পশ্চিমা বিশ্ব থেকে মুসলিম বিশ্ব—সর্বত্র ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাত নিয়ে বিক্ষোভ-সমাবেশ হচ্ছে। গাজায় ইসরায়েলি হামলা বন্ধের দাবিতে দেশে দেশে বিক্ষোভে রাস্তায় নামছেন লাখ লাখ মানুষ। কিন্তু ফিলিস্তিনের পক্ষে সব সময় উচ্ছ্বকিত ভারতের কাশ্মীর বিস্ময়করভাবে শান্ত।
ভারত কর্তৃপক্ষ মুসলিম-অধ্যষিত কাশ্মীরে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে বিক্ষোভ-সমাবেশ করতে দিচ্ছে না। জুমার দিন খুতবায় ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাত নিয়ে কোনো ধরনের বক্তব্য না দিতেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কাশ্মীরের বাসিন্দা ও মুসলিম ধর্মীয় নেতারা বার্তা সংস্থা এপিকে এমনই বলছেন।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, কাশ্মীরে কোনো ধরনের বিক্ষোভ সমাবেশ যাতে দানা বাঁধতে না পারে, নয়াদিল্লির সরাসরি শাসন অবসানের দাবি যাতে কাশ্মীরের মানুষ আওয়াজ তুলতে না পারে, সে জন্য কেন্দ্রীয় সরকার যেকোনো ধরনের বিক্ষোভ-সমাবেশে বিধিনেষেধ আরোপ করেছে। আবার নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর ফিলিস্তিন ইস্যুতে ভারতের দীর্ঘদিনের পররাষ্ট্রনীতির বদল ঘটিয়েছে।
বিরোধীদের শাসিত কয়েকটি রাজ্যে ফিলিস্তিনের পক্ষে আয়োজিত বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে অনেককে আটক করা হয়েছে। একমাত্র বামপন্থী সরকার–নিয়ন্ত্রিত কেরালা রাজ্যে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে বিক্ষোভ করা গেছে।
ভারত দীর্ঘদিন ধরে মধ্যপ্রাচ্যের বিবদমান দুই পক্ষের মধ্যে একধরনের নিরপেক্ষ নীতি মেনে চলছিল। ঐতিহাসিকভাবে দুই দেশের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখেছিল। কিন্তু ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলার পরপরই কড়া নিন্দা জানিয়ে বসল ভারত। একই সঙ্গে ইসরায়েলের প্রতি সংহতি জানিয়েছে তারা। গাজায় ইসরায়েলি হামলায় বিপুলসংখ্যক বেসামরিক নাগরিক নিহতের ঘটনায় মোদি সরকার দায়সারা গোছের বিবৃতি দিয়েছে, যাতে গাজায় আন্তর্জাতিক মানবিক আইন সমুন্নত রাখার আহ্বান জানানো হয়েছে।
কাশ্মীর নীরব থাকা অনেকের কাছে বেদনার
মুসলিম ধর্মীয় নেতা মিরওয়াইজ ওমর ফারুক বলেন, ‘মুসলমানদের দৃষ্টিতে দেখলে, ফিলিস্তিনিরা আমাদের খুবই প্রিয়। তাঁদের ওপর দমন–পীড়নের বিরুদ্ধে আমাদের কণ্ঠকে উচ্চকিত করা জরুরি। কিন্তু আমাদের জোর করে স্তব্ধ করে রাখা হচ্ছে।’
ওমর ফারুক বলেন, ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাত শুরুর পর থেকে প্রতি শুক্রবার এই অঞ্চলের প্রধান মসজিদে তাঁকে ইমামতি করতে দেওয়া হচ্ছে না। এ জন্য তাঁকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছে।
পুলিশ প্রথমে আমাদের মসজিদের ভেতরে ইসরায়েলি নৃশংসতার নিন্দা জানানোর অনুমতি দিয়েছিল। কিন্তু গত শুক্রবার তারা বলেছে, মসজিদের ভেতরে ফিলিস্তিন নিয়ে কোনো কথা বলা যাবে না
এই হিমালয় অঞ্চলে ভারতবিরোধী মনোভাব দিন দিন প্রকট হচ্ছে। কাশ্মীরের একাংশ ভারত ও আরেক অঞ্চল পাকিস্তান নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। ২০১৯ সালে মোদি সরকার জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নেয়। কেন্দ্রীয় সরকার ভিন্ন মতাবলম্বী, নাগরিক ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ শুরু করে।
কাশ্মীরের জনগণ দীর্ঘদিন ধরে ফিলিস্তিনিদের প্রতি গভীর সংহতি জানিয়ে আসছে। গাজায় এর আগে যেকোনো সংঘাতে তারা ইসরায়েলবিরোধী বিরাট বিক্ষোভ করেছে। ওই সব বিক্ষোভকারী একই সঙ্গে কাশ্মীরে ভারতের শাসনের অবসান দাবি করে স্লোগান দিতো, যাতে সংঘাত ছড়িয়ে পড়ত। এতে হতাহতের ঘটনাও ঘটত।
