যুক্তরাষ্ট্র প্রায় আড়াই দশক ধরে ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রক্ষা করে চলছে। এই সময়ের মধ্যে যত প্রেসিডেন্ট এসেছেন, তাঁদের সবাই ভারতের অগ্রগতিকে উৎসাহিত করেছেন। বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে ভারতকে মোটামুটি তাঁরা সব সময় অগ্রাধিকার দিয়ে যাচ্ছেন।
৯ ও ১০ সেপ্টেম্বর ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে জি–২০ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এই অনুষ্ঠানে বেশ প্রফুল্লচিত্তে থাকছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তবে দুই দেশের এই উষ্ণ সম্পর্কের মধ্যেও মাঝেমধ্যে তিক্ততা ভর করে। এমনকি মার্কিন কর্মকর্তারাই স্বীকার করছেন, ভারতের স্বার্থ নিয়ে অনেক সময় ওয়াশিংটনের সঙ্গে মতভেদ দেখা যায়।
জি–২০ সম্মেলন এমন একসময় হচ্ছে, যে বছর ভারত জনসংখ্যায় প্রতিবেশী চীনকে ছাড়িয়ে গেছে। এখন ভারতই বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ। এ বছরই আবার ভারত তাদের সাবেক ঔপনিবেশিক শাসক ব্রিটেনকে হটিয়ে বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এসব অর্জনের মধ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বেশ উৎসবের মেজাজে এবার আমেরিকা, ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশ সফর করেছেন।
জি–২০ সম্মেলন সামনে রেখে ব্রুকিং ইনস্টিটিউশনের সিনিয়র ফেলো তানভি মদন বলেন, ‘আমি মনে করি, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরার মাধ্যমে এখন ভারতকে বিশ্বমঞ্চে বড় শক্তি হিসেবে জানান দিতে চান। তাঁর সেই সময়টা এসেছে বলে মনে হয়।’
যুক্তরাষ্ট্র যদি মানবাধিকার ও গণতন্ত্র ইস্যু নিয়ে কথা বলতে শুরু করে, সেটা দুই দেশের সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করার মতো ঝুঁকি তৈরি করবে। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
যুক্তরাষ্ট্র গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে ভারতকে তাদের স্বভাবজাত মিত্র বলে মনে করে। এই দেশই পারে স্বেচ্ছাচারী ও ক্রমশ প্রভাবশালী হয়ে ওঠা চীনকে মোকাবিলা করতে। ইতিমধ্যেই এই দুই দেশের মধ্যে সীমান্তের বিতর্কিত বিভিন্ন অংশে সংঘর্ষ হয়েছে।
চীনের সঙ্গে ভারতের উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্ক দুই দেশকে মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড় করিয়েছে। আবার এই ভারতই কখনো কখনো যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রাধিকার ইস্যুতে তাদের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। যেমন ইউক্রেনে আগ্রাসনের পর রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করার মার্কিন উদ্যোগকে প্রত্যাখ্যান করে পুরোনো মিত্র মস্কোর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখছে দিল্লি।
জি–২০ সম্মেলনে ভারত ভূরাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে খুব বেশি নাড়াচাড়া করার পক্ষে নয়। বরং সে চায় উন্নয়ন বিশেষ করে ঋণ মওকুফ ও জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিষয়ে সব দেশ যেন ঐকমত্য হয়।
মানবাধিকার সংগঠনগুলোও অভিযোগ করছে, হিন্দুত্ববাদীরা সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা চালাচ্ছে এবং সরকার সমালোচক গণমাধ্যমকে হয়রানি করছে। এমন পরিস্থিতিতে হিন্দু জাতীয়তাবাদী নেতার অধীনে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অবনতি হলেও পশ্চিমারা নরেন্দ্র মোদিকে কাছে টেনে নিচ্ছেন।
স্নায়ুযুদ্ধকালে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় দেশ হিসেবে ভারত এখনো ‘প্রচণ্ডভাবে স্বাধীন’ থাকতে চাইবে, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই
পশ্চিম ও দক্ষিণের মধ্যে সেতুবন্ধ
পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তা হিসেবে আলিসা আইরেস ওয়াশিংটনের সঙ্গে দিল্লির সম্পর্ক উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছিলেন। তিনি বলছিলেন, স্নায়ুযুদ্ধকালে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় দেশ হিসেবে ভারত এখনো ‘প্রচণ্ডভাবে স্বাধীন’ থাকতে চাইবে—এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
