উত্তরাখন্ডের ‘পবিত্র ভূমি’ থেকে মুসলিমদের তাড়িয়ে দিতে চায় কট্টর হিন্দুরা
ভারতের উত্তরাখন্ড রাজ্যের বন-পাহাড়ঘেরা ছোট্ট শহর পুরোলা। সেখানে একসময় বাড়ি আর দোকান ছিল মোহাম্মদ সেলিমের। কিন্তু এখন কিছু নেই। এক বছর আগে আরও শতাধিক মুসলিম পরিবারের সঙ্গে তাঁকেও বাড়িছাড়া করেন কট্টরপন্থী হিন্দুরা। প্রতিবেশী অন্য অনেকের চেয়ে স্বাবলম্বী থাকলেও এখন পরিবারের জন্য দুই বেলা খাবার জোটানোই তাঁর জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে উঠেছে।
পুরোলায় কট্টরপন্থী হিন্দু প্রতিবেশীদের হাতে সেলিমের মতো যাঁরা প্রতিহিংসার শিকার হয়েছেন, তাঁদের মুখে এখনো হতাশা ও আতঙ্কের ছাপ। বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য করা সেই প্রতিবেশীরাই এখন পুরো অঞ্চলটি ‘ইসলামমুক্ত’ করতে চায়। কারণ, তারা মনে করে অঞ্চলটি ‘হিন্দুদের পবিত্র ভূমি’।
২০২৩ সালের মে মাসে পুরোলায় সংখ্যালঘু মুসলিমদের উচ্ছেদ শুরু হয়। সেসব কথা স্মরণ করলে এখনো গা শিউরে ওঠে বলে জানালেন মোহাম্মদ সেলিম। সেখানে স্ত্রী ও তিন মেয়েকে নিয়ে সাজানো সংসার ছিল ৩৬ বছর বয়সী সেলিমের। তিনি বললেন, ‘সেদিন যদি না পালাতাম, তাহলে তারা আমাদের সবাইকে মেরে ফেলত।’
পুরোলায় কাপড়ের দোকান ছিল সেলিমের। সেই দোকানও লুট হয়েছিল। এখন উত্তরাখন্ডে হিন্দুদের পবিত্র স্থান হিসেবে পরিচিত হরিদ্বার শহর থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে বসবাস করছেন তিনি।
পরিবার নিয়ে মোহাম্মদ সেলিমের বাড়ি ছাড়ার ঘটনা যাঁরা ‘উদ্যাপন’ করেছিলেন, তাঁদের একজন রাকেশ তোমার (৩৮)। কট্টরপন্থী এই হিন্দু নেতা সংখ্যালঘু মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়ান। তিনি মনে করেন, মুসলিমরা তাঁদের জন্য ‘হুমকি’।
উত্তরাখন্ড আয়তনে সুইজারল্যান্ডের সমান। রাজ্যটি দিয়ে প্রবহমান গঙ্গা নদীর অববাহিকায় আছে বেশ কিছু মন্দির ও উপাসনালয়। এসবের উল্লেখ করে রাকেশ তোমার বলেন, ‘উত্তরাখন্ড হলো হিন্দুদের পবিত্র ভূমি। পরিস্থিতি যা-ই হোক না কেন আমরা এটাকে ইসলামপন্থীদের হতে দেব না, এমনকি এর জন্য যদি জীবন দেওয়ার প্রয়োজনও হয়, দেব।’
ভারতের ২০১১ সালের জনশুমারি অনুযায়ী, উত্তরাখন্ডের জনসংখ্যা এক কোটি। এর মধ্যে মাত্র ১৩ শতাংশ মুসলিম। মুসলিমবিদ্বেষকে কেন্দ্র করে গত বছর রাজ্যে যেসব ঘটনা ঘটেছে, তার অধিকাংশই ঘটেছে কথিত ‘লাভ জিহাদ’কে কেন্দ্র করে। কট্টরপন্থী হিন্দুদের দাবি, মুসলিম পুরুষেরা ভালোবাসার প্রলোভন দেখিয়ে হিন্দু নারীদের বিয়ে করছেন এবং তাঁদের ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য করছেন।
কথিত এই ‘লাভ জিহাদ’ নিয়ে অনলাইনে ব্যাপক প্রচারণা চলে। এর মধ্য দিয়ে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে অঞ্চলটির মানুষজন যে ধর্মীয় সম্প্রীতির মধ্যে বাস করছিলেন, তাতে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ঢুকে পড়ে।
মুসলিমবিদ্বেষী প্রচার চালানো কট্টরপন্থী হিন্দুদের বেশির ভাগই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) অনুসারী। এক দশক ধরে ক্ষমতায় থাকা বিজেপির নেতা-কর্মীদের হিন্দু জাতীয়তাবাদী এসব কর্মকাণ্ডে দেশটির ২২ কোটির বেশি মুসলিম জনগোষ্ঠী তাঁদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উৎকণ্ঠিত।
‘তোমাকে মেরে ফেলব’
