ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ‘ঈশ্বরের অবতার’, এমন বিতর্কের মধ্যে আগামীকাল শনিবার লোকসভার ষষ্ঠ দফার ভোট গ্রহণ শুরু হচ্ছে। এই পর্বে ভোট হবে ছয়টি পূর্ণ রাজ্য ও দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মোট ৫৮ আসনে। শাসক বিজেপি ও তার সঙ্গীদের কাছে এই পর্বের ভোট গুরুত্বপূর্ণ। ২০১৯ সালে এই আসনগুলোর মধ্যে তারা জিতেছিল ৪৫টিতে। এবার লড়াই ক্ষুরধার। কারণ, এই দফায় বিজেপির আসন বাড়ানোর জায়গা খুবই কম, বিপরীতে হারানোর আশঙ্কা বেশি।
সেই শঙ্কা যাতে সত্যি না হয়, সে জন্য নরেন্দ্র মোদি নিজেকে শুধু ‘ঈশ্বর প্রেরিত’ বলেই জাহির করেননি, তিনি বলেছেন, ২০৪৭ সালের মধ্যে ‘বিকশিত ভারত’ গড়ার সংকল্প অপূর্ণ রেখে ফিরে গেলে পরমাত্মা তাঁকে গ্রহণ করবেন না। অতএব, ভোটারদের কাছে তাঁর প্রার্থনা, এবারেও জনতা তাঁদের জয়যুক্ত করুক, যাতে দ্রুত তিনি ভারতকে তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত করতে পারেন।
মোদিকে ছেড়ে কথা বলছেন না বিরোধী নেতারা। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী বলেন, মোদি যদি ‘ঈশ্বরই’ হয়ে থাকেন, তাহলে করোনার সময় মহামারি ঠেকাতে জনতাকে কেন তিনি থালা বাজাতে বলেছিলেন? গঙ্গায় যখন সারি দিয়ে লাশ ভেসে যাচ্ছিল, হাসপাতালে জমছিল মরদেহের পাহাড়, তখন কেন তিনি তা না ঠেকিয়ে মুঠোফোনের আলো জ্বালাতে বলেছিলেন? পরমাত্মার অংশ যিনি, তিনি কেন শুধু ২২ জন কোটিপতির জন্য কাজ করেন? বিরোধীদের কটাক্ষ-নিজেকে ঈশ্বর প্রেরিত দাবি করার পর মোদি এখন বলতে চাইছেন, তিনি ইচ্ছা মৃত্যুর ক্ষমতা রাখেন।
বিতর্ক পাশে রাখলে সত্যি হলো, এই পর্বেও বিজেপিকে কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। গতবার এই ৫৮ আসনের মধ্যে হরিয়ানা (১০) ও দিল্লিতে (৭) একটি আসনেও কাউকে জিততে দেয়নি বিজেপি। অথচ এই ১৭ আসনেই বিজেপি এবার কঠিন লড়াইয়ে। দিল্লিতে আম আদমি পার্টির (আপ) সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়েছে কংগ্রেস। আপ লড়াই করছে চারটি ও কংগ্রেস তিনটি আসনে। প্রাথমিক জড়তা থাকলেও সময় যত এগিয়েছে, আপ ও কংগ্রেস হাতে হাত মিলিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছে। হরিয়ানাতে এমন হাল যে অধিকাংশ কেন্দ্রে বিজেপির প্রার্থীরা প্রচারই করতে পারেননি। রাজ্যের কৃষকসমাজ ও জাট সম্প্রদায় একজোট হয়ে বিজেপি বিরোধিতায় নেমেছে। এই রাজ্যেও কংগ্রেস-আপ জোট হয়েছে। কংগ্রেস লড়ছে ৯টি ও আপ ১টি আসনে।
দিল্লি ও হরিয়ানার মতো বিহারেও গতবার বিজেপি ও দলটির সহযোগীরা বিরোধীদের দাঁত ফোটাতে দেয়নি। কাল যে আট আসনে ভোট, তার সব কটিই জিতেছিল বিজেপি, জেডিইউ ও এলজিপি। এবার ‘ইন্ডিয়া’ জোট কোমর বেঁধে নেমেছে। একই হাল ঝাড়খন্ডের চার আসনেও। গতবার সেখানে বিজেপি জিতেছিল তিনটি আর একটি তাদের শরিক দল অল ঝাড়খন্ড স্টুডেন্টস ইউনিয়ন। এবার রাজ্যের আদিবাসী সমাজ মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেনকে বন্দী করার জন্য বিজেপিকে শাস্তি দেয় কি না, সেটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে ভোটের প্রধান আকর্ষণ।
