কঙ্গনা রনৌত এখন বিজেপির গলার কাঁটা
সুন্দরী, জনপ্রিয় ও ডাকাবুকো—এই তিন কারণে হিমাচল প্রদেশের মান্ডি লোকসভা কেন্দ্র থেকে হিন্দি সিনেমার জনপ্রিয় অভিনেত্রী কঙ্গনা রনৌতকে প্রার্থী করেছিল বিজেপি। মান্ডির ভূমিকন্যা ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটে জিতেও যান। কিন্তু ক্রমেই তিনি দলের গলার কাঁটা হয়ে উঠছেন। তাঁর একের পর এক রাজনৈতিক মন্তব্য বিজেপিকে বিপাকে ফেলেছে। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে প্রকাশ্যে বলতে হয়েছে, কঙ্গনার মন্তব্য তাঁর ব্যক্তিগত। সেই সব মন্তব্য বিজেপির বলে মনে করার কোনো কারণ নেই।
শুধু তা–ই নয়, দল বিবৃতি দিয়ে তাঁকে জানিয়েছে, আর যেন কোনো বিষয়ে তিনি মুখ না খোলেন। এমন নিদান সাম্প্রতিক কালে বিজেপি আর কাউকে দেয়নি।
দল তাঁকে মুখ খুলতে বারণ করেছে কৃষক আন্দোলন নিয়ে বেহিসেবি মন্তব্য করায়। কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে কৃষক আন্দোলন কঙ্গনা কখনো সমর্থন করেননি। কখনো বলেছেন, আন্দোলনকারী কৃষকেরা ‘সন্ত্রাসবাদী’। কখনো বলেছেন, আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী নারীরা ১০০ টাকা নিয়ে ধরনামঞ্চে বসেছেন। এ মন্তব্যের জন্য গত জুনে চণ্ডীগড় বিমানবন্দরে কর্তব্যরত এক মহিলা জওয়ান তাঁকে চড় মেরেছিলেন বলেও অভিযোগ। কুলবিন্দর কৌর নামের সেই মহিলার বিরুদ্ধে সে জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হয়েছিল। সেই মহিলা জওয়ানের অভিযোগ, যাঁকে উদ্দেশ করে কঙ্গনা ওই কুমন্তব্য করেছিলেন, তিনি তাঁর মা। তাঁর মা কৃষক আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। দিনের পর দিন ধরনা দিয়েছেন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে, ১০০ টাকা পাওয়ার লোভে নয়।
সেই কঙ্গনা এবার বিতর্কে জড়ান ওই কৃষক আন্দোলন নিয়েই অন্য মন্তব্য করায়। এক জনপ্রিয় হিন্দি দৈনিকে সম্প্রতি তিনি এক সাক্ষাৎকার দেন। সেই সাক্ষাৎকারের একটি ক্লিপিং তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করেন। তাতে তিনি বলেন, ‘কৃষক আন্দোলনও বাংলাদেশের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারত। কিন্তু তা হয়নি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিচক্ষণ নেতৃত্বের জন্য।’ ওই পোস্টেই তিনি লেখেন, ‘কৃষক আন্দোলন চলাকালে ধর্ষণের বহু ঘটনা ঘটেছে। ঝুলন্ত অবস্থায় বহু দেহ পাওয়া গেছে।’ তিনি এ কথাও বলেছিলেন, কৃষক আন্দোলনের পেছনে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মদদ ছিল। ওটা ছিল তাদের চক্রান্ত।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ওই মন্তব্য বিজেপির বিরক্তির উদ্রেক করেছে হরিয়ানা বিধানসভার নির্বাচনের কারণে। আগামী ১ অক্টোবর হরিয়ানা বিধানসভার ভোট। লোকসভা নির্বাচনে ওই রাজ্যে বিজেপি ভালো ফল করেনি। ১০ আসনের মধ্যে ৫টি তারা খুইয়েছে কংগ্রেসের কাছে। মুখ্যমন্ত্রী বদল করেও কোনো লাভ হয়নি। কৃষিপ্রধান হরিয়ানা বিজেপির কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে কংগ্রেস জোরকদমে নেমেছে। এ পরিস্থিতিতে কঙ্গনার মন্তব্য বিজেপির কাছে বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়ায়। অবস্থা সামাল দিতে তাই বিজেপি বাধ্য হয় কঙ্গনার মন্তব্য থেকে দলকে দূরে রাখতে। তাঁকে হুটহাট মুখ খুলতে বারণ করে দেওয়া হয়।