হামাসের হামলার পর ইসরায়েলের পক্ষে বিশ্বনেতাদের মধ্যে যাঁরা দ্রুত ইসরায়েলের প্রতি সংহতি জানিয়েছেন, হিন্দুত্ববাদী প্রধানমন্ত্রী মোদি তাঁদের অন্যতম। তিনি হামাসের হামলাকে ‘সন্ত্রাসবাদী’ হামলা বলে উল্লেখ করেছেন। অবশ্য ১২ অক্টোবর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি বিবৃতি দেয় যাতে ‘সার্বভৌম, স্বাধীন ও কার্যকর’ ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে ভারতের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করা হয়, যেখানে নিরাপদ ও সীমান্ত স্বীকৃতির মাধ্যমে ইসরায়েলের পাশে ফিলিস্তিনি জনগণ শান্তিতে বসবাস করতে পারবে।
ঠিক এর দুই সপ্তাহ পর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গাজায় মানবিক যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে ভারত ভোটদান থেকে বিরত থাকল। ভারতের এ ভূমিকা ফিলিস্তিন ইস্যুতে তাদের অতীতের অবস্থানের বিপরীত। নয়াদিল্লি ভোটদানে বিরত থাকার পক্ষে যুক্তি দেখাল, প্রস্তাবে ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার নিন্দা জানানো হয়নি।
উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, ‘ভারতের এ ভূমিকা অস্বাভাবিক।’
ভারতের অভ্যন্তরে এ যুদ্ধের প্রভাব পড়তে পারে। কারণ, এ দেশে বিপুল মুসলিম জনগোষ্ঠী রয়েছে। হিন্দু–অধ্যুষিত দেশটিতে প্রায় ২০ কোটি মুসলমানের বসবাস, যারা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে সবচেয়ে বড়
কুগেলম্যান বলেন, হামাসকে উৎখাতের নামে গাজায় ইসরায়েলের হামলাকে ভারত সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান হিসেবে দেখে থাকে। তাদের ভাষ্য, এসব অভিযানে ফিলিস্তিনের বেসমারিক নাগরিকদের লক্ষ্যবস্তু করা হয় না। গাজায় হামলার ব্যাপারে ইসরায়েলের দৃষ্টিভঙ্গি ঠিক এটাই। কুগেলম্যান আরও বলেন, ভারতের দৃষ্টিতে মানবিক বিরতির জন্য এমন অভিযান বন্ধ করা যায় না।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর তাঁর দেশের ভোটদানে বিরত থাকার বিষয়টি যৌক্তিক হিসেবে তুলে ধরতে চান। তিনি গত শনিবার নয়াদিল্লিতে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘এটা কেবল সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি নয়। আপনি গড়পড়তা ভারতীয় নাগরিককে জিজ্ঞেস করুন, সন্ত্রাসবাদ মানুষের মনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। আমাদের মতো খুব কম দেশই সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা করছে।’
যদিও মোদির সরকার গাজার অবরুদ্ধ নাগরিকদের জন্য মানবিক সহায়তা পাঠিয়েছে, তবু অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন, আদর্শিকভাবে এ সরকার ইসরায়েলের প্রতি একাত্ম। এই মাসে অনুষ্ঠেয় কয়েকটি রাজ্যের বিধান সভার নির্বাচন এবং আগামী বছর অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনে ইসরায়েলের পক্ষে অবস্থানের সুফল নিতে চায় মোদির বিজেপি।
ইসরায়েলের প্রতি ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদী নাগরিকদের সমর্থনের বিষয়টি মাথায় রেখে মোদি সরকার ফিলিস্তিন-ইসরায়েল ইস্যুতে অবস্থান বদলেছে। এই হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের ভোট বিজেপির বাক্সেই বেশি পড়ে থাকে। ইসরায়েল থেকে ভারতের টেলিভিশন চ্যানেলের পরিবেশিত খবরেও মোদি সরকারের অবস্থানের প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে। হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মুসলিমবিরোধী প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন, যা ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবরে এসেছে। তাদের এ প্রচার মোদি সরকারকে আরও বেশি সুবিধা দিচ্ছে।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক প্রাভিন দোন্থি বলেন, ভারতের অভ্যন্তরে এ যুদ্ধের প্রভাব পড়তে পারে। কারণ, এ দেশে বিপুল মুসলিম জনগোষ্ঠী রয়েছে। হিন্দু–অধ্যুষিত দেশটিতে প্রায় ২০ কোটি মুসলমানের বসবাস, যারা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে সবচেয়ে বড়।
প্রাভিন বলেন, ‘ভারতের পররাষ্ট্রনীতি ও অভ্যন্তরীণ রাজনীতি একই রেখায় মিশে গেছে। ইসরায়েলের পক্ষে নয়াদিল্লির অবস্থান ভারতের কট্টর হিন্দুত্ববাদীদের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন, যাদের নিয়মিত কাজ হচ্ছে মুসলিমদের লক্ষবস্তু করা।’