আসন বাড়ানোর লক্ষ্যে বিজেপি এবার যে রাজ্যগুলোর দিকে বিশেষ নজর দিয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে কাল পশ্চিমবঙ্গে ভোট আটটি ও ওডিশার ছয়টি আসনে। পশ্চিমবঙ্গে ওই আট আসনের মধ্যে বিজেপি গতবার জিতেছিল পাঁচটিতে। বাকি তিনটি তৃণমূল। ওডিশার ছয়টি আসনের মধ্যে বিজেপি জিতেছিল দুটি। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস নতুন করে বিতর্কবিদ্ধ হচ্ছে রামকৃষ্ণ মিশন ও ভারত সেবাশ্রম সংঘ নিয়ে। অন্যদিকে ওডিশায় বিজেপি বিপাকে পড়েছে তাদের মুখপাত্র ও পুরি কেন্দ্রের প্রার্থী সম্বিত পাত্রের মন্তব্যের কারণে। সম্বিত দিন দুই আগে বলেছিলেন, প্রভু জগন্নাথ দেব নরেন্দ্র মোদির ভক্ত। মোদি নিজেই যখন নিজেকে পরমাত্মার অংশ বলে দাবি করেন, তখন সম্বিতের মন্তব্য বাড়তি কিছু সংযোজন না করলেও গোটা রাজ্য প্রতিবাদে মুখর হয়েছে। অবস্থা সামাল দিতে ও প্রায়শ্চিত্ত করতে সম্বিত তিন দিন উপবাস থাকার কথা ঘোষণা দিয়েছেন। এই আবহের মধ্যে বিজেপির জন্য ওডিশায় বাড়তি আসন পাওয়া সহজ হবে না।
উত্তর প্রদেশে এই দফায় ভোট ১৪ আসনে। এর মধ্যে গতবার বিজেপি জিতেছিল ৯টিতে। বাকি পাঁচটির মধ্যে চারটিতে বিএসপি, একটিতে এসপি জয় পেয়েছিল। বিএসপি এবার তেড়েফুঁড়ে লড়াই করছে না। তাদের দলিত ভোট আগের মতো বিজেপিতে গেলে মোদি এই রাজ্য থেকে আসন বৃদ্ধির আশা করতেই পারেন। কিন্তু দলিত ভোট এসপি-কংগ্রেস জোটে গেলে শাসক দলের চিন্তা বাড়বে। অখিলেশ যাদব সেই লক্ষ্যে এবার দলিত ও অনগ্রসর প্রার্থীর সংখ্যা বাড়িয়ে দিয়েছেন। দোসর কংগ্রেসকে নিয়ে প্রচারও চলছে সেভাবে।
জম্মু-কাশ্মীরের অনন্তনাগ-রাজৌরি কেন্দ্রের লড়াই এবার জোরদার। ফারুক আবদুল্লাহর দল ন্যাশনাল কনফারেন্স (এনসি) গতবার এই আসনে জিতেছিল। কিন্তু নয়া জমানায় এই কেন্দ্রের সীমান্ত পুনর্গঠন করা হয়েছে। রাজৌরির অনেকটা অনন্তনাগের মধ্যে ঢোকানো হয়েছে। এনসি প্রার্থীকে এখানে বেগ দিতে পিডিপির হয়ে দাঁড়িয়েছেন মেহবুবা মুফতি। বিজেপি প্রার্থী দেয়নি, তবে তারা সমর্থন করছে, তাদের তৈরি করা আপনি পার্টির প্রার্থীকে। উপত্যকায় বিজেপিকে সমর্থন করছে সাজ্জাদ লোনের দল পিপলস কনফারেন্সও। এনসি-পিডিপির রেষারেষিতে আপনি পার্টি জিতে গেলে বিজেপি বকলমে উপত্যকায় জমি খুঁজে পাবে।
এই পরিস্থিতিতে নির্বাচন কমিশনকে বড় স্বস্তি দিলেন সুপ্রিম কোর্ট। ভোট গ্রহণের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে বুথভিত্তিক ভোটের যাবতীয় পরিসংখ্যান প্রকাশ করার আবেদন জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টে মামলা হয়েছিল। দুই পক্ষের শুনানি শেষে সুপ্রিম কোর্ট আজ শুক্রবার এই বিষয়ে কোনো নির্দেশ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। বিচারপতি দীপংকর দত্ত ও বিচারপতি সতীশচন্দ্র শর্মার ডিভিশন বেঞ্চ জানান, পাঁচ দফার ভোট গ্রহণ হয়ে গেছে। বাকি মাত্র দুই দফা। এই সময় এমন কোনো নির্দেশ মানা কমিশনের পক্ষে চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়াবে।
এবারের ভোটে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে বিরোধীরা সমালোচনায় মুখর। ভোট গ্রহণের ১১ দিন পর ভোটের হার বৃদ্ধির ঘোষণা বিরোধীদের শঙ্কিত করে রেখেছে। সেই শঙ্কা দূর করতেই ওই আবেদন করা হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীসহ বিজেপির শীর্ষ নেতারা ইতিমধ্যেই বলতে শুরু করেছেন, হার নিশ্চিত জেনে বিরোধীরা এখন থেকেই নির্বাচন কমিশন ও ইভিএমকে কাঠগড়ায় তুলতে শুরু করেছে।