কাশ্মীরে এখনো তাঁরা কেন ক্যাসেট প্লেয়ারে সুফি গান শোনেন
ফারুক আহমেদ শাকসাজ পেশায় একজন দরজি। ছোট্ট একটি দোকান রয়েছে তাঁর। বেশ পুরোনো, সত্তরের দশকের মডেলের একটি ক্যাসেট প্লেয়ার আছে তাঁর দোকানে। দোকান খুলে ঝাড়মোছ দিয়ে ক্যাসেটটি চালু করেন ফারুক।
ঘরঘরে আওয়াজ তুলে পুরোনো ক্যাসেট প্লেয়ারটি চালু হয়। বেজে ওঠে গোলাম আহমেদ সোফির ঐশ্বরিক কণ্ঠ। সৃষ্টিকর্তার বন্দনা, পাশাপাশি তাঁর কাছ থেকে বিচ্ছেদের বেদনার সুরে বিমোহিত হন ফারুক। গান শোনেন আর সেলাই করেন। এটাই ফারুকের নিত্যদিনের রুটিন।
এই দৃশ্যপট ভারত–নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের শ্রীনগর শহরের। সেখানেই ফারুকের সেলাইয়ের ছোট দোকান। স্থানীয় সুফি গানের দারুণ ভক্ত তিনি। ফারুকের দাদাও সুফিভক্ত ছিলেন। দাদার কাছ থেকে এ গুণ পেয়েছেন তিনি। সেই সত্তরের দশকে ফারুকের দাদা ক্যাসেট প্লেয়ার কিনেছিলেন। সুফি গানের ফিতা সংগ্রহ করতেন। ক্যাসেট চালিয়ে পছন্দের সুফি গান শুনতেন।
সেই অভ্যাস ফারুকেরও রয়ে গেছে। উত্তরাধিকার সূত্র সেই ক্যাসেট প্লেয়ার আর ক্যাসেটের ফিতার দুর্দান্ত সংগ্রহ তিনি পেয়েছেন। তাই দোকানে গিয়ে পুরোনো সেই ক্যাসেট প্লেয়ার ঝেড়েমুছে চালু করে দেন তিনি। কাজের ফাঁকে হারিয়ে যান সুফি গানের ঐশ্বরিক সুরের আবহে।
কাশ্মীর উপত্যকায় ফারুকের মতো কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা সুফি গানের দারুণ ভক্ত। আবার বিশ্বাস করেন, এই গান শোনা ও সংরক্ষণের জন্য ক্যাসেটের ফিতা সবচেয়ে ভালো মাধ্যম। যদিও তাঁরা সংখ্যায় বেশ কম।
কাশ্মীরের ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে আছে সুফি গান। স্থানীয় ও মধ্য এশিয়ার মুসলিম সুফিরা যুগের পর আধ্যাত্মিকতা আর গভীর আবেগের প্রকাশ ঘটিয়েছেন সুফি গানের চর্চার মাধ্যমে। এই গানকে উপত্যকাজুড়ে ছড়িয়ে দিয়েছেন। তাই অনেক মানুষ আধ্যাত্মিকতার প্রতি টান থেকে সুফি গানের দিকে ঝুঁকে পড়েন। এই অঞ্চলের দীর্ঘদিনের সংঘাতময় পরিস্থিতি আর নিরাপত্তাব্যবস্থার কড়াকড়ি থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় আধ্যাত্মিকতায় নিজেকে ডুবিয়ে রাখতে অনেকে সুফি গান শোনেন।
কাশ্মীরি পরিবারগুলোয় প্রিয়জনদের একসঙ্গে সময় কাটানোর অন্যতম মাধ্যম এই ক্যাসেট প্লেয়ার। সবাই একসঙ্গে বসে পছন্দের সুফি গানের ফিতা চালিয়ে দেন, গান শোনেন। কাশ্মীরি সারঙ্গী-সান্তুরের সঙ্গে সুফি সাধকদের রহস্যে মোড়া ঐশ্বরিক সুরের জগতে হারিয়ে যান।
এমনকি আজও এই অঞ্চলের সুফি শিল্পীরা নিজেদের আড়ালে রেখে অডিওর মাধ্যমে গান রেকর্ড করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। সত্তর থেকে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত এ ধারা ব্যাপক জনপ্রিয় ছিল।
দিন বদলের হাওয়ায় গানের জগতেও অনেক পরিবর্তন এসেছে। বদলে গেছে মানুষের গান শোনার ধরনও। ডিজিটালমাধ্যমে গান প্রকাশ আর শোনার ধারা ক্রমে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। হারিয়ে যেতে বসেছে ক্যাসেট প্লেয়ার। এরপরও কাশ্মীরের অনেক বাসিন্দা বলছেন, সুফি গান শোনার সবচেয়ে ভালো মাধ্যম ক্যাসেটের ফিতা। তাঁরা এটাই বেশি শোনেন।
কাশ্মীরে কার্পেট বোনার কাজ করেন আবদুল আহাদ। তিনি বলেন, ‘এই যন্ত্র (ক্যাসেট প্লেয়ার) অনন্য। আমার কাছে এটা আধ্যাত্মিকতার পথপ্রদর্শক।’ তিনি জানান, আধ্যাত্মিকতার বাণী শোনার জন্য ক্যাসেট প্লেয়ারের ‘প্লে বাটনে’ চাপ দেওয়া তাঁর কাছে অনেকটা পবিত্র রীতির মতো।
অডিও ক্যাসেটের চল তুঙ্গে থাকার সময়ে স্থানীয় সুফি গানের বহু জনপ্রিয় অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছিল। এখনো এই ঘরানার নিবেদিতপ্রাণ মানুষেরা সুফি গানের আসর বসান। সেখানে ক্যাসেটের ফিতা বাজিয়ে শুনেন। রাতের বেলার এসব গানের আসরে ডিজিটালমাধ্যমে গান বাজানোকে নিরুৎসাহিত করা হয়।
সুফিপ্রেমীরা বলেন, ডিজিটালমাধ্যমে সুফি গানের সঙ্গে বাজানো বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের আলাদা আলাদা সুর অনেকটাই একাকার হয়ে যায়। আধ্যাত্মিক ভাবটা আর আলাদা করে উপলব্ধি করা যায় না।
আবদুল হামিদ খান নামের এক শ্রোতা বললেন, টেপ রেকর্ডার বাজিয়ে অডিও গান শোনার অনুভূতি সম্পূর্ণ আলাদা। ক্যাসেটের শব্দ খুবই মসৃণ। এতে প্রতিটি বাদ্যযন্ত্রের সুর আলাদা করে উপলব্ধি করা যায়। নিত্যনতুন মাধ্যমগুলোয় এই অনুভূতি পাওয়া যায় না।
তবে চ্যালেঞ্জ যে নেই, তা নয়। বহু ব্যবহৃত পুরোনো ক্যাসেটের ফিতাগুলো জীর্ণ হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে ডিজিটাল স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম আর স্মার্টফোনে গান শোনার চল ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। তাই ক্যাসেট চালিয়ে গানের গভীর বোধ উপলব্ধি করা দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে।
অনেক পরিবার গান শোনার মাধ্যম বদলে ফেলেছে। কেননা, পুরোনো ক্যাসেট প্লেয়ার নষ্ট হয়ে গেলে সারানো কঠিন। অনেক পরিবার প্রজন্মান্তরে হাত ঘুরে আসা প্রিয় ক্যাসেটের ফিতাগুলো সংরক্ষণ করা নিয়ে রীতিমতো সংগ্রাম করছে। অনেকে আবার সংগ্রহে থাকা ক্যাসেটের ফিতাগুলো ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ঠিকঠাক রেখে যেতে ডিজিটালাইজেশনের পথে ঝুঁকছেন।
কাশ্মীর উপত্যকার প্রধান শহর শ্রীনগরে এখন অল্প কয়েকটি দোকান ক্যাসেট প্লেয়ার ও ক্যাসেটের ফিতা বিক্রি করে। আর ক্যাসেট প্লেয়ারের যন্ত্রাংশ কিংবা নষ্ট হয়ে যাওয়া প্লেয়ার সারাইয়ের লোকজন উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। কাশ্মীর উপত্যকায় এখন মুষ্টিমেয় কয়েকজন কারিগর আছেন, যাঁরা সুফিপ্রেমীদের গত শতকের জাপানি ব্র্যান্ডের ক্যাসেট প্লেয়ারগুলো অকেজো হয়ে গেলে, তা কঠোর পরিশ্রম করে সারাই করে দেন।
এমনই একজন মোহাম্মদ আশরাফ মাতু। ক্যাসেট প্লেয়ার সারাইয়ে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা নেই। নিজে নিজে কাজ শিখেছেন তিনি। খুচরা যন্ত্রাংশ ক্রমেই দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠলেও বহু বছর ধরেই আশরাফ দশকের পুরোনো ক্যাসেট প্লেয়ার সচল রাখতে কাজ করছেন।
আশরাফ অকেজো হয়ে যাওয়া ক্যাসেট প্লেয়ার কিনে নেন। এরপর সেগুলো খুলে ব্যবহারযোগ্য যন্ত্রাংশ আলাদা করে রাখেন। ছোট ছোট কিছু যন্ত্রাংশ নিজে বানিয়ে নেন। পরে সেসব অকেজো কোনো ক্যাসেট প্লেয়ারে জুড়ে দিয়ে সেটাকে সচল করার চেষ্টা করেন। অকেজো প্লেয়ার মেরামতের পর তিনি মান ও ব্র্যান্ডভেদে তা ১৫০ থেকে ৮৫০ মার্কিন ডলারে বিক্রি করেন।
আজীবন সুফি গানের দারুণ ভক্ত ফারুক আহমেদ ক্যাসেটের ফিতার প্রজন্মান্তরে সংরক্ষণকে ‘ব্যক্তিগত লক্ষ্য’ হিসেবে নিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘এটা অনেকটা অতীতের সঙ্গে সেতুবন্ধনের মতো। আধুনিক আর ডিজিটাল বিশ্বে আমাদের আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক শিকড়ের সঙ্গে সংযুক্ত থাকার এটি একটি উপায়।’
তথ্যসূত্র: এপি