ভারত-কানাডা বিবাদের কেন্দ্রেও ‘গ্যাংস্টার’ লরেন্স বিষ্ণোই
কানাডায় ২০২৩ সালে শিখ নেতা হরদীপ সিং নিজ্জর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ভারতের আলোচিত লরেন্স বিষ্ণোইয়ের গ্যাং জড়িত। গত সোমবার কানাডার পুলিশ এ দাবি করে। এমন একসময়ে এ দাবি করা হলো, যখন ওই ঘটনায় ভারত সরকারের জড়িত থাকা নিয়ে কানাডার নতুন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে দুই দেশের সম্পর্ক চলতি সপ্তাহে নজিরবিহীনভাবে তলানিতে এসে ঠেকেছে। এরপর উভয় দেশ পরস্পরের ছয়জন করে কূটনীতিক বহিষ্কার করেছে।
রয়্যাল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশ (আরসিএমপি) শিখ নেতা হরদীপ সিং নিজ্জর হত্যার তদন্ত করছে। তাদের অভিযোগ, ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর পক্ষে ‘বিষ্ণোই দল (গ্যাং)’ নিজ্জর হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন করেছিল।
ভারতের কুখ্যাত গ্যাংয়ের নেতা লরেন্স বিষ্ণোই বর্তমানে আহমেদাবাদের সবরমতি কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী রয়েছেন। আহমেদাবাদ গুজরাটের একটি শহর। এটি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নিজের রাজ্য। রাজ্যের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী তাঁর দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি)।
এসব কারণে লরেন্স বিষ্ণোইকে নিয়ে নতুন করে আগ্রহ তৈরি হয়েছে। কারাগার থেকে তিনি কীভাবে গ্যাং পরিচালনা করছেন, তা নিয়েও কৌতূহল তৈরি হয়েছে। দুটি গণতান্ত্রিক দেশের মধ্যে ঐতিহাসিকভাবে গভীর সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও একজন গ্যাং নেতা একটি গুরুতর ভূরাজনৈতিক সংকটে কীভাবে জায়গা করে নিলেন, সেটা নিয়েও চলছে নানা বিশ্লেষণ।
পাঞ্জাব থেকে মুম্বাইয়ে
৩১ বছর বয়সী লরেন্স বিষ্ণোই জাতীয়ভাবে প্রথমবার পরিচিতি পান ২০২২ সালে। ওই বছরের ২৯ মে পাঞ্জাবের জনপ্রিয় গায়ক ও দেশটির প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের সদস্য সিধু মুসওয়ালাকে হত্যা করা হয়। লরেন্সের সহযোগীরা মুসওয়ালাকে হত্যার দায় স্বীকার করেন।
এদিকে গত শনিবার রাতে মুম্বাইয়ের অভিজাত এলাকা বান্দ্রায় ৬৬ বয়সী রাজনীতিবিদ ও রাজ্যের সাবেক মন্ত্রী বাবা সিদ্দিক আততায়ীর গুলিতে নিহত হন। এ হত্যাকাণ্ডের দায়ও স্বীকার করেছে বিষ্ণোই গ্যাং।
বাবা সিদ্দিকের সঙ্গে বলিউডের বিখ্যাত তারকাদের সখ্য সুপরিচিত। বিশেষ করে অভিনেতা সালমান খানের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা বেশ আলোচিত। বিষ্ণোইয়ের এক সহযোগী ফেসবুকের এক পোস্টে সিদ্দিককে হত্যার দায় স্বীকার করে লিখেন, ‘কারও সঙ্গে আমাদের কোনো শত্রুতা নেই। কিন্তু সালমান খানকে যেই সহায়তা করে তাঁর কথা ভিন্ন...।’
বিষ্ণোইয়ের সঙ্গে সালমান খানের দ্বন্দ্ব প্রায় ২৬ বছরের পুরোনো একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে। ১৯৯৮ সালে রাজস্থানে একটি চলচ্চিত্রের শুটিংয়ে গিয়ে বিনোদনমূলক শিকারে বেরিয়েছিলেন সালমান। তখন তিনি দুটি বিরল প্রজাতির কালো হরিণ শিকার করেছিলেন। বিষ্ণোই সম্প্রদায়ের মানুষ এই প্রজাতির হরিণকে অত্যন্ত পবিত্র বলে মনে করেন।
এ বছরের এপ্রিলে মুম্বাইয়ে সালমানের বাসায় গুলি করার ঘটনায় বিষ্ণোই গ্যাংয়ের দুই সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়।
‘হু কিলড মুসওয়ালা?’ বইয়ের লেখক জুপিন্দরজিৎ সিং আল–জাজিরাকে বলেন, গ্যাং নেতাদের কাছে নাম (পরিচিতি) ও নাম নিয়ে আতঙ্কই সব কিছু।