কিন্তু কঙ্গনার বিপদ অবশ্য তাতে কাটেনি, কাটেনি বিজেপিরও। গতকাল মঙ্গলবার হিমাচল প্রদেশ বিধানসভায় কঙ্গনার অবিবেচক মন্তব্যের নিন্দা করে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। কঙ্গনার মন্তব্যকে কংগ্রেস আসন্ন বিধানসভা ভোটে হাতিয়ার করতে চলেছে। প্রবলভাবে সরব বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’র অন্য শরিকরাও। আপ জানিয়েছে, কৃষকদের নিয়ে বিজেপির মনোভাব কেমন, কঙ্গনার ওই মন্তব্যই তার প্রমাণ। মহারাষ্ট্রের শিবসেনা (উদ্ধব) নেত্রী প্রিয়াঙ্কা চতুর্বেদি এক্স হ্যান্ডেলে লিখেছেন, কঙ্গনা ওই মন্তব্যের জন্য ক্ষমা চাননি। তাঁর ক্ষমা চাওয়া উচিত। দুঃখ প্রকাশও করা দরকার। বিজেপিও দুঃখ প্রকাশ করেনি, অথচ কঙ্গনা তাদেরই লোকসভা সদস্য। এ থেকেই বোঝা যায়, কৃষকদের জন্য বিজেপি যা কিছু করে ও বলে, তা স্রেফ কথার কথা।
কঙ্গনার আলটপকা মন্তব্যের সামাল কীভাবে দেওয়া যায়, বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব এখন সেই চিন্তায় আছে। হরিয়ানায় ১০ বছর ধরে বিজেপি ক্ষমতাসীন।
রাজনীতিতে ঢোকার পর থেকে কঙ্গনার পেশাগত জীবনেও চলছে ভাটার টান। তেমন করে কোনো সিনেমা বক্স অফিসে সাফল্য পায়নি। এ অবস্থায় তাঁর নতুন সিনেমা ‘ইমারজেন্সি’ সৃষ্টি করেছে নতুন বিতর্ক। আগামী ৬ সেপ্টেম্বর ‘ইমারজেন্সি’ রিলিজ করার কথা। কিন্তু তা নিষিদ্ধ করার দাবি উঠেছে। একান্তই রিলিজ হলে আপত্তিকর অংশ বাদ দেওয়ার দাবি করা হয়েছে। কঙ্গনার বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত হয়েছে শিখসমাজ। এই সমাজের দাবি, ওই সিনেমায় শিখ সম্প্রদায়ের মর্যাদাহানি হয়েছে। তাদের ‘সন্ত্রাসবাদী’ হিসেবে দেখানো হয়েছে। শিখ সম্প্রদায়ের ধর্মীয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা শিরোমণি গুরুদ্বার প্রবন্ধক কমিটির (এসজিপিসি) প্রধান হরজিন্দর সিং ধামি কঙ্গনার বিরুদ্ধে এফআইআর করার দাবি জানিয়ে বলেন, সিনেমায় শিখসমাজকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে দেখানো হয়েছে। এটা ভুল নয়, এটা ইচ্ছাকৃত। কঙ্গনা ‘ইমারজেন্সি’তে ইন্দিরা গান্ধীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। তিনি সিনেমাটির অন্যতম প্রযোজক।
এই সিনেমার জন্য কঙ্গনাকে প্রাণনাশের হুমকিও দেওয়া হয়েছে। এক ভিডিওতে ভিকি থমাস সিং নামের এক শিখ নেতাকে বলতে শোনা গেছে, শিখ সম্প্রদায়কে সন্ত্রাসবাদী দেখালে মনে রাখবেন, যাঁর (ইন্দিরা গান্ধী) জীবনের ঘটনা নিয়ে সিনেমাটি তৈরি করা হয়েছে, তাঁর পরিণতি কী হয়েছিল। শিখ যদি নিজের গলা কাটাতে পারে, তাহলে অন্যের গলাও কাটতে পারে। ওই ভিডিওতেই কঙ্গনার উদ্দেশে অন্য একজনকে বলতে শোনা যায়, এর আগে আপনি থাপ্পড় খেয়েছিলেন। এই সিনেমা রিলিজ করলে সরদারেরা আপনাকে জুতোপেটা করবে।
ওই ভিডিও কঙ্গনা নিজেও দেখেছেন। এক্স হ্যান্ডেলে ভিডিওটি দিয়ে তিনি ট্যাগ করেছেন মহারাষ্ট্র, পাঞ্জাব ও হিমাচল প্রদেশের পুলিশকে। সঙ্গে লিখেছেন,‘দয়া করে ভিডিওটি দেখুন।’
কঙ্গনা নিজেকে বিপদে ফেলেছেন, দলকে ফেলেছেন বিপাকে।