিরাপদ থাকতে পারে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক রাখতে মোদির হাতে যথেষ্ট কার্ড রয়েছে। মস্কো সফরে যাওয়ার আগে চীন ও রাশিয়া আয়োজিত সাংহাই কো–অপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও) সম্মেলন এড়িয়েছেন মোদি। এ ছাড়া এ বছর ভারত কোয়াড সম্মেলন আয়োজন করতে যাচ্ছে। চীনের দৃষ্টিতে অস্ট্রেলিয়া, ভারত, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের সমন্বয়ে গড়া এ জোট তাদের জন্য চ্যালেঞ্জের। এ ছাড়া রাশিয়ার কাজানে এ বছর ব্রিকস জোটের সম্মেলনও অনুষ্ঠিত হবে। এ সম্মেলনে মোদি যান বা না যান যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নয়াদিল্লির সম্পর্ক ঠিক রাখার জন্য নয়াদিল্লির প্রচেষ্টার বিষয়টি জানান দেবে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, দুই পক্ষই জানে, তাদের অংশীদারত্ব ঠিক রাখার ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষেত্রে পরস্পরকে খুব বেশি প্রয়োজন।