মুকেশ আম্বানির সম্পদের উত্তরাধিকার কে কীভাবে পাবেন
এশিয়ার শীর্ষ ধনী ও ভারতের রিলায়েন্স গ্রুপের চেয়ারম্যান মুকেশ আম্বানি তাঁর সম্পদের উত্তরাধিকার নকশায় তিন সন্তানের নির্দিষ্ট ভূমিকা ঘোষণা করেছেন। মুকেশ আম্বানি চান তাঁর বিশাল এই সম্পদ এখন থেকে সামলাবে তাঁরই তিন সন্তান। এ কারণে গত আগস্ট মাসে রিলায়েন্স গ্রুপের সাধারণ সভায় তিন সন্তানের কাছে তাঁদের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন মুকেশ। বিবিসি অনলাইনের প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়েছে।
মুকেশ আম্বানির বড় দুই সন্তান আকাশ ও ইশা আম্বানি যমজ। সম্পদের উত্তরাধিকার নকশা অনুযায়ী, আকাশ ও ইশা সামলাবেন রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের টেলিকমিউনিকেশন ও রিটেইল ব্যবসা। আর ছোট ছেলে অনন্ত আম্বানি সামলাবেন জ্বালানি ব্যবসা। অনন্ত ইতিমধ্যে জ্বালানি ব্যবসা সামলানোর কাজ শিখছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতের করপোরেট ব্যবসার ক্ষেত্রে রিলায়েন্সের এই উত্তরাধিকার বণ্টন একটি প্রত্যাশিত ঘটনা। এ নিয়ে মানুষের আগ্রহেরও কোনো কমতি নেই। তাই অনেক দিন থেকেই মুকেশ আম্বানির সম্পদের ভাগাভাগি নিয়ে নানা গুঞ্জন ছড়িয়েছিল। এবার কিছুটা স্পষ্ট নকশা পাওয়া গেল।
অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতা এড়াতেই আগেভাগে মুকেশ তাঁর সম্পদের উত্তরাধিকার নকশা করে সম্পদ বণ্টনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কারণ, রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের প্রতিষ্ঠাতা ধীরুভাই আম্বানির মৃত্যুর আগে সম্পত্তির কোনো উইল করে যাননি। এ কারণে তাঁর দুই ছেলে মুকেশ ও অনিল আম্বানির মধ্যে পৈতৃক ব্যবসা নিয়ে বিরোধ শুরু হয়। এ নিয়ে আইনি লড়াইয়ে নামেন দুই ভাই। পরে অবশ্য দুই ভাইয়ের সম্পর্কের উন্নতি হয়। এসব ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়েছেন মুকেশ। নিজের সন্তানদের মধ্যে সম্পত্তি নিয়ে যেন কোনো বিরোধ না বাধে, এই ভাবনায় তিনি উত্তরাধিকার নকশা করার সিদ্ধান্ত নেন।
রিলায়েন্স গ্রুপে ইশা আম্বানিকে নেতৃত্বের পর্যায়ে নিয়ে আসাকে অনেকেই ইতিবাচকভাবে দেখছেন। দেশটিতে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে নেতৃত্বের পর্যায়ে নারীদের যাওয়ার খুব একটা নজির নেই। দুই দশক ধরে তা কেবল শুরু হয়েছে। ভাইদের সঙ্গে ইশার সমঅধিকারের বিষয়টি তাই একটা নজির হয়ে থাকবে। তবে বিশ্লেষকেরা বলছেন, মেয়েদের এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে আরও অনেক দূর যেতে হবে।
উত্তরাধিকার পরিকল্পনা
সন্তানদের সম্পদ ভাগ করে দিলেও এখনই অবসরে যাচ্ছেন না ৬৫ বছর বয়সী মুকেশ আম্বানি। তিনি আগের মতোই রিলায়েন্স গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে সক্রিয়ভাবে দায়িত্ব পালন করবেন। বরং দায়িত্ব ভাগ করে দিলেও সন্তানদের আরও দক্ষ হতে সময় দিতে চান তিনি।
ইন্ডিয়ান স্কুল অব বিজনেসের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা কাভিল রামচন্দ্রন বলেছেন, এশিয়ার পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অনেকেই শেষ পর্যন্ত নিজের সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে চান। এ ক্ষেত্রে মুকেশ আম্বানি ব্যতিক্রম। তাঁর এই উত্তরাধিকার পরিকল্পনা ইতিবাচক পদক্ষেপ।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাগুয়ার ও ল্যান্ড রোভারের মালিক টাটা গ্রুপ থেকে টেক্সটাইল ব্যবসায়ী পরিবার সিংহানিয়া, র্যামন্ড গ্রুপ ও ইন্ডিয়া ইনক্-এর মতো প্রতিষ্ঠানের পরিবারগুলোতে ধারাবাহিকভাবে উত্তরাধিকার নিয়ে বিরোধ ছিল। এগুলো নিয়ে মামলা ও দীর্ঘস্থায়ী সালিসি কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে, যা অংশীদারদের জন্য অনেক ব্যয়বহুল ছিল বলে প্রমাণিত হয়েছে।
তবে এশিয়ার ধনী পরিবারগুলোর মধ্যে আম্বানির পরিবার এ ক্ষেত্রে অনেকটাই লাজুক বলে বিশ্লেষকেরা মত দিয়েছেন।
এশিয়ার ওয়েলথ কনসালটিং ফার্ম হাবিসের তথ্য অনুযায়ী, কোভিড-১৯-এর প্রেক্ষাপটে আন্তঃপ্রজন্মীয় সম্পদ স্থানান্তরের বিষয়টি অনেক বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে।
লন্ডনভিত্তিক গ্লোবাল প্রোপার্টি কনসালট্যান্সি নাইট ফ্রাঙ্কের তথ্য বলছে, এশিয়ার যদিও অর্ধেকেরও কম পরিবারের সম্পত্তির উত্তরাধিকার পরিকল্পনা আছে। সেখানে করোনা মহামারি ভারতের ৮৪ শতাংশ অতিধনীকে তাদের সম্পদ কীভাবে বণ্টন করবে, তা পুনর্মূল্যায়ন করতে উত্সাহিত করেছে।
উত্তরাধিকার পরিকল্পনায় এখন নারীদের ভূমিকা সামনে চলে আসছে। তিন সন্তানের নেতৃত্বের ভূমিকার কথা বলতে গিয়ে মুকেশ আম্বানি বলেছেন, ‘তরুণ পেশাদার ও নেতৃত্ব হিসেবে তাঁরা সবাই সমান। তাঁরা ইতিমধ্যেই রিলায়েন্সে দারুণ কাজ করছেন।’
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইশা আম্বানির নেতৃত্বের পর্যায়ে আসাটা তাঁর ভাইদের পাশে সমঅধিকারের একটি উদাহরণ। এই রীতি আগে আম্বানি পরিবারে ছিল না। আম্বানি পরিবার বিভক্ত হওয়ার আগে নারীদের ব্যবসাক্ষেত্রে নেতৃত্বের স্থানে আনার পরিবর্তে অন্য কোনো বড় ব্যবসায়ী পরিবারে বিয়ে দেওয়া হতো। কিন্তু ইয়েল ইউনিভার্সিটির গ্র্যাজুয়েট ইশা এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। রিলায়েন্সের উত্তরাধিকারী হিসেবে নিজেকে প্রস্তুত করতে তিনি নামকরা কনসালটিং ফার্ম ম্যাককিনসিতে কাজ করেছেন।
অধ্যাপক কাভিল রামচন্দ্রন বলেন, উত্তরাধিকার দেওয়ার ক্ষেত্রে নারীদের পুরুষের সমান অধিকার দেওয়ার বিষয়টি একটি শক্তিশালী বার্তা। এর ইতিবাচক প্রভাব বাড়তে থাকবে।
এক দশকেরও বেশি সময় ধরে পরিবারের মালিকানাধীন করপোরেটদের উত্তরাধিকার পরিকল্পনার বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে আসা দ্য লিগ্যাসি প্ল্যানিং ফার্ম টেরেনশিয়ার প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক সন্দ্বীপ নিরলেকার বলেন, আম্বানি পরিবারের এটি একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। এরপর অন্য ব্যবসায়ী পরিবারগুলোও হয়তো একই কাজ করবে।
ইশা দেশটির পারিবারিক ব্যবসার জ্যেষ্ঠ নেতৃত্বের পর্যায়ে থাকা নতুন প্রজন্মের নারীদের একজন। তাঁর মতো পারিবারিক ব্যবসার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আছেন দেশটির প্রাচীন একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান নিসাবা গোদরেজ ও পার্ল অ্যাগ্রোর প্রধান নাদিয়া চৌহান।
এটা একটা বিশাল পরিবর্তন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পরিবর্তনের পেছনে বেশ কয়েকটি বিষয় কাজ করেছে। এর মধ্যে আছে—নারীদের উচ্চশিক্ষা এবং ঐতিহ্যবাহী যৌথ পরিবারগুলো একক পরিবারকে পথ দেখানো। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই। আর এই লড়াই সবে শুরু হয়েছে।
দেশটির সবচেয়ে বড় টেক্সটাইল কোম্পানি ওয়েলসপান ইন্ডিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) দীপালি গোয়েঙ্কা বলেন, ‘অন্য কিছু চিন্তা না করে এখন নারীরা নিজেদের অধিকার ও ক্ষমতা নিয়ে অনেক বেশি সোচ্চার হচ্ছেন।’
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, দীপালি গোয়েঙ্কা ১৮ বছর বয়সে বিয়ে করেন। সন্তান বড় হওয়ার পর তিনি স্বামীর ব্যবসার কাজে যোগ দেন। এরপর তিনি হার্ভার্ড বিজনেস স্কুল থেকে ম্যানেজমেন্টে পড়াশোনা করার সিদ্ধান্ত নেন। এখনো অনেক পথ তিনি পাড়ি দিতে চান।
টেরেনশিয়ার একটি গবেষণার বরাত দিয়ে সন্দ্বীপ নিরলেকার বলেন, ভারতে প্রতি ১০টি পরিবারের মধ্যে ৮টি পরিবারই সম্পত্তির উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে পুরুষদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করে। এমনকি ছেলে ও মেয়েদের সম্পত্তি বণ্টনও এখানে বৈষম্যমূলক।