আলিসা বলেন, ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মতভেদের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের অসংগতি দেখে না। কারণ, এই দেশটি ‘সারা দুনিয়ার সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক’ রাখতে চায়।
যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির এলিয়ট স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের ডিন আলিসা বলেন, ভারতীয় নেতৃত্বের ভূমিকা এখন দেখার বিষয়। দেখার বিষয়, জি–২০–এর সভাপতি হিসেবে ভারত বৃহৎ অর্থনীতির দেশগুলোর সঙ্গে বৈশ্বিক দক্ষিণের সেতুবন্ধ গড়তে কতটা প্রকাশ্যে ভূমিকা রাখতে পারে।
বাইডেন প্রশাসন বারবার মোদির নেতৃত্বকে কুর্নিশ করেছে। তারা বলেছে, জি–২০–এর সাফল্য অর্জনে আন্তর্জাতিক অর্থনীতির প্রতিষ্ঠানের সংস্কারসহ তারা ভারতের সঙ্গে কাজ করবে।
বাইডেনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র চায়, ওয়াশিংটনের ভূমিকা বৃদ্ধির মাধ্যমে জি–২০ সারা বিশ্বের জিডিপির ৮৫ শতাংশকে প্রতিনিধিত্ব করবে। এমন একসময় তারা এই বিষয়ে নজর দিচ্ছে, যখন ব্রিকস ক্লাব অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে সম্প্রসারিত হতে চলেছে। চীনের নেতৃত্বে ভারত আবার এই ক্লাবেরও সদস্য।
হাডসন ইনস্টিটিউটের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক বিশেষজ্ঞ অপর্ণা পান্ডে বলেন, বিশ্বমঞ্চে নিজের ভূমিকা বাড়াতে সচেষ্ট ভারত অবশ্য একক শক্তির প্রভাব বলয়ের বাইরে বহুমুখী (মালটিপোলার) বিশ্ব দেখতে চায়।
অপর্ণা বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মতভিন্নতা সত্ত্বেও ভারত একই সময়ে এই দেশটিকে শক্তিশালী অংশীদার হিসেবে চায়। কারণ, প্রতিদ্বন্দ্বী চীন উন্নয়নশীল দেশগুলোকে তার কাছে ভেড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে।
অপর্ণা পান্ডে বলছিলেন, ‘বৈশ্বিক দক্ষিণ অর্থাৎ সাবেক উন্নয়নশীল ও জোটনিরপেক্ষ দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। এটাই ভারতকে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের জন্য সেতুবন্ধ হিসেবে হাজির করেছে।’
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মতভিন্নতা সত্ত্বেও ভারত একই সময়ে এই দেশটিকে শক্তিশালী অংশীদার হিসেবে চায়। কারণ, প্রতিদ্বন্দ্বী চীন উন্নয়নশীল দেশগুলোকে তার কাছে ভেড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে
রাশিয়া নিয়ে সম্মতি–অসম্মতি
চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন জি-২০ সম্মেলনে আসছেন না। তাঁদের অনুপস্থিতি বাইডেনকে বাড়তি সুবিধা দেবে। নিশ্চিত তিনি সেই সুবিধা কাজেও লাগাতে চাইবেন।
সি চিন পিং নয়াদিল্লিতে হয় তো শীতল ও কম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে অভ্যর্থনা পেতেন। অন্যদিকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞায় ভারত যোগ দেয়নি। জি–২০ সম্মেলনে পুতিনের উপস্থিতি ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম দিত। কারণ, পশ্চিমা বিশ্ব তাঁকে এড়িয়ে চলছে। আবার দিল্লিতে আসলে তিনি আন্তর্জাতিক গ্রেপ্তারি পরোয়ানার মুখে পড়তেন।
উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক বিশেষজ্ঞ মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, রাশিয়া যখন ইউক্রেনে হামলা চালায়, তখন ভারতের অবস্থানে ‘বেশ উদ্বিগ্ন’ ছিল যুক্তরাষ্ট্র। পরে অনিচ্ছাকৃতভাবে হলেও বিষয়টি তারা মেনে নিয়েছে।
কুগেলম্যান বলেন, ‘আমার মনে হয়, যুদ্ধের শেষে যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে মধ্যস্থতা ও আলোচনায় ওয়াশিংটন ভারতকে কাজে লাগিয়ে সুবিধা নিতে চাইবে। সেটা ওয়াশিংটনের মাথায় থাকতে পারে।’
কুগেলম্যান বলেন, তিনি মনে করেন, মানবাধিকারকে অগ্রাধিকার দেওয়া বাইডেন প্রশাসন ভারতের অভ্যন্তরে নানা ঘটনায় ‘বেশ উদ্বিগ্ন’। তবে এসব বিষয় নিয়ে তারা ‘চুপ থাকার’ নীতি নিয়েছে।
এই মার্কিন বিশেষজ্ঞ বলেন, যুক্তরাষ্ট্র যদি মানবাধিকার ও গণতন্ত্র ইস্যু নিয়ে কথা বলতে শুরু করে, সেটা দুই দেশের সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করার মতো ঝুঁকি তৈরি করবে। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ।