মণিপুরের সহিংসতা কাছাকাছি আনছে কুকি ও নাগাদের
মণিপুর রাজ্যে দুই গুরুত্বপূর্ণ জাতিগোষ্ঠী কুকি ও নাগাদের মধ্যে বিরোধ দীর্ঘদিনের। ১৯৯২ সালে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে জাতিগত সংঘাত সহিংস সংঘর্ষে রূপ নেয়। উত্তর-পূর্ব ভারতের বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী নেহজিনপাও কিপজেনের মতে, আজকের মণিপুরের মতোই ওই সহিংসতায় এক হাজারের বেশি মানুষ মারা যান, বেশ কয়েক হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হন। সেই সংঘাত ১৯৯৭ সালে শেষ হলেও সম্পর্ক এখনো স্বাভাবিক নয়। অবশ্য অনেক পর্যবেক্ষকের মত, কুকি ও নাগাদের মধ্যে সহিংসতার পাশাপাশি সহাবস্থানের ইতিহাসও রয়েছে।
মণিপুরে গত মে মাসের গোড়ায় জাতিগত দাঙ্গা শুরু হয়, যার জেরে এ পর্যন্ত দুই শতাধিক মানুষ মারা গেছেন, বাস্তুচ্যুত হয়েছেন ৬০ হাজারের বেশি বাসিন্দা। এই সহিংসতার পরিপ্রেক্ষিতে মণিপুরের কুকি সমাজের শীর্ষ সংস্থা কুকি ইনপি গতকাল সোমবার মণিপুরের নাগা-অধ্যুষিত অঞ্চলে ইউনাইটেড নাগা কাউন্সিলের (ইউএনসি) গণসমাবেশকে সমর্থন জানিয়েছে।
বর্তমানে প্রধানত হিন্দুগরিষ্ঠ মেইতেইদের সঙ্গে বিবাদের ফলে সংখ্যালঘু কুকিসহ অন্যান্য আদিবাসী গোষ্ঠী এই প্রথম নাগা-ভারত চুক্তির প্রশ্নে নাগাদের পাশে দাঁড়াল।
মণিপুরের নাগাদের শীর্ষ সংগঠন ইউএনসি ৯ আগস্ট মণিপুরের নাগা এলাকায় গণসমাবেশের ডাক দিয়েছে। এই সমাবেশের উদ্দেশ্য ভারত সরকার ও নাগা জাতিগোষ্ঠীর সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক ও বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট কাউন্সিল অব নাগাল্যান্ড–আইএমের (এনএসসিএন-আইএম) মধ্যে ২০১৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাক্ষরিত ‘ফ্রেমওয়ার্ক অ্যাগ্রিমেন্টের’ ভিত্তিতে ইন্দো-নাগা রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের দাবিকে আন্দোলনের স্তরে নিয়ে যাওয়া।
কুকি জাতিগোষ্ঠী এত দিন নাগাদের এই দাবিকে সমর্থন করেনি। মণিপুরের জাতি দাঙ্গায় আক্রান্ত হওয়ার কারণেই তারা যে নাগাদের পাশে দাঁড়িয়েছে, তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন কুকি ইনপির তথ্য প্রচার সচিব জাংহাওলুন হাওকিপ। তিনি এক বিবৃতিতে বলেন, মণিপুরের কুকিরা যখন সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতেইদের হাতে ‘জাতিগত নির্মূলের’ শিকার হচ্ছে এবং রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে প্রকাশ্যে ও গোপনে তাদের আক্রমণ করা হচ্ছে, তখন কুকি ইনপি মণিপুর ইউএনসি আয়োজিত প্রস্তাবিত ৯ আগস্টের গণসমাবেশকে পুরোপুরি সমর্থন করছে। ১৯৪২ সালের ৯ আগস্ট ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন মোহনদাস গান্ধী।
কুকিরা এত দিন নাগাদের সঙ্গে ভারত সরকারের ফ্রেমওয়ার্ক অ্যাগ্রিমেন্টের প্রশ্নে নাগাদের পাশে দাঁড়ায়নি। এর কারণ, কুকিদের আশঙ্কা, নাগা-ভারত চুক্তির মাধ্যমে নাগারা মণিপুরের এমন অনেক অংশ নাগা–অধ্যুষিত এলাকার মধ্যে নিয়ে নেওয়ার কথা বলতে পারে, যেখানে কুকিসহ অন্যান্য উপজাতীয় গোষ্ঠী বসবাস করে। অন্য রাজ্যের নাগাদের বৃহত্তর নাগাল্যান্ডের মধ্যে আনা উচিত নাকি শুধুই নাগাল্যান্ডের অধিকারের দাবি নিয়ে আন্দোলনে যাওয়া উচিত, তা নিয়ে নাগা সমাজের মধ্যেও বিবাদ রয়েছে। কিন্তু মে মাসের গোড়ায় মণিপুরের সহিংসতার জেরে এই সমীকরণ বদলাচ্ছে।
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, মণিপুরের নাগা সামাজিক সংগঠন ইউএনসির এই সমাবেশ করলেও রাজনৈতিক স্তরে রাজ্যের বীরেন সিংয়ের নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকারকে এখনো সমর্থন দিচ্ছেন নাগা বিধায়কেরা।
