ইতিহাস এভাবেই ঘুরেফিরে আসে। সাড়ে চার দশক আগে ইন্দিরা গান্ধীর হাতে একই সুযোগ তুলে দিয়েছিলেন ভারতের আদালত। সংসদ সদস্য পদ হারানোকে কাজে লাগিয়ে ১৯৮০ সালে লোকসভায় ৩৫৩ আসন জিতেছিলেন তিনি। এর জেরে আবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। একই সুযোগ আজ হাজির রাহুল গান্ধীর সামনে।
সিংহ বিক্রমে লড়াই করে সেই জমানায় ইন্দিরা গান্ধী শুধু জয় ছিনিয়েই নেননি, সংগ্রামের নতুন ইতিহাসও রচনা করেছিলেন। রাহুল কি সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে পারবেন? আজ শুক্রবার লোকসভার সদস্য পদ হারানোর পর রাহুল ও কংগ্রেসের সামনে প্রশ্নটা উঠতে শুরু করেছে।
চার বছর আগে, ২০১৯ সালের নির্বাচনে ‘মোদি’ পদবি নিয়ে মন্তব্যের জেরে রাহুলের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। এ মামলায় গতকাল বৃহস্পতিবার রাহুলকে দুই বছরের সাজা দেন ভারতের আদালত। পরে আজ তাঁর লোকসভা সদস্য পদ খারিজ হয়ে যায়। এই সাজা হয়েছে আইন মেনেই।
আজ রাহুলের বিরুদ্ধে যেমন সভার অধিকারভঙ্গের নোটিশ দিয়েছেন শাসক দলের সদস্যরা, তেমনই ইন্দিরার বিরুদ্ধেও সভার অধিকারভঙ্গের নোটিশ দিয়েছিল শাসক জনতা পার্টি।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির রাজ্য গুজরাটের সুরাট নিম্ন আদালতের বিচারকের এই রায় কতটা যৌক্তিক বা কতখানি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, সেই বিতর্কের অবসান ঘটবে উচ্চ আদালতে। কিন্তু আইন মোতাবেক রায় ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে রাহুল যে সংসদ সদস্য পদ হারানোর যোগ্য হয়ে গেলেন, তা অস্বীকারের উপায় নেই। উচ্চ আদালত সেই রায় না বদলালে দুই বছর জেল খাটার পর রাহুল আরও ছয় বছর নির্বাচনে দাঁড়াতে পারবেন না।
এখন এই পরিস্থিতিতে কী করবেন রাহুল গান্ধী? কীই–বা করবে কংগ্রেস ও বিরোধী শিবির? শুক্রবার থেকে সেই প্রশ্ন রাজনৈতিক মহলে যত ঘুরছে, ততই উঠে আসছে ইন্দিরা গান্ধীর বিস্ময়কর প্রত্যাবর্তনের কাহিনি। সেই সঙ্গে জাগছে স্বাভাবিক প্রশ্ন, রাহুল কি পারবেন দাদির মতো রাজনীতির পাশার দান উল্টে দিতে?
দুই পা এগোনোর আগে কখনো কখনো এক পা পেছাতে হয়। কংগ্রেসের সামনে সেই পিছিয়ে গিয়ে এগোনোর সুযোগ এসেছে।
এলাহাবাদ হাইকোর্টের বিচারপতি জগমোহনলাল সিনহা ১৯৭৫ সালের ১২ জুন এক রায় দেন। তাতে ১৯৭১ সালে ইন্দিরা গান্ধীর নির্বাচনকে অবৈধ আখ্যা দিয়ে ছয় বছরের জন্য তাঁর ভোটে দাঁড়ানোর পথ বন্ধ করে দেন। সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপে সেই রায় বাতিল করে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা ওই বছরের ২৫ জুন জরুরি অবস্থা জারি করেন। ১৯৭৭ সালে তিনি নির্বাচন ডাকেন এবং জনতা পার্টির হাতে পর্যুদস্ত হন। এক বছরের মাথায় কর্ণাটকের চিকমাগালুর উপনির্বাচনে জিতে ইন্দিরা লোকসভায় এলেও দ্বিতীয়বারের মতো তাঁর সদস্য পদ খারিজ হয়ে যায়। ইন্দিরাকে রুখতে দ্বিতীয় রাজনৈতিক চাল চেলেছিল জনতা পার্টি।
আজ রাহুলের বিরুদ্ধে যেমন সভার অধিকারভঙ্গের নোটিশ দিয়েছেন শাসক দলের সদস্যরা, তেমনই ইন্দিরার বিরুদ্ধেও সভার অধিকারভঙ্গের নোটিশ দিয়েছিল শাসক জনতা পার্টি। পশ্চিমবঙ্গের সমর রুদ্র ছিলেন সেই কমিটির চেয়ারম্যান। কমিটি অধিকারভঙ্গের অপরাধে ইন্দিরার সদস্য পদ খারিজ হয়েছিল। কোণঠাসা, পর্যুদস্ত ইন্দিরা গান্ধীর সিংহ বিক্রম ১৯৮০ সালে কংগ্রেসকে দুই–তৃতীয়াংশ ভোটে জিতিয়ে ফের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন।
রাহুলকে ঘিরে সেই প্রশ্নই আজ ঘুরছে। তিনি কি পারবেন এই সংকটকে সম্ভাবনায় পরিণত করে কংগ্রেসকে নতুন জীবন দিতে?
