শুধু মোদির আকর্ষণ আর হিন্দুত্ববাদ দিয়ে লোকসভা নির্বাচন জেতা যাবে না: আরএসএসের পত্রিকা
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জনমোহিনী চরিত্র বা হিন্দুত্ববাদী আদর্শ যে ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচন জেতার জন্য যথেষ্ট নয়, তা জানাল হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগঠন আরএসএসের (রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ) পত্রিকা ‘অর্গানাইজার’। গত মে মাসের শেষে পত্রিকার সম্পাদক প্রফুল্ল কেতকর এক কলামে লিখেছেন, কর্ণাটক নির্বাচনে হারের পরে ২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচন নিয়ে মতবিনিময় জরুরি।
এ প্রসঙ্গে প্রফুল্ল কেতকর লিখছেন, ‘পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করার জন্য বিজেপির পক্ষে এটাই সঠিক সময়। দৃঢ় নেতৃত্ব এবং আঞ্চলিক স্তরে কাজ ছাড়া শুধু প্রধানমন্ত্রী (নরেন্দ্র) মোদির জন-আকর্ষণী ক্ষমতা (ক্যারিশমা) এবং হিন্দুত্ববাদের আদর্শ দিয়ে কাজ হবে না।’
১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত ইংরেজি পত্রিকাটির সম্পাদকদের মধ্যে ছিলেন ভারতের সাবেক উপপ্রধানমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আদভানি, আরএসএসের জাতীয় স্তরের জ্যেষ্ঠ নেতা কে আর মালকানি থেকে শেষাদ্রী চারি প্রমুখ। মনে করা হয়, ‘অর্গানাইজার’ আরএসএসএর চিন্তাভাবনাকেই প্রকাশ্যে আনে।
‘কর্ণাটক নির্বাচন: অভ্যন্তরীণ বিশ্লেষণের সঠিক সময়’ শীর্ষক মতামতে প্রফুল্ল কেতকর নিরপেক্ষ ভঙ্গিতে কর্ণাটকে বিজেপির পরাজয়ের কারণ বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘(২০১৪ সালে) প্রধানমন্ত্রী মোদি কেন্দ্রে দায়িত্ব নেওয়ার পর এই প্রথম একটি রাজ্যের নির্বাচনে বিজেপিকে দুর্নীতির প্রশ্নে আত্মপক্ষ সমর্থন করে বক্তব্য দিতে হলো।
পাশাপাশি ক্ষমতাসীন দলকে (বিজেপি) জাতীয় স্তরে তার কর্মসূচির ব্যাখ্যা দিতে হলো। অন্যদিকে, কংগ্রেস স্থানীয় স্তরে তাদের পরিকল্পনা নিয়ে প্রচার চালাল। এ ছাড়া মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার যে হাওয়া বইছে, তা–ও বিজেপির জন্য ক্রমে উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠছে।’
কংগ্রেস প্রসঙ্গে প্রফুল্ল কেতকর লিখেছেন, জাতীয় নেতৃত্বকে সরিয়ে নির্বাচনী প্রচারের সামনে স্থানীয় নেতাদের রাখার সুফলও কংগ্রেস পেয়েছে। তবে আগামী দিনে প্রতিশ্রুতির কতটা কংগ্রেস পালন করতে পারছে, সেদিকেও যে বিজেপির তীক্ষ্ণ নজর থাকবে, তা–ও পরিষ্কার করে দিয়েছেন কেতকর।
ভারতের সার্বিক সমাজচিত্র
সাংবাদিকতার পাশাপাশি প্রফুল্ল কেতকর একজন সমাজবিশ্লেষকও বটে। কর্ণাটক নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতে সমাজ ও রাজনীতির পরিবর্তন নিয়েও কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন কেতকরের প্রতিবেদনে স্থান পেয়েছে।
প্রফুল্ল কেতকর লিখেছেন, ‘যেভাবে জাতিভিত্তিক বিভাজনকে ব্যবহার করা হচ্ছে এবং যেভাবে তা কর্ণাটকে কাজে লাগানো হয়েছে, তা উদ্বেগজনক। বিশেষত, কর্ণাটক যখন এমন এক রাজ্য, যা ভারতের তথ্যপ্রযুক্তির কেন্দ্র বলে পরিচিত। একই সঙ্গে ভাষা ও ধর্মভিত্তিক পরিচয় ব্যবহার করে ভোট আদায় করার চেষ্টা কর্ণাটকে হয়েছে। ভবিষ্যতে এর কী ফল হতে পারে, তা বিচার না করেই এ কাজ করা হয়েছে।
এ ছাড়া, মুসলমান সম্প্রদায়ের নেতারা যেভাবে কংগ্রেসের ওপর তাঁদের দাবি চাপিয়ে চাপ সৃষ্টি করেছেন এবং গির্জাগুলোর তরফে খোলাখুলি যেভাবে কংগ্রেসকে সমর্থন দেওয়া হয়েছে, তা–ও আশঙ্কাজনক। আঞ্চলিকতাবাদ ও উপ-আঞ্চলিকতাবাদ ভারতে ক্রমে বাড়ছে। কর্ণাটক নির্বাচন আমাদের দেখিয়েছে, ভাষাভিত্তিক পুনর্গঠনের যে বিপদের কথা বহু বছর আগে ড. (বাবাসাহেব) আম্বেদকর আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন, তা মনে রাখা আজও কতটা জরুরি।’
উল্লেখ্য, ভারতে সমাজ ও রাজনীতির বিশ্লেষকেরা হিন্দু জাতীয়তাবাদের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি সম্পর্কে সাবধান করে দিয়েছিলেন আজ থেকে বছর দশেক আগেই। অনেকেই বলেছিলেন বা লিখেছিলেন, হিন্দুত্ববাদ নামক একটিমাত্র ছাতার নিচে ভারতের বহু ভাষা ও সংস্কৃতিকে আনার চেষ্টায় সে দেশে নতুন করে আঞ্চলিকতাবাদ এবং উপ-আঞ্চলিকতাবাদের জন্ম হতে পারে। অর্গানাইজারের এই লেখায় কার্যত সে কথাই স্বীকার করা হচ্ছে।
এসবের সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণ ভারত বনাম উত্তর ভারতের রেষারেষির যে বাতাবরণ নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে তৈরি করা হয়েছিল, তা–ও বিজেপির জন্য চিন্তার বলে জানিয়েছেন প্রফুল্ল কেতকর।
প্রফুল্ল কেতকর আরও বলেন, ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে বেশ কয়েকটি রাজ্যে বিধানসভা ভোট রয়েছে। এমন অবস্থায়, নির্বাচনী প্রচারের সময় বিভিন্ন দলের মধ্যে তিক্ততা বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
কেতকারের মন্তব্য, ‘রাজনৈতিক দল, ভোটার ও বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠী যাতে নির্বাচনকে ব্যবহার করে দেশের অখণ্ডতাকে আঘাত করতে না পারে, সেদিকে নজর রাখতে হবে, বিশেষ করে দেশের বাইরের শক্তি যাতে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাতে না পারে, তা মাথায় রাখতে হবে।’
আরএসএসের পত্রিকা বলে পরিচিত ‘অর্গানাইজার’–এর এই নিবন্ধ নিয়ে ইতিমধ্যেই ভারতে বিতর্ক শুরু হয়েছে।