ভারত ঐতিহাসিকভাবে ফিলিস্তিনের পক্ষে
১৯৪৭ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে জাতিসংঘে উত্থাপিত প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দিয়েছিল ভারত। ১৯৭০-এর দশকে আরব দেশগুলোর বাইরে ভারতই প্রথম ফিলিস্তিনি স্বাধীনতা সংগঠনকে (পিএলও) ফিলিস্তিনের প্রতিনিধি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। ১৯৮০-এর দশকে ভারত ফিলিস্তিনকে পূর্ণ কূটনীতিকের মর্যাদা দিয়েছিল।
পিএলও ইসরায়েলের সঙ্গে সংলাপ শুরুর পর ১৯৯২ সালে ভারত চূড়ান্তভাবে ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলে। কাশ্মীর নিয়ে ১৯৯৯ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে সীমিত যুদ্ধের সময় এ সম্পর্ক নিরাপত্তা সম্পর্কে বিস্তৃত হয়। তখন ইসরায়েল ভারতকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ দিয়ে সহায়তা করে। এরপর বিগত বছরগুলোতে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় হয়েছে। এখন তো রাশিয়ার পর ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ হচ্ছে ইসরায়েল।
২০১৪ সালে মোদি জয়ী হওয়ার পর তিনিই প্রথম ভারতের প্রধানমন্ত্রী, যিনি ২০১৭ সালে ইসরায়েল সফরে যান। পরের বছর ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু নয়াদিল্লি সফরে আসেন। তিনি সম্পর্কে মাত্রা বোঝাতে গিয়ে নয়াদিল্লি ও তেল আবিবের ‘স্বর্গীয় সম্পর্ক’ বলে উল্লেখ করেছিলেন।
নেতানিয়াহুর সফরের কয়েক সপ্তাহ পর মোদি প্রথম ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পশ্চিম তীরের ইসরায়েল অধিকৃত রামাল্লা সফরে যান। সেখানে তিনি ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেই বৈঠকে মোদি বলেছিলেন, ‘ভারত আশা করে, শান্তিপূর্ণ উপায়ে ফিলিস্তিন শিগগিরই একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে।’
মোদির সমালোচকেরা এখন তাঁর ও ইসরায়েল সরকারের মধ্যে তুলনা করে বলছেন, ইসরায়েলের মতো মোদি সরকারও সংখ্যালঘু মুসলমানদের বিরুদ্ধে ‘গোষ্ঠীগত শাস্তির’ নীতি নিয়েছে। তারাও মুসলমানদের ঘরবাড়ি ও সম্পদ ধুলায় মিশিয়ে দিচ্ছে।
ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাত শুরুর পর এমনকি কাশ্মীরের বাইরে অন্যান্য রাজ্যেও ভারত সরকার ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি জানিয়ে বিক্ষোভ সমাবেশ বন্ধ করে দিয়েছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অজুহাত দেখিয়ে তারা কোনো কর্মসূচি পালন করতে দিচ্ছে না।
বিরোধীদের শাসিত কয়েকটি রাজ্যে ফিলিস্তিনের পক্ষে আয়োজিত বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে অনেককে আটক করা হয়েছে। একমাত্র বামপন্থী সরকার–নিয়ন্ত্রিত কেরালা রাজ্যে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে বিক্ষোভ করা গেছে।
তবে কাশ্মীরে জোরপূর্বক মানুষকে স্তব্ধ করে রাখা শুধু মতপ্রকাশের স্বাধীনতার লঙ্ঘন নয়, বরং ধর্মীয় দায়িত্ব পালনে বাধা দেওয়ার শামিল।
কাশ্মীরের ধর্মীয় নেতা আগা সাইদ মোহাম্মদ হাদি বলছিলেন, গত তিনটি জুমায় তিনি মসজিদে নামাজ পড়াতে পারেননি। তখন থেকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছে। তিনি বলেন, তিনি ‘ইসরায়েলের নগ্ন আগ্রাসনের’ বিরুদ্ধে বিক্ষোভে অংশ নিতে চেয়েছিলেন।
ভারতীয় কর্তৃপক্ষ অবশ্য এ ধরনের গৃহবন্দী করার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।
হাদি বলেন, ‘পুলিশ প্রথমে আমাদের মসজিদের ভেতরে ইসরায়েলি নৃশংসতার নিন্দা জানানোর অনুমতি দিয়েছিল। কিন্তু গত শুক্রবার তারা বলেছে, মসজিদের ভেতরে ফিলিস্তিন নিয়ে কোনো কথা বলা যাবে না।’
হাদি বলেন, ‘তারা আমাদের বলেছে, আমরা কেবল ফিলিস্তিনের জন্য প্রার্থনা করতে পারব। তা–ও আবার স্থানীয় কাশ্মীরি ভাষায় দোয়া করা যাবে না, করতে হবে আরবি ভাষায়।’