এই লেখক উত্তর ভারতে গ্যাং সংঘাতের প্রায় এক দশকের ঘটনাবলি পর্যালোচনা করে দেখেছেন। তিনি বলেন, ‘লরেন্স প্রায় সময় বলতেন, “আমার বড় কিছু করা উচিত।” মুসওয়ালাকে হত্যা করার পর সালমান খানকে আক্রমণ করা এবং এখন বাবা সিদ্দিককে হত্যা করাই তাঁর সেই বড় কাজ। এসব হামলা তাঁর নামে ব্র্যান্ডমূল্য যোগ করেছেন। এসব হামলা (গ্যাংটির দাবি করার মতো) চাঁদাবাজি ও মুক্তিপণের পরিমাণ বহুগুণ বাড়াচ্ছে।’
কানাডায় শিখ নেতাকে হত্যা করার সঙ্গে বিষ্ণোই গ্যাংয়ের যুক্ত থাকার বিষয়ে কানাডা সরকারের দাবি ইতিমধ্যে তাদের ব্র্যান্ডমূল্য বাড়িয়েছে বলে মনে করেন জুপিন্দরজিৎ সিং। তাঁর মতে, এতে গ্যাংয়ের গণসংযোগের বিজয় হয়েছে।
জুপিন্দরজিৎ সিং বলেন, শেষ পর্যন্ত এতে লরেন্সেরই জয় হয়েছে। যে নাম (পরিচিতি) তিনি চেয়েছিলেন, তিনি তা পাচ্ছেন। লরেন্সের মতো মানুষেরা বন্দুক নিয়ে বাঁচেন আর তাঁরা মরেনও বন্দুক নিয়ে।
‘আমিই বিশেষ’ প্রবণতা
লরেন্স বিষ্ণোই ১৯৯৩ সালে পাকিস্তান সীমান্তের শিখ–অধ্যুষিত পাঞ্জাব রাজ্যে জন্মগ্রহণ করেন। জুপিন্দরজিৎ সিং তাঁর গবেষণার কাজে লরেন্স বিষ্ণোইয়ের স্নাতক পাস মা সুনিতার সঙ্গে দেখা করেছিলেন। তখন তিনি এই লেখককে জানিয়েছিলেন, বিষ্ণোইয়ের গায়ের রং ব্যতিক্রমী রকমের ফরসা, যাকে প্রায় গোলাপি বর্ণ বলা যায়। তাঁকে দেখতে ভারতীয়র চেয়ে ঢের বেশি ইউরোপীয় মনে হয়।
উত্তর ভারতে বিষ্ণোই সম্প্রদায়ে লরেন্স নামটা এতটা প্রচলিত নয়। ব্রিটিশ শিক্ষাবিদ ও প্রশাসক হেনরি লরেন্সের নাম থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে সেখানকার মানুষ এ নাম রাখেন। ঔপনিবেশিক আমলে হেনরি লরেন্স পাঞ্জাবে কর্মরত ছিলেন।
লরেন্স বিষ্ণোইয়ের পরিবার অবস্থাপন্ন। পাঞ্জাবের দত্তরানওয়ালি গ্রামে তাঁর পরিবারের ১০০ একরের বেশি কৃষিজমি রয়েছে। উচ্চ মাধ্যমিক শেষে আইন নিয়ে পড়ার জন্য পাঞ্জাবের রাজধানী চণ্ডীগড় যান লরেন্স।
চণ্ডীগড়ের ডিএভি কলেজে পড়ার সময় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন লরেন্স। বলা হয়ে থাকে, ওই সময়ে অপরাধজগতে জড়িয়ে পড়েন তিনি। লরেন্স কলেজটির শিক্ষার্থীদের সংগঠনের প্রেসিডেন্টের দায়িত্বও পালন করেন।
একপর্যায়ে অগ্নিসংযোগ ও খুনের চেষ্টার অভিযোগে লরেন্সকে গ্রেপ্তার করে চণ্ডীগড়ের কারাগারে পাঠানো হয়েছিল। এ সময় কারাগারে বন্দী অন্যান্য গ্যাং নেতাদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। তাঁরা লরেন্সের ওপর প্রভাব বিস্তার করেন।
কলেজজীবন থেকে লরেন্সের উত্থান নিয়ে গবেষণাকারী জুপিন্দরজিৎ সিং বলেন, গ্যাং নেতারা ‘অবস্থাপন্ন ও ভালো পরিবার’ থেকে জন্ম নেন বলে পাঞ্জাবে একটি ধারণা প্রচলিত আছে। তাঁদের সবার মধ্যে সাধারণ একটি প্রবণতা দেখা যায়। সেটি হলো, ‘আমিই বিশেষ’।
এই লেখকের মতে, এসব তরুণ শহরে আসার পর ‘একটি অভিজাত ও বুদ্ধিজীবী মহলের’ মুখোমুখি হয়ে অনুধাবন করতে শুরু করেন যে তাঁরা আর জমিদার নন। এ পরিস্থিতিতে অপরাধে জড়ানোটা তাঁদের নিজেদের বিশ্বাস নিজেদের কাছে আবার দৃঢ় করার একটি উপায় বলে মনে করেন জুপিন্দরজিৎ সিং।
এসব পটভূমির কারণে কানাডা সরকার বিষ্ণোই গ্যাংকে ‘ভারতের এজেন্ট’ বলে উল্লেখ করা প্রসঙ্গে জুপিন্দরজিৎ সিং বলেন, ‘আমি আন্তরিকভাবে চাই এ খবর অসত্য হোক। কারণ, এটা সত্য হলে লরেন্স তরুণদের এমন একটি অংশের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারবেন, যারা দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে।’