ভারতে বুলডোজার নীতি, উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের হুঁশ ফিরবে কি

ভারতের এলাহাবাদে একজনের বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। ২০২২ সালের ১২ জুন তোলাএএফপি ফাইল ছবি

ভারতের সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিয়েছেন, বিচারের নামে অথবা নিছক সন্দেহের বশে কিছুতেই বুলডোজার চালানো যাবে না। অবৈধ স্থাপনা ভাঙতে প্রয়োজনে বুলডোজার চালানো হতে পারে, তবে তা করতে হবে আইন মেনে। নিয়ম মেনে। সে জন্য নোটিশ দিতে হবে। নোটিশের জবাব পাওয়ার জন্য সময় দিতে হবে। স্থাপনা খালি করার সুযোগ দিতে হবে। ভারতের সর্বত্র নিয়ম–বিধি চালু করতে সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশনামা জারির আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। খুবই সাধু উদ্যোগ। কিন্তু প্রশ্ন জাগে, উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের চালু করা এই বুলডোজার নীতির প্রয়োগ কি তাতে বন্ধ হবে?

প্রশ্ন জাগার কারণ, আজও স্বঘোষিত গোরক্ষকদের হাতে নিছক সন্দেহের কারণে নিরপরাধ মানুষকে প্রাণ হারাতে হচ্ছে। সুপ্রিম কোর্টের দুই বিচারপতি বি আর গাভাই ও কে ভি বিশ্বনাথনের বেঞ্চ যেদিন বুলডোজার নীতি–সংক্রান্ত নীতিমালা তৈরি করে দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন, সেদিনই জানাজানি হয়, দিল্লির অদূরে হরিয়ানার ফরিদাবাদে স্বঘোষিত গোরক্ষকদের গুলিতে প্রাণ হারাতে হয়েছে দ্বাদশ শ্রেণির এক পড়ুয়াকে, স্রেফ গরু পাচারকারী সন্দেহে। মৃত্যুর পর জানা যায়, তরুণটি আদৌ গরু পাচারের সঙ্গে যুক্ত নন। দুই বন্ধুর সঙ্গে খেতে বেরিয়েছিলেন। তিনজনই হিন্দু। যিনি নিহত হন, তাঁর নাম আরিয়ান মিশ্র।

গোরক্ষা ও গোহত্যা নিয়ে রাজ্যে রাজ্যে নির্দিষ্ট আইন থাকলেও যাঁরা তার তোয়াক্কা না করে আইন নিজের হাতে তুলে নেন, ইচ্ছেমতো মেরে ফেলেন সন্দেহভাজনদের, তাঁরা কি বুলডোজারের প্রয়োগ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনাম মানবেন? সন্দেহ প্রবল। কারণ, এই ভয়ের রাজনীতিই উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের মোক্ষম অস্ত্র।

বুলডোজার নীতির জন্মদাতা উত্তর প্রদেশের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। সমাজবাদী পার্টির (এসপি) শাসনের অবসান ঘটিয়ে ২০১৭ সালে রাজ্যে ক্ষমতায় এসে বুলডোজারকে তিনি সুশাসনের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরেন। রাজ্যে চালু থাকা গ্যাংস্টার ও অসামাজিক কাজকর্ম রোধ আইনে তিনি ১৫ হাজার ‘অপরাধীর’ বিরুদ্ধে মামলা করেন। শুধু মামলা করেই তিনি চুপ থাকেন না, ‘অপরাধীদের’ ধরতে শুরু করেন চাপের রাজনীতি। বুলডোজার দিয়ে ভাঙতে থাকেন ‘দাগি আসামিদের’ বাসস্থান, যেগুলো অধিকাংশই বেআইনিভাবে তৈরি। আইন নিজের হাতে এভাবে তুলে নেওয়ায় তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষোভ জমলেও একশ্রেণির মানুষের কাছ থেকে তিনি পেতে থাকেন অকুণ্ঠ সমর্থন। বিশেষ করে নারীদের কাছে এ উদ্যোগ জনপ্রিয়াতা পায়। কারণ, নারীরা এসপি আমলে আইন–শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির জন্য রাস্তাঘাটে নিরাপদ বোধ করতেন না। ২০২০ সালের জুলাই মাসে কানপুরের বিকরু গ্রামে সমাজবিরোধী বলে পরিচিত বিকাশ দুবের ঘরবাড়ি বুলডোজার চালিয়ে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। রাজ্যের ৮ জন পুলিশ কর্মীকে খুনের অভিযোগে পুলিশ তাঁকে খুঁজছিল। মুখ্যমন্ত্রীর রোষের হাত থেকে বাঁচতে শোনা যায় তিনি মধ্যপ্রদেশে আত্মসমর্পণ করেন। কিন্তু দিল্লির পথে ‘গাড়ি দুর্ঘটনায়’ তাঁর মৃত্যু হয়। অভিযোগ, মাঝরাস্তায় এনকাউন্টার করে তাঁকে মারা হয়।