সবটাই নির্ভর করছে কংগ্রেস ও রাহুলের জেগে ওঠার ওপর। কংগ্রেসের ইতিহাস বলে, সংকটকালে দলটি একজোট হয়ে যায়। গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে বিভক্ত কংগ্রেস সেই ইতিহাস অনুসরণ করবে কি না, তার ওপর নির্ভর করবে দলের জেগে ওঠার সম্ভাবনা। দ্বিতীয় বিষয়, রাহুল কীভাবে এই সংকট মোকাবিলায় নামবেন। ভারতজোড়ো যাত্রা চলাকালে যে একাগ্রতা ও জেদ তিনি দেখিয়েছেন, এই সংকটে তা দ্বিগুণ করতে পারবেন কি?
তৃতীয় বিষয়টি আরও জরুরি। সাম্প্রতিক এই রাজনৈতিক সংকট বিভেদ সত্ত্বেও বিরোধীদলগুলোকে অনেক কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। দুর্নীতির অভিযোগে গৌতম আদানির বিরুদ্ধে তদন্তের দাবিতে এত দিন ছাড়া ছাড়া থাকা আম আদমি পার্টি, সমাজবাদী পার্টি কিংবা তেলেঙ্গানার ভারত রাষ্ট্র সমিতি কংগ্রেসের পাশে দাঁড়িয়েছে। রাহুলের সদস্যপদ খারিজের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়রা।
মমতা বলেছেন, ‘গণতন্ত্র তলানিতে এসে ঠেকেছে।’ আর আম আদমি পার্টির অরবিন্দ কেজরিওয়াল বলেছেন, ‘ওরা একটা দল, একজন নেতাকেই চায়। বাকি সব দল ও নেতাকে ওরা শেষ করে ফেলতে চায়। এটাই স্বৈরতন্ত্র।’ এই একটা সিদ্ধান্ত বিরোধী ঐক্য স্থাপনের সুবর্ণ এক সুযোগ এনে দিয়েছে। লড়াই জোরদার করতে কংগ্রেসের সামনেও বাড়তি রাস্তা হাঁটার অপ্রত্যাশিত সুযোগ এনে দিয়েছে ক্ষমতাসীন বিজেপি।
প্রশ্ন উঠেছে, যাবতীয় আড়ষ্টতা ও তিক্ততার অবসান ঘটিয়ে প্রকৃত নেতার মতো মল্লিকার্জুন-সোনিয়া-রাহুল কি মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবেন? দুই পা এগোনোর আগে কখনো কখনো এক পা পেছাতে হয়। কংগ্রেসের সামনে সেই পিছিয়ে গিয়ে এগোনোর সুযোগ এসেছে।
‘গণতন্ত্রের বিপদ’ ব্যানার নিয়ে বিরোধীরা পথে নেমেছে। বিরোধীদের কণ্ঠরোধে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলোকে কাজে লাগানোর বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছে। আদানি প্রসঙ্গেও ক্রমে কাছাকাছি এসেছে তারা। এই পরিস্থিতিতে ভোটের আগে বিরোধী জোট তৈরি করতে কংগ্রেস অনুঘটকের ভূমিকা পালন করতে পারবে কি না; তৃণমূল কংগ্রেস, আম আদমি পার্টি, বিআরএস ও এসপির মতো আঞ্চলিক শক্তিশালী দলের চাহিদা ও দাবি মেনে বৃহত্তর জয়ের জন্য দলীয় স্বার্থকে পাশে রেখে সর্বদলীয় প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে পারবে কি না—আগামী দিনগুলোয় এর জবাব স্পষ্ট হওয়া জরুরি।
শুক্রবার সন্ধ্যায় কংগ্রেস নিজের রাজ্যস্তরীয় ও সাংগঠনিক শাখার গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক ডেকেছে। ‘মোদি’ পদবিধারীদের অপমানের জবাব দিতে বিজেপি ইতিমধ্যেই অনগ্রসর (নরেন্দ্র মোদি নিজেকে অনগ্রসর দাবি করেন) কার্ড নিয়ে প্রচারে নেমেছে। কংগ্রেসকে তার পথ খুঁজে বের করতে হবে। লড়াই দুই দিকে। একটি আইনগত লড়াই। আদালতের আঙিনায়। অন্যটি রাজনৈতিক।
ইন্দিরা গান্ধী সেই লড়াইয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন। শাহ কমিশনের শুনানি চলাকালে সংসদ মার্গে রাস্তায় বসে সরকারকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন। বিহারের বেলচিতে অত্যাচারিত দলিতদের পাশে দাঁড়াতে হাতিতে করে কাদা ভেঙে গিয়েছিলেন। নিজের দাদির জীবন থেকে প্রেরণা নিয়ে রাহুল সাহস করে ঘুরে দাঁড়ালে আগামী দিনের রাজনীতি প্রাণবন্ত ও ক্ষুরধার হয়ে উঠতে পারে। লড়াইয়ের সেই মানসিকতা তিনি ভারত জোড়ো যাত্রার সময় দেখিয়েছিলেন। অবশ্য এখন লড়াই আরও কঠিন।
লোকসভার সদস্য পদ খোয়ানোর পর রাহুলের টুইট, ‘ভারতের মুখে ভাষা ফেরাতে আমি লড়ছি। সে জন্য যেকোনো মূল্য দিতে প্রস্তুত।’ যুদ্ধংদেহী মনোভাব কংগ্রেসেরও। দল বলেছে, ‘সত্য কথা বলার জন্য সাজা পেতে হলো রাহুলকে।’ বিরোধীরা সমর্থনের যে হাত বাড়িয়েছে, কংগ্রেস তা ধরতে পারলে আগামী দিনের লড়াই সমানে সমানে হতে পারে। কংগ্রেস ও বিরোধীদের কাছে এ এক বড় পরীক্ষা।