ওয়াক্ফ নিয়ে আদালতে মুসলিম সংগঠনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, নীতীশের দল ছাড়ছেন মুসলিম নেতারা
ভারতে ওয়াক্ফ বিল পাস হতে না হতেই সুপ্রিম কোর্টে দায়ের হলো মামলা। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি মুসলিম সংগঠন থেকেই মামলা করার ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে অল ইন্ডিয়া মুসলিম পারসোনাল ল বোর্ড জানিয়েছে, এই আইনের বিরুদ্ধে তারা দেশজুড়ে আন্দোলন শুরু করবে।
ওয়াক্ফ বিল সমর্থন করায় বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের দল জেডিইউতে ভাঙন দেখা দিয়েছে। গত দুই দিনে ৫ নেতা দল ত্যাগ করেছেন। ওই ৫ নেতার মধ্যে ৪ জন মুসলিম হলেও একজন হিন্দু। রাজু নায়ার নামে ওই হিন্দু নেতা তাঁর পদত্যাগপত্রে লিখেছেন, ‘দলের ভূমিকায় আমি হতাশ। এটি আরেক কালা আইন। মুসলিমদের ওপর অত্যাচার ও অবিচার এতে আরও বাড়বে।’
বিহারে জেডিইউতে অসন্তোষ আগামী দিনে ঘোরাল হয়ে উঠতে পারে। এই বছরের শেষে ওই রাজ্যে বিধানসভার ভোট। জেডিইউ মুসলিম ভোট না পেলে তা নিশ্চিতই বিরোধী শিবিরে জমা পড়বে। তাতে বিজেপির ক্ষতি কতটা হতে পারে, সেই ভাবনা রাজ্যের শাসক দলের মধ্যে রয়েছে।
বিজেপি অবশ্য বারবার বলতে চাইছে, এই আইন মুসলিমদের ধর্মাচরণে বাধা হবে না। এই আইন মুসলিম সমাজের মঙ্গলের জন্যই করা।
বিরোধীদের উৎসাহ ও জেডিইউতে অসন্তোষের পাশাপাশি কোমর কষতে শুরু করেছে বিজেপি। উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের সরকার ইতিমধ্যেই নির্দেশ দিয়েছে, যেসব সম্পত্তি ওয়াক্ফ আইন হওয়ার আগে নথিভুক্ত করা হয়নি, তার তালিকা প্রস্তুত করতে।
ওয়াক্ফ (সংশোধনী) বিলের ওপর ভোটাভুটির সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অবস্থান স্পষ্টতর হয়েছে। যেসব দল এত দিন এনডিএতে যোগ না দিয়েও বিজেপি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারকে সমর্থন করছিল, তাদের অবস্থান বদলেছে। বিজু জনতা দল ও ওয়াইএসআর কংগ্রেস দলবদ্ধভাবে মোদি সরকারের এই উদ্যোগকে সমর্থন করেনি। দুই দলের কেউ কেউ সরকারকে সমর্থন করলেও অনেকেই ওয়াক্ফ বিলের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন। এই দুই দল সংসদের কোনো কক্ষে দলীয় সদস্যদের হুইপ দেয়নি। দুই দলই সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা সদস্যদের ওপরেই ছেড়ে দিয়েছিল।
এই বিল একদিকে যেমন নতুন এক মেরুকরণের সম্ভাবনা জাগিয়ে তুলেছে তেমনই ছাড়া ছাড়া ‘ইন্ডিয়া’ জোটকে ঐকবদ্ধ করে দিয়েছে। কোনো একটি ইস্যুতে ‘ইন্ডিয়া’ এভাবে আগে জোটবদ্ধ হয়নি। আগামী দিনে এই সংঘবদ্ধতার পরিণতি কী হতে পারে, সে দিকে বিরোধীদের সতর্ক দৃষ্টি রয়েছে। একই রকম বিজেপি দেখতে আগ্রহী, এই আইন ধর্মীয় মেরুকরণকে আরও দৃঢ় করে কি না।
তবে আপাতত সবার দৃষ্টি সুপ্রিম কোর্টে। গত বুধবার লোকসভা ও বৃহস্পতিবার রাজ্যসভায় বিলটি পাস হওয়ার পর শুক্রবারেই কংগ্রেস জানিয়ে দেয়, তারা সুপ্রিম কোর্টে মামলা দায়ের করবে। সেই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই লোকসভার দলীয় নেতা মহম্মদ জাভেদ সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন। একই দিনে মামলা করেন এআইএমআইএম নেতা ও সংসদ সদস্য আসাউদ্দিন ওয়েইসি। তাঁরা দুজনেই ওয়াক্ফ বিল নিয়ে গঠিত সংসদের যৌথ কমিটির (জেডিসি) সদস্য ছিলেন।
জাভেদ তাঁর আবেদনে বলেছেন, হিন্দু ও শিখদের ধর্মীয় ট্রাস্ট স্বনিয়ন্ত্রিত, অথচ ওয়াক্ফে সরকার সরাসরি হস্তক্ষেপ করছে। অমুসলিমদের সদস্য করা হচ্ছে। এই রীতি অন্য ধর্মের ক্ষেত্রে কিন্তু নেই।
ওয়েইসি ও জাভেদ সুপ্রিম কোর্টে যে মামলা করেছেন তাতে বলা হয়েছে, এই আইন বৈষম্যমূলক। এই আইনে মুসলিমদের মৌলিক অধিকার হরণ করা হয়েছে। সংবিধানের ১৪ অনুচ্ছেদ সমতার অধিকার দিয়েছে। এই আইন তা হরণ করেছে।
দুজনের মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, সংবিধানের ২৫ অনুচ্ছেদ দিয়েছে ধর্মাচরণের স্বাধীনতা। ২৬ অনুচ্ছেদ ধর্মীয় বিষয় পরিচালনার স্বাধীনতা। ২৯তম অনুচ্ছেদে রয়েছে সংখ্যালঘুদের অধিকার এবং ৩০তম অনুচ্ছেদ দিয়েছে সম্পত্তির অধিকার। এই আইন প্রতিটি সাংবিধানিক অধিকারই লঙ্ঘন করছে। তাই এই আইন অসাংবিধানিক।
অল ইন্ডিয়া মুসলিম পারসোনাল ল বোর্ডও জানিয়েছে, তারা সুপ্রিম কোর্টে এই আইন চ্যালেঞ্জ করবে। তারা ইতিমধ্যেই রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার আবেদন জানিয়েছে। বলেছে, রাষ্ট্রপতি সই করার আগে তাঁকে তারা বোঝাতে চায়, কেন এই বিল সংবিধানবিরোধী এবং কেন তাঁর সম্মতি দেওয়া উচিত হবে না।
কংগ্রেসের মুখপাত্র জয়রাম রমেশ জানিয়েছেন, বিভিন্ন সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কংগ্রেস সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছে। যেমন ২০১৯ সালে মামলা করেছে সিএএর বিরুদ্ধে। সেই মামলার এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। তথ্যের অধিকার আইনে সংশোধনী আনার বিরুদ্ধেও কংগ্রেস মামলা করেছে, তা এখনো চলছে।
জয়রাম রমেশ আরও বলেন, ১৯৯১ সালে উপাসনালয়ের চরিত্র অক্ষুণ্ন রাখতে কংগ্রেস সরকারই আইন করেছিল। সেই আইনের চরিত্র যাতে অটুট থাকে, সে জন্যও কংগ্রেস সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছে। সেই ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন রেখে কংগ্রেস ওয়াক্ফ আইনকেও চ্যালেঞ্জ জানাবে।