সামনে এল আরও এক কাশ্মীর ফাইলস

‘কাশ্মীর ফাইলস’ মুক্তির ৮ দিনের মধ্যেই ১০০ ক্লাবের সদস্য হয়েছে

এটাও এক ‘কাশ্মীর ফাইলস’, তবে ‘অকথিত’। দ্য কাশ্মীর ফাইলস নিয়ে তৈরি হওয়া বিতর্কের মধ্যে জম্মু-কাশ্মীর পুলিশ সম্প্রতি এক ছোট্ট ভিডিও ক্লিপ প্রকাশ করেছে, যার নাম ‘দ্য আনটোল্ড কাশ্মীর ফাইলস’। ৫৭ সেকেন্ডের এই ভিডিওতে ধরার চেষ্টা হয়েছে ‘কাশ্মীরি’ জনতার দুঃখের দিনলিপি; যা ভূস্বর্গে ধর্ম, জাত বা বর্ণের বিভেদ করেনি।

জম্মু-কাশ্মীর পুলিশের যুক্তি, বেদনা যতটা হিন্দুর, ততটাই মুসলমানের। যন্ত্রণায় যতটা বিদ্ধ পণ্ডিতেরা, ততটাই মুসলমান। ওই দুঃখ, যন্ত্রণা, বেদনা যাতে ধর্মনির্বিশেষে সবাইকে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ করে তুলতে পারে, সেই উদ্দেশ্যেই জম্মু-কাশ্মীর পুলিশের এই ছোট্ট নিবেদন—‘দ্য আনটোল্ড কাশ্মীর ফাইলস’।

জম্মু-কাশ্মীর পুলিশের উদ্দেশ্য বোধগম্য। কিন্তু কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের পুলিশকে দিয়ে এ ধরনের ভিডিও ক্লিপ প্রচারের অনুমতি কেন্দ্রীয় সরকার ও এর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কেন দিল, সেই যুক্তির কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। বিবেক অগ্নিহোত্রীর সিনেমা দ্য কাশ্মীর ফাইলস সারা দেশে যে বিতর্ক সৃষ্টি করেছে, ধর্মীয় মেরুকরণের অনুঘটক হয়ে উঠেছে, তা থেকে সরে আসার এ এক সচেতন ভাবনা কি না, কিংবা এর মধ্য দিয়ে কাশ্মীর উপত্যকার মুসলমানদের মানসিক ক্ষতে প্রলেপ দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে কি না, সেই সদুত্তর কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে পাওয়া যায়নি।

আরও পড়ুন

একটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা, মুসলমানদের শামিল করা না গেলে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই জেতা যে অসম্ভব, সরকার তা বুঝতে পেরেছে। তাই এই পাল্টা ফাইলসের উপস্থাপনা। উপত্যকার এক বড় পুলিশ কর্তা অবশ্য সর্বভারতীয় দৈনিক দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-এর কাছে স্বীকার করেছেন, ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস সিনেমাটি হিন্দু পণ্ডিতদের দুর্দশার ছবি একতরফাভাবে এঁকে গেছে। মুসলমানরাও যে তেমনই ক্ষতিগ্রস্ত, সিনেমায় তার ছিটেফোঁটা ছোঁয়া নেই।’

জম্মু-কাশ্মীর পুলিশের টুইটার হ্যান্ডেল গত ৩১ মার্চ এই ভিডিও ক্লিপ আপলোড করে। ভিডিওটি শুরু হচ্ছে জম্মু-কাশ্মীরের ম্যাপের মধ্যে দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের যন্ত্রণাক্লিষ্ট সাদা-কালো মুখের ক্রমশ ছোট থেকে বড় হওয়া দিয়ে। আবহে বেহালায় করুণ সুর। ক্রমশ পর্দাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে সেসব শোকগ্রস্ত কাশ্মীরির চেহারা; যাঁরা গত ২৭ মার্চ অতর্কিত জঙ্গি হানায় নিহত পুলিশ কর্তা ইশফাক আহমেদ ও তাঁর ভাই উমর জান-এর শোকযাত্রায় শামিল হয়েছিলেন। আহাজারিরত সেসব শোকার্ত মানুষের ঢলের ওপর স্ক্রিনে ভেসে ওঠে এই লেখা, ‘বাছাই করে হত্যা প্রাণ নিয়েছে ২০ হাজার কাশ্মীরির। সময় এসেছে গর্জে ওঠার। আমরা চুপ থাকব না। আমরা ক্ষমাও করব না। আমরা কাশ্মীরি। হাম দেখেঙ্গে।’

কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ঘটনায় আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় ভারতের ভাবমূর্তি বেশ খানিকটা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। ভারত যে একদর্শী দেশ নয়, গণতন্ত্র ও বহুত্ববাদ যে এই দেশের মূল ভাবনা, সম্ভবত তা প্রতিষ্ঠার তাগিদ জম্মু-কাশ্মীর পুলিশের তৈরি এই সংক্ষিপ্ত ভিডিও ক্লিপ।

‘হাম দেখেঙ্গে’ বিখ্যাত পাকিস্তানি কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের অতি বিখ্যাত উর্দু কবিতা। ক্লিপিংয়ে শোনা যায় তারই সংগীতরূপ। লক্ষণীয়, সিএএ-এনআরসিবিরোধী আন্দোলন কিংবা জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বিক্ষোভের সময়ও এই কবিতা সমস্বরে উচ্চারিত হয়েছিল। দিল্লি পুলিশ তখন এই কবিতা আবৃত্তি করাও দেশদ্রোহের দোসর মনে করেছিল। দ্য কাশ্মীর ফাইলস সিনেমায়ও এই কবিতা ব্যবহৃত।

সিনেমাটি মুক্তি পায় গত ১১ মার্চ। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তা কাশ্মীরি হিন্দু পণ্ডিতদের ওপর অত্যাচারের ‘সত্য’ দলিল বলে অভিহিত হয়। খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি অভিনন্দিত করেছিলেন নির্মাতা ও কুশীলবদের। বিজেপিশাসিত রাজ্যে বিনোদন করমুক্ত এই সিনেমা আড়াই শ কোটি টাকার ব্যবসা করে ফেলেছে বলে ইন্ডাস্ট্রির খবর। দ্য আনটোল্ড কাশ্মীর ফাইলস মুক্তির চার দিনের মাথায় ৪ এপ্রিল উপত্যকায় নতুন করে অশান্তি সৃষ্টি হয়। গুলিবিদ্ধ হন একজন পণ্ডিত ব্যবসায়ী এবং বেশ কয়েকজন ভিনপ্রদেশি শ্রমিক। মারা যান এক সিআরপিএফ জওয়ান। এক পক্ষকালের মধ্যে ভিনপ্রদেশি শ্রমিকদের ওপর এটা ছিল চতুর্থ আক্রমণ।

কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ঘটনায় আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় ভারতের ভাবমূর্তি বেশ খানিকটা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। ভারত যে একদর্শী দেশ নয়, গণতন্ত্র ও বহুত্ববাদ যে এই দেশের মূল ভাবনা, সম্ভবত তা প্রতিষ্ঠার তাগিদ জম্মু-কাশ্মীর পুলিশের তৈরি এই সংক্ষিপ্ত ভিডিও ক্লিপ।