টানা তৃতীয় মেয়াদে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি
জ্যৈষ্ঠের সন্ধ্যায় রাষ্ট্রপতি ভবন প্রাঙ্গণে দেশ–বিদেশের অতিথি ও অভ্যাগতদের সামনে টানা তৃতীয়বারের জন্য প্রধানমন্ত্রিত্বের শপথ নিলেন নরেন্দ্র মোদি। তাঁরই সঙ্গে শপথ নিলেন মন্ত্রিপরিষদের ৭২ জন সদস্য, যাঁদের মধ্যে পূর্ণ মন্ত্রী হলেন ৩০ জন, ৫ জন স্বাধীন ভারপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী এবং ৩৬ জন প্রতিমন্ত্রী।
মোদির তৃতীয় দফার মন্ত্রিসভাতেও কোনো মুসলমানের স্থান হয়নি। অন্য সংখ্যালঘুদের মধ্যে আছেন ৫ জন। নারী মন্ত্রীর সংখ্যা মাত্র ৭।
তবে শপথ গ্রহণের দিন শুরুতেই তাল কেটেছে শুধু এনসিপির (অজিত পাওয়ার) সিদ্ধান্তে। ওই দলের নেতা প্রফুল্ল প্যাটেলকে প্রতিমন্ত্রী করতে চেয়েছিলেন মোদি। কিন্তু প্রফুল্ল তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাঁর যুক্তি, তিনি আগে কেন্দ্রে পূর্ণমন্ত্রী ছিলেন। তাই প্রতিমন্ত্রিত্ব গ্রহণ করা সম্ভবপর নয়।
প্রধানমন্ত্রীসহ মোট ৭২ জন মন্ত্রীর মধ্যে বিজেপির মন্ত্রী ৬২। টিডিপি ও জেডি–ইউ ২ জন করে মন্ত্রী পেয়েছে। তাঁদের একজন প্রতিমন্ত্রী। এই দুই দল ছাড়া জেডিএস, এইচএএম, এলজেপি, শিবসেনা, আরএলডি, আরপিআই ও আপনা দলের একজন করে মন্ত্রী হয়েছেন। আরপিআইয়ের কেউ যদিও এবার ভোটে জেতেননি। তবু আগেরবারের মন্ত্রী রামদাস আটোয়ালেকে এবারও মন্ত্রী করা হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ গঠনের সময় নজর দেওয়া হয়েছে জাতপাতের ওপর। মোট ২৪ রাজ্যের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে এবারের মন্ত্রিসভায়। সদস্যদের মধ্যে অন্যান্য অনগ্রসর জাতের রয়েছেন ২৭ জন, তফসিল জাতির ৫ ও তফসিল উপজাতির ১০ জন। বাকিরা বর্ণহিন্দু। পশ্চিমবঙ্গ থেকে মন্ত্রী হলেন সুকান্ত মজুমদার। বিদায়ী মন্ত্রিসভার সদস্য শান্তনু ঠাকুর এবারও মন্ত্রী হলেন।
এনডিএ জোটের নেতৃত্ব দিলেও ২০১৪ ও ২০১৯ সালের ভোটে বিজেপি একাই নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা লাভ করেছিল। পরপর দুবার শরিকদের কোনো রকম চাপ ছাড়াই মোদি সরকার চালিয়েছিলেন নিজের বিচার-বিবেচনামতো। এই প্রথম তাঁকে এমন এক সরকারের নেতৃত্ব দিতে হবে, যেখানে বিজেপির সদস্যসংখ্যা ম্যাজিক ফিগারের চেয়ে কম। যেখানে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে শরিকদের মতামতকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে রাজ্য অথবা কেন্দ্রে এই ভূমিকা নরেন্দ্র মোদি কখনো পালন করেননি।
গতকাল রোববার সন্ধ্যায় সেই কঠিন চ্যালেঞ্জের কোনো ছাপ অবশ্য মোদির শরীরী ভাষায় প্রতিফলিত হয়নি। প্রটোকল মেনে সোয়া সাতটার সামান্য আগে পরিচিত দৃপ্ত ভঙ্গিতে তিনি আসেন। পরনে সাদা পাঞ্জাবি-পাজামার ওপর নীল জওহর কোট। সবাইকে নমস্কার জানিয়ে বসেন নির্দিষ্ট আসনে। পাশের আসনে মন্ত্রিসভার দ্বিতীয় ব্যক্তি রাজনাথ সিং। এক মিনিটের মধ্যেই রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে বিউগল ধ্বনির মধ্য দিয়ে বেরিয়ে আসেন রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু। জাতীয় সংগীতের সঙ্গে গলা মেলান উপস্থিত সবাই।
রাষ্ট্রপতি ভবনের বিশাল গম্বুজ সাজানো হয়েছিল জাতীয় পতাকার রঙে। উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ সাজানো হয়েছিল নানা রঙের ফুল দিয়ে। সেই সঙ্গে আলোর বাহার। মঞ্চের ঠিক সামনে সারি দিয়ে বসেন বিদেশি অভ্যাগতরা। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশেই বসেন মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহমেদ মুইজ্জু। তাঁদের পাশে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমসিংহে, সেশেলসের ভাইস প্রেসিডেন্ট আহমেদ আফিফ, ভুটানের প্রধানমন্ত্রী শেরিং তোবগে, নেপালের প্রধানমন্ত্রী পুষ্প কুমল দহল, মরিশাসের প্রধানমন্ত্রী প্রবীন্দ কুমার জগন্নাথসহ অন্যরা। তাঁদের ঘিরে দেশের বিভিন্ন পেশার উল্লেখযোগ্য পরিচিত মুখ। সিনেমাজগৎও বাদ যায়নি। হিমাচল প্রদেশের মান্ডি থেকে নির্বাচিত কঙ্গনা রনৌত ছাড়াও যোগ দিয়েছিলেন শাহরুখ খান, অক্ষয় কুমাররা। বাস্তবিক অর্থেই রাষ্ট্রপতি ভবনে বসেছিল চাঁদের হাট। যদিও তাপমাত্রা ছিল ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার সময় প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে ডাকা হয়েছিল তাঁদের, যাঁরা মন্ত্রিসভায় জায়গা পাচ্ছেন। সেখানে প্রধানমন্ত্রী সবাইকে জয়ের জন্য অভিনন্দন জানান এবং তাঁর মন্ত্রিসভার লক্ষ্য সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করেন। বলেন, সবাইকে নিয়ে সবার বিকাশই তাঁর সরকারের লক্ষ্য।
মন্ত্রিসভায় স্থান দেওয়া হয়েছে সব শরিক দলকেই। মন্ত্রী হয়েছেন জেডিএসের এইচ ডি কুমারস্বামী, জেডি–ইউর রাজীব রঞ্জন সিং, এলজেপির চিরাগ পাসোয়ান, এইচএমএম নেতা জিতেন রাম মাঞ্জি, আরএলডির জয়ন্ত চৌধুরী, টিডিপির রামমোহন নাইডু ও চন্দ্রশেখর পেম্মাস্বামী, আপনা দলের অনুপ্রিয়া প্যাটেল, শিবসেনার (শিন্ডে) প্রতাপ রাও যাদবরা।
মন্ত্রিসভার উল্লেখযোগ্য মুখ হিসেবে এবার যোগ দিলেন বিজেপির সভাপতি জেপি নাড্ডা। ভোটের জন্য তাঁর সভাপতিত্বের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছিল। তাঁকে মন্ত্রী করার অর্থ বিজেপির সভাপতি হিসেবে নতুন কেউ নিযুক্ত হবেন। মন্ত্রী হয়েছেন হরিয়ানার সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মনোহরলাল খাট্টার ও মধ্যপ্রদেশের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহানও। গতকাল সকাল পর্যন্তও সংশয় ছিল নির্মলা সীতারমণ ও এস জয়শঙ্করকে ঘিরে। কিন্তু দুজনেই পূর্ণমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন। মন্ত্রিসভায় উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিদের মধ্যে স্থান হয়নি বিদায়ী মন্ত্রিসভার তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর, নারায়ণ রানে ও স্মৃতি ইরানির। স্মৃতি এবার আমেথি থেকে পরাস্ত হয়েছেন। দলের কোনো কোনো মহল মনে করছিল, তাঁর যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার দরুন হয়তো মন্ত্রী করা হতে পারে। পরে রাজ্যসভা থেকে তাঁকে জিতিয়ে আনা যেতে পারে।