ন্যাশনাল হেরাল্ড মামলায় বেআইনিভাবে অর্থ লেনদেনের অভিযোগে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী ও তাঁর পুত্র রাহুলকে ভারতের আর্থিক দুর্নীতিসংক্রান্ত তদন্তকারী সংস্থা ‘এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট’ (ইডি) সমন জারি করেছে। রাহুলকে ২ জুন ও সোনিয়াকে ৮ জুন ইডি দপ্তরে হাজিরা দিতে বলা হয়েছে।
কংগ্রেসের পক্ষে আজ বুধবার এ খবর জানিয়ে বলা হয়, সোনিয়া অবশ্যই ৮ জুন উপস্থিত থাকবেন। রাহুল যেতে পারবেন ৫ জুনের পর। কারণ, তিনি দেশে নেই।
সংবাদ সম্মেলন করে কংগ্রেস নেতা ও আইনজীবী অভিষেক মনু সিংভি বলেন, ন্যাশনাল হেরাল্ড মামলায় বেআইনিভাবে আর্থিক লেনদেনের অভিযোগের বিন্দুমাত্র সত্যতা নেই। ইডি একসময় মামলাটি বন্ধ করেও দিয়েছিল। পরে ফের রাজনৈতিক কারণে খোলা হয়েছে। সিংভি বলেন, এটা এমন একটা মামলা, যেখানে একটি টাকাও লেনদেন হয়নি। এটা একটা রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও আইনি বিষয়। গান্ধী পরিবারের লুকানোর কিছুই নেই। তিনি বলেন, ‘আমরা ভীত নই। সাহসের সঙ্গে এই মামলা মোকাবিলা করব। সস্তার রাজনীতি ও প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা ছাড়া এই মামলায় আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।’
ন্যাশনাল হেরাল্ড পত্রিকা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৩৭ সালে। প্রতিষ্ঠাতা জওহরলাল নেহরু। তাঁর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তৎকালীন স্বাধীনতাসংগ্রামীরা। যে সংস্থার হাতে কাগজের মালিকানা ছিল, তার নাম ‘অ্যাসোসিয়েটেড জার্নালস লিমিটেড’ (এজিএল)। ওই ইংরেজি সংবাদপত্রই হয়ে ওঠে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের মুখপত্র। কালের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ন্যাশনাল হেরাল্ড হারাতে থাকে তার যাবতীয় ঔজ্জ্বল্য। কংগ্রেসের দলীয় টাকায় চালিত ওই সংবাদপত্র একসময় ঋণভারে জর্জরিত হয়ে পড়ে।
২০০৮ সালে কাগজটির প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। তত দিনে এজিএলের দেনা ৯০ কোটি টাকা, যা প্রায় পুরোটাই কংগ্রেসের কাছ থেকে নেওয়া ঋণ। ওই সময় ‘ইয়ং ইন্ডিয়া’ নামের একটি সংস্থা ন্যাশনাল হেরাল্ড অধিগ্রহণ করে ৫০ লাখ টাকার বিনিময়ে। তার বদলে সংস্থার ৯০ কোটি রুপির দেনার ভার যেমন বর্তায় ইয়ং ইন্ডিয়ার ঘাড়ে, তেমনই সংস্থার যাবতীয় স্থাবর–অস্থাবর সম্পত্তির মালিকও হয় তারা। ন্যাশনাল হেরাল্ড ছিল কংগ্রেসের পত্রিকা, ইয়ং ইন্ডিয়ার শেয়ারধারীরাও কংগ্রেসের নেতা। শেয়ারধারীদের মধ্যে ছিলেন সোনিয়া ও রাহুল গান্ধী, মোতিলাল ভোরা, অস্কার ফার্নান্দেজ, স্যাম পিত্রোদা, সুমন দুবে। কংগ্রেস পরে জানায়, ইয়ং ইন্ডিয়ার ৯০ কোটি রুপি ঋণ মওকুফ করে দেওয়া হচ্ছে, যেহেতু তা উদ্ধার সম্ভব নয়।
