২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

হিনডেনবার্গ রিপোর্ট: এক মাসেই আদানির সম্পদ কমল ১২ লাখ কোটি রুপি

আদানি সাম্রাজ্যের কর্নধার গৌতম আদানি
ছবি: এএফপি

এক মাস পূর্ণ হলো আদানি গোষ্ঠীর ‘জালিয়াতি ও কারচুপি’–সংক্রান্ত হিনডেনবার্গ রিসার্চের রিপোর্টের বয়স। সেই সঙ্গে মাস পূর্তি হলো একদা পৃথিবীর দ্বিতীয় ধনী শিল্পোদ্যোগীর অবিরাম সাম্রাজ্যধসের। গত ২৪ জানুয়ারি হিনডেনবার্গের রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর আদানি গোষ্ঠীর সব কটি শেয়ারের টানা দরপতনের ফলে ওই গোষ্ঠীর মোট বাজার মূলধনের পরিমাণ কমে দাঁড়িয়েছে ৭ লাখ ২০ হাজার ৬৩২ কোটি রুপিতে। অথচ রিপোর্ট প্রকাশের আগে আদানি গোষ্ঠীর তালিকাভুক্ত ১০টি কোম্পানির মোট বাজার মূলধন ছিল ১৯ লাখ ১৯ হাজার ৮৮৮ কোটি রুপি। অর্থাৎ, ২৪ জানুয়ারি থেকে ২৪ ফেব্রুয়ারি শেয়ার বাজার বন্ধ হওয়ার সময় পর্যন্ত আদানি গোষ্ঠীর ক্ষতির পরিমাণ ১১ লাখ ৯৯ হাজার ২৫৬ কোটি রুপি!

হিনডেনবার্গ রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার আগে ভারতের গুজরাট রাজ্যের ৬০ বছরের শিল্পপতি গৌতম আদানি ছিলেন পৃথিবীর দ্বিতীয় ধনকুবের। শেয়ারবাজারে জালিয়াতি ও কারচুপি করে সম্পদ বৃদ্ধির মারাত্মক অভিযোগ নস্যাৎ করে দিলেও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠতম ও স্নেহধন্য বলে পরিচিত এই শিল্পপতি বাজারের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ। ২০ হাজার কোটি রুপির ‘এফপিও’ বাতিল করে দিয়েও তিনি সেই আস্থা ফেরাতে পারেননি। এক মাসের মধ্যে আজ তিনি সেরা ধনকুবেরদের তালিকার ২৯তম স্থানে নেমে গিয়েছেন। তাঁর মোট সম্পদমূল্য কমে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ২২০ কোটি মার্কিন ডলার। যাঁকে টপকে হু হু করে বাড়িয়ে তুলেছিলেন সংস্থার সম্পদ, সেই মুকেশ আম্বানির সম্পদের পরিমাণ এ মুহূর্তে তাঁর প্রায় দ্বিগুণ—৮ হাজার ৩৩০ কোটি ডলার।

আদানি গোষ্ঠীর ১০ সংস্থার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে আদানি গ্রিন এনার্জির। শেয়ারের বাজারমূল্য কমে গেছে ৮৪ শতাংশ। দরপতনের ক্ষেত্রে এর সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে আদানি ট্রান্সমিশন ও আদানি টোটাল গ্যাসের শেয়ার। দরপতন যথাক্রমে ৮৩ ও ৮১ শতাংশ। গোষ্ঠীর সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত সংস্থা বলে পরিচিত আদানি এন্টারপ্রাইজের শেয়ারমূল্য কমেছে ৬৭ শতাংশ। এ সংস্থার ছাড়া ২০ হাজার কোটি রুপির ‘এফপিও’ পুরো বিক্রি হওয়া সত্ত্বেও ‘গ্রাহকদের আস্থা ফেরাতে’ আদানি গোষ্ঠী তা বাতিল করে দেয়। গৌতম আদানি ঘোষণা করেছিলেন, আস্থা যাতে না হারায় সে জন্য গ্রাহকদের সবার টাকা ফেরত দেওয়া হবে। বাজারের আস্থা অর্জনে গত এক মাসে এই গোষ্ঠী চেষ্টায় ত্রুটি রাখেনি। কিন্তু দরপতন তাঁর সাম্রাজ্যে ধস নামিয়েই চলেছে।