সেই থেকে কুখ্যাত ‘ডন’ বলে পরিচিত মুখতার আনসারি, আতিক মহম্মদদেরও মৃত্যু হয় এনকাউন্টারে। জেলবন্দী ওই দুই ‘অপরাধীর’ ঘরবাড়িও বুলডোজার চালিয়ে ভেঙে দেওয়া হয়েছিল; যেমন ভাঙা হয়েছে আরও অনেকের ঘরবাড়িই। ক্রমেই বুলডোজার হয়ে ওঠে ‘অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের প্রতীক’। ২০২২ সালের বিধানসভা ভোটের আগে মুখ্যমন্ত্রীর নামকরণ হয় ‘বুলডোজার বাবা’। বিজেপির মিছিলগুলোয় প্রদর্শিত হতে থাকে বুলডোজার। দেখা যায়, ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া সম্পত্তির ৯০ শতাংশের মালিক বা আবাসিক মুসলমান। বুলডোজার হয়ে ওঠে অপরাধ নিরসনের ‘চটজলদি বিচার’। প্রচার চলে, বুলডোজারের ভয়ে অপরাধীরা ঝিমিয়ে গেছে। রামরাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছেন যোগী আদিত্যনাথ। কমে গেছে অপরাধের মাত্রা।

দ্বিতীয়বার ভোটে জিতে ক্ষমতাসীন হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই যোগীর নির্দেশে বুলডোজার আবার সক্রিয় হয়ে ওঠে। এক ধর্ষণ মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বাড়ি ভেঙে দেওয়া হয় ‘অপরাধীদের’ ওপর চাপ সৃষ্টির তাগিদে।

যে নীতি আইনের চোখে সমর্থনীয় নয়, সেটাই কিন্তু হয়ে ওঠে বিজেপির নির্বাচনে জেতার হাতিয়ার। খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিই মান্যতা দিতে থাকেন সেই নীতিকে। এই বছর জুন মাসে লোকসভা ভোটের প্রচারে গিয়ে উত্তর প্রদেশের বরাবাঁকি জেলায় এক জনসমাবেশে মোদি বলেন, ‘এসপি ও কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে অযোধ্যার মন্দির থেকে রামলালাকে বের করে দেবে। বুলডোজার চালিয়ে রামমন্দির ভেঙে দেবে। যোগীজির কাছ থেকে ওই দুই দলের শেখা উচিত, বুলডোজারের প্রয়োগ কোথায় করতে হয়, কোথায় নয়।’

লোকসভা ভোটে উত্তর প্রদেশের জনতা বিজেপিকে প্রত্যাখ্যান করলেও মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহান ভোটে জিততে ‘বুলডোজার নীতিই’ আঁকড়ে ধরেন। যোগীর মতো তিনিও যে কঠোর প্রশাসক, তা বোঝাতে ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে ব্যবহার করেন বুলডোজার। খারগন এলাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর বুলডোজার চালিয়ে তিনি ভেঙে দেন ১৬টি বাড়ি ও ২৯টি অন্য স্থাপনা। নরমপন্থী শিবরাজ সিং, যিনি রাজ্যে ‘মামা’ বলেই পরিচিত, ওই ঘটনার পর তাঁর নতুন নাম হয় ‘বুলডোজার মামা’। লোকসভা ভোটে মধ্যপ্রদেশে বিজেপি প্লাবন ঘটিয়ে দেয়। যদিও শিবরাজকে রাজ্য ছেড়ে চলে আসতে হয় কেন্দ্রে। মুখ্যমন্ত্রী হন মোহন যাদব। বুলডোজার চালিয়ে রাজধানী ভোপালে তিনি ভাঙতে থাকেন একের পর এক ‘অবৈধ’ মাংসের দোকান। কিছু মানুষ এক বিজেপি কর্মীকে মারধর করেছিলেন বলে অভিযোগ। তাঁদের ঘরবাড়িও ভেঙে দেওয়া হয়।

এভাবে ক্রমেই রাজ্যে রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে ‘বুলডোজার সংস্কৃতি’। বিজেপি–শাসিত উত্তরাখন্ড, হরিয়ানা, মহারাষ্ট্র, আসাম ও রাজস্থানে অবাধে চলেছে ‘বুলডোজার রাজ’। আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মাকে বুলডোজার নীতির কারণে পাঁচ পরিবারকে মোট ৩০ লাখ রুপি ক্ষতিপূরণও দিতে হয়েছে। আম আদমি–শাসিত দিল্লিও তা থেকে রেহাই পায়নি। উপরাজ্যপাল ও পুলিশ—দুই-ই কেন্দ্রচালিত বলে ২০২২ সালে জাহাঙ্গীরপুরির দাঙ্গার পর অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বাড়ি বাড়ি চলে বুলডোজার অভিযান। পৌরসভার অভিযোগ, প্রতিটি নির্মাণই অবৈধ। অনেক আগে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নোটিশ দেওয়া হয়েছে। পৌরসভা আইন মেনেই ব্যবস্থা নিয়েছে।

প্রধানত বিজেপি–শাসিত রাজ্যগুলোর সংখ্যালঘু মহল্লায় ‘বাঘের আগে ফেউ আসার’ মতো পুলিশের পেছন পেছনে আসে বুলডোজার। বছর কয়েক ধরে এটাই হয়ে উঠেছে দস্তুর। তা সে সমাজবিরোধী দমন অথবা গোহত্যা বা গোমাংস ভক্ষণের অভিযোগ, যা–ই হোক না কেন। বিজেপি–শাসিত রাজ্যগুলোর এই নীতি অবিজেপি–শাসিত রাজ্যেও যে ছায়া ফেলেনি, তা নয়। রাজস্থানের কংগ্রেস মুখ্যমন্ত্রী অশোক গেহলটও গত বিধানসভা ভোটের আগে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে জয়পুরের এক কোচিং সেন্টার ভেঙে দিয়েছিলেন বুলডোজার চালিয়ে। রাস্তাজুড়ে অবৈধভাবে গড়ে তোলা দোকান ও হকার উচ্ছেদে কলকাতাসহ পশ্চিমবঙ্গের কোনো কোনো জেলাতেও বুলডোজারের ব্যবহার হয়েছিল গত জুন মাসে। পরে মুখ্যমন্ত্রী তা প্রত্যাহার করে এক মাস সময় দেন। পৌরসভাগুলোকে মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, এক মাস সময় দেওয়া হচ্ছে সবকিছু ঠিক করার জন্য। হকারদের জন্য নির্দিষ্ট জায়গা করে দিতে হবে। করতে হবে পার্কিংয়ের জায়গাও। পৌরসভাগুলোর উদ্দেশে তিনি বলেছিলেন, ‘প্রথমে হকার বসাবেন, তারপর বুলডোজার চালিয়ে ভেঙে দেবেন—এসব চলবে না।’

পশ্চিমবঙ্গে তার পর থেকে আর বুলডোজার চলেনি। সুপ্রিম কোর্টের মনোভাব জানাজানি হওয়ার পর বিজেপি–শাসিত রাজ্যগুলো কি এবার বুলডোজারের রাশ টানবে?