মণিপুরে সহিংসতা, চূড়ান্ত পরিস্থিতিতে ‘দেখামাত্র গুলি’র নির্দেশ
উত্তর–পূর্ব ভারতের মণিপুর রাজ্যে চলমান সহিংসতার মধ্যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা না গেলে ‘দেখামাত্র গুলি’র নির্দেশ জারি করেছেন রাজ্যপাল অনুসূয়া উইকে। আজ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় জারি করা এ নির্দেশে বলা হয়, চূড়ান্ত পরিস্থিতিতে, যখন আর কোনো উপায় কাজে আসবে না, সেই সময় দেখামাত্র গুলি চালানো যেতে পারে।
বিভিন্ন জেলার শাসক, মহকুমা শাসক এবং কার্যনির্বাহী শাসককে এ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সহিংসতাপ্রবণ এলাকাগুলোতে ইন্টারনেট, সাধারণ মানুষের জমায়েত এবং যান চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে।
দীর্ঘদিন ধরে মণিপুরের সমতলের বাসিন্দা মেইতেই সম্প্রদায়ের সঙ্গে কুকি এবং নাগা জনগোষ্ঠীর নেতৃত্বাধীন গোষ্ঠীর বিরোধ চলছে। মেইতেই সম্প্রদায়ের দীর্ঘদিনের দাবি তফসিলি উপজাতিদের তালিকাভুক্ত হওয়া। সম্প্রতি হাইকোর্ট মেইতেই সম্প্রদায়কে তফসিলি উপজাতিভুক্তদের তালিকায় আনা যায় কি না, তা খতিয়ে দেখতে রাজ্য সরকারকে নির্দেশ দেন। এরপরই নতুন করে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে উত্তর-পূর্বের এই রাজ্য।
হাইকোর্টের নির্দেশের প্রতিবাদে গতকাল বুধবার চূড়াচাঁদপুর জেলার তোরবাঙে ‘অল ট্রাইবাল স্টুডেন্ট ইউনিয়ন মণিপুর’ (এটিএসইউএম) ‘আদিবাসী সংহতি পদযাত্রা’র ডাক দেয়। সেখান থেকে সহিংসতার সূত্রপাত। গতকাল রাতেই নিয়ন্ত্রিত ইম্ফল পশ্চিম, কাকচিং, থৌবাল, জিরিবাম ও বিষ্ণুপুর জেলা এবং ক্ষুদ্র জাতিসত্তানিয়ন্ত্রিত চুরাচান্দপুর ও কাংপোকপি ও তেংনুপাল জেলায় কারফিউ জারি করা হয়েছে। একই সঙ্গে রাজ্যে মুঠোফোন ইন্টারনেট পরিষেবাও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
কয়েক দিন ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সেখানকার বাড়িঘর, দোকানপাটে আগুনের ছবিতে ভেসে যাচ্ছে। অনেকেই রাজ্যের শান্তি স্থাপনের আহ্বান জানিয়েছেন। আজ এ সহিংসতা রাজধানী ইম্ফলেও ছড়িয়ে পড়ে।
পরিস্থিতি সামাল দিতে আজ সকালে সেখানে ফ্ল্যাগ মার্চ করেছে সেনাবাহিনী। রাপিড অ্যাকশন ফোর্স ও দাঙ্গা পুলিশের প্রায় ৫০০ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। তাঁরা গতকাল থেকে থাকা সেনাবাহিনী, আসাম রাইফেলস, কেন্দ্রীয় রিজার্ভ পুলিশ ফোর্স এবং রাজ্য পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন।
এরই মধ্যে সহিংসতাপ্রবণ এলাকাগুলো থেকে ৯ হাজারের বেশি মানুষকে সরিয়ে নিয়েছে নিরাপত্তা বাহিনী। প্রতিরক্ষা বিভাগের একজন মুখপাত্র জানান, প্রায় পাঁচ হাজার মানুষকে চূড়াচাঁদপুরে নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্রে, দুই হাজার জনকে ইম্ফল ভ্যালিতে আর দুই হাজার জনকে সীমান্তবর্তী শহর তেংগুপাল জেলার মোরেহতে রাখা হয়েছে।
আজ সকালের দিকে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংহ বলেন, ‘রাজ্যের পরিস্থিতি স্বাভাবিকের দিকে যাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।...আমরা আমাদের জনগণের জীবন ও সম্পদ রক্ষা করতে বদ্ধপরিকর।’ এ ছাড়া এন বীরেন সিংহ ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে রাজ্যের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানিয়েছেন।
মণিপুরের পরিস্থিতি নিয়ে রাজ্যের ক্ষমতাসীন বিজেপি জোট সরকারের সমালোচনা করছে বিরোধী দলগুলো। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী প্রধানমন্ত্রীকে এদিকে নজর দিতে আবেদন জানিয়েছেন। কংগ্রেসের দাবি, মণিপুরের অবস্থা ভুলে মোদি এবং বিজেপি কর্ণাটকে ভোট জেতায় মগ্ন। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও টুইট করে এ ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘এটা রাজনীতি করার সময় নয়। রাজনীতি এবং নির্বাচন অপেক্ষা করতে পারে, কিন্তু এখন সবার আগে মণিপুরকে রক্ষা করতে হবে। আমি প্রধানমন্ত্রী এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে মণিপুরে শান্তি ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানাচ্ছি।’ পাশাপাশি তিনি মণিপুরের বাসিন্দাদের শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখারও অনুরোধ জানিয়েছেন।
হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত মেইতেইরা বর্তমানে রাজ্যের জনসংখ্যার ৪৪ শতাংশ (২০১১ সালের জনশুমারি অনুযায়ী)। ১৯৫১ জনশুমারিতে তাদের সংখ্যা ছিল ৫৯ শতাংশ। তারা কিছুদিন আগে, হাইকোর্টে তফসিলি উপজাতি হিসেবে স্বীকৃতি চেয়ে আবেদন জানায়। বিষয়টি বিবেচনার জন্য গত ১৪ এপ্রিল রাজ্য সরকারকে নির্দেশ দেন হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ। এরপর থেকেই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে মণিপুরের পার্বত্য অঞ্চল।
মণিপুরের ইতিহাসবিদ ও লেখক মালেম নিঙথৌজা প্রথম আলোকে বলেন, একটা বড় সমস্যা হলো, মেইতেইরা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হলেও, সমতলে মাত্র ৫ শতাংশ বা তারও কম জমি তাদের কাছে আছে। যদিও মেইতেইরা মণিপুরের জনসংখ্যার প্রধান অংশ। কিন্তু তারা উপজাতি হিসেবে সংরক্ষিত নয় বলে বিস্তীর্ণ পার্বত্য অঞ্চলে জমি কিনতে পারবে না।
মালেম নিঙথৌজা আরও বলেন, ‘পার্বত্য অঞ্চলে কুকিদের জমি বেশি থাকলেও, জনসংখ্যা কম। সেখানে ক্ষমতাশালী কুকিরা বরাবরই রাষ্ট্রের মদদ পেয়ে এসেছে। তাদের সাহায্যে সেনাবাহিনী বিভিন্ন সশস্ত্র সংগঠনকে নিয়ন্ত্রণ করেছে।’
এ ছাড়া সম্প্রতি মাদক পাচারের অভিযোগে পার্বত্য জনগোষ্ঠী নিয়ন্ত্রিত এলাকায় আফিম চাষ বন্ধ করার চেষ্টা করেছে মণিপুর সরকার। বনাঞ্চল থেকে পার্বত্য জনগোষ্ঠীকে উচ্ছেদ করার চেষ্টাও চালানো হয়েছে। ‘এই সবকিছু শেষ পর্যন্ত কুকি জনগোষ্ঠীকে উদ্বিগ্ন এবং উত্তেজিত করেছে। তারই ফল এ জাতি দাঙ্গা। এর জন্য অনেকটাই সরকার দায়ী।’ বলেন নিঙথৌজা।
কুকি, নাগাসহ অন্যান্য জনগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে পড়াশোনা, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে অনেকটাই এগিয়ে মেইতেই সম্প্রদায়। এ অবস্থায় যদি তফসিলি উপজাতি তালিকাভুক্তির মাধ্যমে তাদের আরও সামাজিক সুরক্ষা দেওয়া হয়, তবে তারা আরও এগিয়ে যাবে। এতে পিছিয়ে পড়বে অন্যান্য জনজাতীয় জনগোষ্ঠী।
‘মণিপুরের তফসিলি উপজাতির অবস্থার রাজনীতি’বিষয়ক গবেষণা করেছেন নয়াদিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব ল অ্যান্ড গভর্ন্যান্সের সহকারী অধ্যাপক থংখোলাল হাওকিপ। সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘মেইতেইদের সংস্কৃতি এবং পরিচয় রক্ষার জন্য সংরক্ষণ প্রয়োজন, এমন দাবি ভিত্তিহীন। মেইতেই একটি প্রভাবশালী গোষ্ঠী, যা রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রযন্ত্র নিয়ন্ত্রণ করে। রাষ্ট্র তাদের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার রক্ষা করে আসছে। এ ছাড়া তাদের সংস্কৃতি এবং পরিচয় কোনোভাবেই বিপন্ন নয়।’
মণিপুরের অন্যতম জ্যেষ্ঠ সম্পাদক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক প্রদীপ ফাঞ্জোবাম সম্প্রতি অন্তত দুটি লেখায় সরকারকে সাবধান করে দিয়েছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, একাধিক স্পর্শকাতর বিষয় বিবেচনা করে সরকারকে দ্রুত সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। না হলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।