বিজেপির সংসদ সদস্য সুব্রহ্মনম স্বামী এ নিয়ে মামলা করেন। বিজেপির ওই নেতা সেই সময় জানিয়েছিলেন, কংগ্রেস রাজনৈতিক দল। তাদের আয়কর দিতে হয় না। কাজেই কোনো বাণিজ্যিক সংস্থাকে তারা ঋণ দিতে পারে না। কংগ্রেসের বক্তব্য, ন্যাশনাল হেরাল্ড ছিল কংগ্রেসিদের প্রতিষ্ঠা করা কাগজ, যা দলীয় মুখপত্র হয়ে উঠেছিল। সেই কারণেই তার পুনরুজ্জীবনে ঋণ দেওয়া হয়েছে।
সুব্রহ্মনম স্বামীর অভিযোগ, এজিএলের কাছ থেকে ইয়ং ইন্ডিয়া ন্যাশনাল হেরাল্ড অধিগ্রহণ করায় দিল্লি, মুম্বাই, লক্ষ্ণৌ, ভোপাল, ইন্দোর, পাটনাসহ বিভিন্ন শহরে ওই পত্রিকার যত সম্পত্তি ছিল, সবই চলে আসে কংগ্রেসের হাতে। এর মূল্য পাঁচ হাজার কোটি টাকা। তার কিছুটা বিক্রি করেই ইয়ং ইন্ডিয়া কংগ্রেসের ঋণ শোধ করে দিতে পারত। কিন্তু তা না করে মওকুফ করা হলো ঋণ। ফলে কংগ্রেস দলের আয়করমুক্ত টাকা ঘুরপথে কংগ্রেস নেতৃত্বের হাতে চলে গেল। এ অভিযোগে দিল্লি আদালতে সুব্রহ্মনম স্বামী মামলা দায়ের করেন ২০১২ সালে। ২০১৪ সালে আদালত সোনিয়া, রাহুলসহ অন্যদের হাজিরার নির্দেশ দেন। এর বিরুদ্ধে হাইকোর্টে স্থগিতাদেশ চায় কংগ্রেস। কিন্তু তা নামঞ্জুর হওয়ায় ২০১৫ সালে ডিসেম্বরে কংগ্রেস নেতারা নিম্ন আদালতে হাজির হয়ে জামিন পান।
কেন্দ্রীয় সংস্থাকে দিয়ে বিরোধীদের কোণঠাসা করা ও চাপে রাখার রাজনীতির বিরুদ্ধে ভারতের বিরোধী দলগুলো অনেক দিন ধরেই সরব। আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগে সম্প্রতি নোটিশ পাঠানো হয়েছে কাশ্মীরি নেতা ফারুক আবদুল্লাহকে। তিনি বলেছেন, কাশ্মীরে নির্বাচন পর্যন্ত এ হয়রানি চালানো হবে। মেহবুবা মুফতির বোন রুবাইয়া সঈদ, ১৯৮৯ সালে যাঁকে কাশ্মীরি জঙ্গিরা অপহরণ করেছিল, তাঁকেও এত বছর পর এই প্রথম সমন জারি করা হয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংসদ সদস্য ভাইপো অভিষেককে বারবার ডেকে পাঠানো হচ্ছে বিভিন্ন অভিযোগের তদন্তের জন্য। মহারাষ্ট্রের শাসক জোটের একাধিক নেতাকে হয় বন্দী করা হয়েছে, নয়তো তদন্তকারীদের সামনে হাজিরা দিতে হচ্ছে। দিল্লির স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে দুর্নীতির অভিযোগে। কিন্তু শাসক দলের কারও গায়ে আঁচড় পর্যন্ত নেই।
অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় তাই প্রশ্ন তুলেছেন, চিট ফান্ড মামলার অভিযোগকারীর সঙ্গে ছবি থাকার জন্য যদি বিরোধী নেতাদের জেলে থাকতে হয়, তাহলে ২০ হাজার কোটি টাকা ব্যাংক জালিয়াতি করে বিদেশে পালানো অপরাধীর সঙ্গে ছবি তোলার অপরাধে প্রধানমন্ত্রীর কেন জেলে যেতে হবে না? কংগ্রেস নেতারা বুধবার বলেছেন, যা হচ্ছে তা নোংরা রাজনীতি। এর বিরুদ্ধে কংগ্রেস আইনি পথেই লড়বে।