আদানিকে কেন্দ্র করে এক মাস ধরে ভারতের কেন্দ্রীয় রাজনীতিও উত্তাল। সংসদের বাজেট অধিবেশনের প্রথম অর্ধের প্রতিটি দিন বিরোধীরা এ নিয়ে আলোচনার দাবি জানিয়ে ব্যর্থ হয়েছে। সংসদও অচল থেকেছে। বিরোধীদের তোলা তদন্তের দাবিও সরকার মেনে নেয়নি। গৌতম আদানির উল্কাসম বাণিজ্যিক উত্থানের একমাত্র কারণ হিসেবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাহচর্যকে দায়ী করেছেন বিভিন্ন বিরোধী নেতা। তাঁর বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার মতো দেশকে প্রভাবিত করার মারাত্মক অভিযোগও সংসদে আনা হয়েছে। বলা হয়েছে, পছন্দের শিল্পপতির জন্য প্রধানমন্ত্রী দেশের পররাষ্ট্রনীতিকে ব্যবহার করেছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী সংসদে একটি অভিযোগেরও জবাব দেননি। সংসদের বাইরেও আদানি প্রসঙ্গে একবারের জন্যও মুখ খোলেননি। এ পরিস্থিতিতে নিরপেক্ষ তদন্তের দাবিতে একাধিক জনস্বার্থ মামলা দাখিল হয়েছে সুপ্রিম কোর্টে। প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় জানিয়েছেন, তদন্ত সম্পর্কে শিগগিরই তিনি রায় জানাবেন।

প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ, তাঁর নির্দেশে রাষ্ট্রায়ত্ত জীবন বীমা করপোরেশন (এলআইসি) ও স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (এসবিআই) আদানি গোষ্ঠীতে বিনিয়োগ করেছে। অভিযোগের সত্যাসত্য গত এক মাসে প্রমাণিত হয়নি। কিন্তু এ সময়ের মধ্যে শেয়ারের দরপতনের ফলে এলআইসির ‘লোকসান’ হয়েছে প্রায় ৫০ হাজার কোটি রুপি। ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আদানি গোষ্ঠীর ৭টি সংস্থায় এলআইসির মোট শেয়ারের বাজারমূল্য ছিল প্রায় ৮৩ হাজার কোটি রুপি। ২৩ ফেব্রুয়ারিতে তা কমে হয়েছে ৩৩ হাজার ২৪২ কোটি।

শেয়ারের বাজারমূল্যের এই লোকসান অর্থনীতির ভাষায় ‘নোশনাল লস’ বা ‘ধারণাগত ক্ষতি’ মনে করা হলেও এই এক মাসে আক্ষরিক অর্থে এলআইসির ক্ষতি তিন হাজার কোটি রুপি। আদানি গোষ্ঠীর ৭ সংস্থায় যে দামে শেয়ার কিনে এলআইসি ৩০ হাজার কোটি রুপি বিনিয়োগ করেছিল, তা ১১ শতাংশ কমে ২৭ হাজার কোটি রুপিতে দাঁড়িয়েছে। তৃণমূল কংগ্রেসের লোকসভা সদস্য মহুয়া মৈত্র গত শুক্রবার এক টুইটে এই ক্ষতির কথা লিখে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণকে জবাবদিহি করতে বলেছেন। টুইটে তিনি লিখেছেন, ‘৩ হাজার ২০০ কোটি রুপি এখনো পর্যন্ত ক্ষতি হয়েছে এলআইসির। নির্মলা সীতারমণ, জনগণকে বিপদে ফেলে আদানিকে সমর্থন করার জন্য কোনো চাপ কাজ করেছে? আমরা জবাব চাই।’ টুইটের সঙ্গে মহুয়া ওই বিষয়ে সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক রিপোর্টের প্রতিলিপি জুড়ে দিয়েছেন। অর্থমন্ত্রীর কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।

বস্তুত, এক মাস ধরে সরকার মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছে। ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাজার নিয়ন্ত্রক ‘সেবি’ সবকিছু খতিয়ে দেখছে, এটা জানানো ছাড়া সরকার কোনো প্রশ্নেরই জবাব দেয়নি। এ পরিস্থিতিতে সবার নজর সুপ্রিম কোর্টের দিকে। সর্বোচ্চ আদালত নিযুক্ত কমিটির চরিত্র ও তার তদন্তের বিচার্য বিষয় কী কী হবে, দেশের নজর এখন সেদিকে। সরকার প্রধান বিচারপতিকে অনুরোধ জানিয়ে রেখেছে, তদন্তের নামে এমন কোনো ধারণা দেওয়া ঠিক হবে না যে বাজার নিয়ন্ত্রক তাদের কাজে ব্যর্থ।