বর্তমানে প্রধানত হিন্দুগরিষ্ঠ মেইতেইদের সঙ্গে বিবাদের ফলে সংখ্যালঘু কুকিসহ অন্যান্য আদিবাসী গোষ্ঠী এই প্রথম নাগা-ভারত চুক্তির প্রশ্নে নাগাদের পাশে দাঁড়াল।
ব্রিটিশ শাসনের সময় থেকে আজ পর্যন্ত, ভারত সরকার সার্বিকভাবে এই দুই শক্তিশালী জাতিগোষ্ঠীকে বিচ্ছিন্ন রেখেই উত্তর-পূর্বে কর্তৃত্ব বজায় রাখতে পেরেছে। পর্যবেক্ষকদের মতে, এই দুই গোষ্ঠীর পরস্পরের পাশে এসে দাঁড়ানো ভবিষ্যতে উত্তর-পূর্বে ভারত সরকারের উদ্বেগ বাড়াবে।
কুকি ইনপি বিবৃতিতে স্পষ্টই জানিয়েছে, মণিপুরে তাদের ‘পৃথক প্রশাসন’-এর দাবি এবং নাগাদের বৃহত্তর ও নিজস্ব ভূমির আন্দোলনকে তারা আর আলাদাভাবে দেখছে না।
হাওকিপ বলেন, উপজাতি সম্প্রদায়ের সাংবিধানিক অধিকার অগ্রাহ্য করে প্রাতিষ্ঠানিক আধিপত্যবাদের মাধ্যমে ৫০ বছরের বেশি সময় মণিপুর সরকারের উদাসীনতা সহ্য করা হয়েছে। উপজাতীয় সমাজের দাবি সম্পূর্ণ যুক্তিপূর্ণ। একটি দাবি হলো কুকিদের পৃথক প্রশাসনের এবং অন্যটি নাগাদের। সেই দাবি হলো ফ্রেমওয়ার্ক অ্যাগ্রিমেন্টের ভিত্তিতে মণিপুরে স্থায়ী শান্তির। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে এই বিষয়ে সুচিন্তিত পদক্ষেপ নিয়ে বিষয়গুলো বাস্তবায়নের অনুরোধ করা হচ্ছে। যৌক্তিক দাবিগুলোকে মেটানোর কথাও বলা হচ্ছে।
২০১৫ সালে এনএসসিএন-আইএম এবং ভারত সরকারের মধ্যে ফ্রেমওয়ার্ক অ্যাগ্রিমেন্ট সই হওয়ার পর বিজেপি সরকার ঘোষণা করেছিল, দীর্ঘদিন ধরে চলা বৃহত্তর নাগাল্যান্ড আন্দোলন ও বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজনীতি শেষে উত্তর-পূর্ব ভারতে শান্তি ফিরেছে। কিন্তু ২০২১ সালে নাগা-ভারত শান্তি আলোচনা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত হয়ে যায়। বলা হয়, ইস্টার্ন নাগাল্যান্ড স্টুডেন্টস অর্গানাইজেশন (ইএনএসও) এবং ইস্টার্ন নাগাল্যান্ড পিপলস অর্গানাইজেশন (ইএনপিও) নামে দুই সংগঠনের একটি পৃথক ‘সীমান্তবর্তী নাগাল্যান্ড’-এর দাবির কারণেই এই শান্তি আলোচনা স্থগিত হয়ে যায়। এনএসসিএন-আইএমের পৃথক পতাকা ও ভিন্ন সংবিধানের দাবি শান্তি আলোচনাকে স্থগিত করে দেয় বলে তখন মনে করা হয়।
হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) এনএসসিএন-আইএম-এর পৃথক পতাকা ও সংবিধানের দাবির প্রবল বিরোধিতা করে। অর্থাৎ নরেন্দ্র মোদির সরকার ফ্রেমওয়ার্ক অ্যাগ্রিমেন্টকে সফল বলে ঘোষণা করলেও আরএসএস এর বিরোধিতা করে।
এই ঘটনার দুই বছর পর মণিপুরের সহিংসতা চলাকালে ইউএনসি গণসমাবেশের আয়োজন করছে। তাতে সমর্থন দিয়েছে শীর্ষ কুকি সংগঠন। ইউএনসি বিবৃতিতে জানিয়েছে, বড় আকারেই এই সমাবেশ মণিপুরের প্রধানত নাগা–অধ্যুষিত জেলা তামেংলং, চান্দেল, উখরুলে করা হবে।
ইউএনসির সাধারণ সম্পাদক ভারেইয়ো শাতসাং বলেন, ফ্রেমওয়ার্ক অ্যাগ্রিমেন্টের চেতনায় দীর্ঘস্থায়ী ইন্দো-নাগা রাজনৈতিক সমস্যার প্রাথমিক আলোচনা এবং রাজনৈতিক মতবিনিময় নতুন করে শুরু করা হবে। নাগা অঞ্চলে ও সাধারণভাবে উত্তর-পূর্বে স্থায়ী শান্তির জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে সমাবেশের মাধ্যমে আবেদন জানানো হবে।
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, মণিপুরের নাগা সামাজিক সংগঠন ইউএনসির এই সমাবেশ করলেও রাজনৈতিক স্তরে রাজ্যের বীরেন সিংয়ের নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকারকে এখনো সমর্থন দিচ্ছেন নাগা বিধায়কেরা। ৬০ সদস্যের মণিপুর বিধানসভায় নাগা পিপলস ফ্রন্টের (এনপিএফ) ৫ এমএলএ এখনো সমর্থন করছেন বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকারকে। রোববার দুই কুকি বিধায়ক জোট ছেড়ে বেরিয়ে এসেছেন।