রাকেশ তোমারের দাবি, হিন্দুদের কাছ থেকে ব্যবসা-বাণিজ্য ছিনিয়ে নিচ্ছে মুসলিমরা। এটা থামাতে যাঁরা সক্রিয় ভূমিকা রাখছেন, তাদের একজন সেলিম।
রাকেশ তোমার বলেন, ‘হিন্দুদের দোকানের সামনে দোকানদারের নাম লিখে রাখার একটি উদ্যোগ নিয়ে কাজ শুরু করেছি আমরা। দোকানের সামনে যদি নাম থাকে, তাহলে হিন্দুরা হিন্দুদের দোকান থেকে কেনাকাটা করতে পারবেন। এভাবে অর্থনৈতিক দিক থেকে বর্জন করলে মুসলিমরা ব্যবসার নামে যে জিহাদ শুরু করেছে, তা বন্ধ হবে।’
তবে এটা একটা পরীক্ষিত কৌশল এবং মুসলিমবিরোধী প্রচারের আগেই এই কৌশলের ব্যবহার দেখা গেছে। গত বছর পুরোলায় মুসলিমদের ওপর হামলার আগে পোস্টারের মাধ্যমে একটি প্রচার চালানো হয়। সেই পোস্টারে মুসলিমদের বাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা লেখা ছিল।
মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক এই প্রচার শুরু হলে প্রথমে সেলিম ভেবেছিলেন, তাঁকে হয়তো বিপদে পড়তে হবে না। কারণ, হিন্দুদের বাইরে অন্য সংখ্যালঘু বিজেপি সমর্থকদের নিয়ে দলটির যে একটি আলাদা শাখা আছে, সেই মাইনরিটি ফ্রন্টের একজন স্থানীয় নেতা ছিলেন তিনি। তাঁর জন্ম ওই শহরে। সেখানে শৈশবের বন্ধু যেমন আছে, তেমনি আছে হিন্দু প্রতিবেশী। কিন্তু কয়েক মাসে অনলাইনে ছড়ানো বিদ্বেষ এই সবকিছুর আর মূল্য থাকে না।
সেই সময়ের কথা স্মরণ করে সেলিম বলেন, ‘আমাকে হত্যার হুমকিও দেওয়া হয়েছিল।’ তাঁর দোকান লুট ও ভবন ভেঙে দেওয়ায় ৭০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছিল, জানিয়ে সেলিম আরও বলেন, ‘সেই সময় মানুষজন আমাকে বলেছিল, “তুমি এই শহর ছেড়ে তাড়াতাড়ি চলে যাও, নইলে এসব লোক তোমাকে খুন করবে।”’
সেই রাতেই পরিবার নিয়ে পালিয়েছিলেন সেলিম। সেদিন দুই শতাধিক মুসলিম পরিবারকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। গত এক বছরে তাঁদের মধ্যে অল্প কিছু পরিবার আবার ফিরে এসেছে।
‘আমার জন্মভূমি’
রাকেশ তোমার কট্টর হিন্দুত্ববাদী প্রচারের একজন সক্রিয় কর্মী। তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী, ইসলামবিরোধী একটি ‘বাহিনীর’ নেতৃত্বে আছেন তিনি, যার সদস্য কয়েক শ কট্টরপন্থী হিন্দু। তাঁরা মনে করেন, তাঁদের মুসলিম প্রতিবেশীরা হিন্দু নারী, হিন্দুদের জমিজমা ও ব্যবসা দখলের ষড়যন্ত্র করছেন। কিন্তু তাঁদের এমন দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না।
রাকেশ তোমারের সঙ্গে যখন এএফপির এই প্রতিবেদকের কথা হয়, তখন তিনি কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) একটি সভায় ছিলেন। সভার বিরতিতে কথা বলেন।
ভারতকে একটি হিন্দু রাষ্ট্র ঘোষণার জন্য প্রচার চালানো আরএসএস নরেন্দ্র মোদির দল বিজেপির মাতৃসংগঠন। রাকেশ তোমার বলেন, ‘শুধু বিজেপির নেতৃত্বেই একটি হিন্দু রাষ্ট্র গঠন করা সম্ভব।’
দেরাদুনভিত্তিক একজন অধিকারকর্মী ইন্দ্রেশ মাইখুরির মতে, জনগণের মধ্যে বিভাজন তৈরি করে জনপ্রিয়তা বাড়ানোর পাশাপাশি রাজনৈতিক ফায়দা আদায়ের কৌশল মনে করেন নেতারা। এ জন্যই মুসলিমবিদ্বেষ ছড়ানো হয়।
ইন্দ্রেশ বলেন, কিছু মানুষ হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-কলহ তৈরি করতে চায়। এমন বিভাজনের পরিণতি ভয়াবহ হবে।
তবে রাজনীতির এই চরম মূল্য দিতে হচ্ছে সেলিমের মতো সংখ্যালঘু মুসলিদের, যাঁরা একটি ঘরের স্বপ্ন দেখেন। সেলিম বলেন, ‘এটা আমার জন্মভূমি। এই মাতৃভূমি ছেড়ে আমি আর কোথায় যাব?’