ব্রিটিশ রাজতন্ত্র: উদ্যাপনে শুরু হওয়া বছরটির কান্নাভেজা বিদায়
যুক্তরাজ্যে ২০২২ সালটি শুরু হয়েছিল আনন্দ, উচ্ছ্বাস আর উদ্যাপনের মধ্য দিয়ে। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে ব্রিটিশ রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের সিংহাসনে অভিষেকের ৭০ বছর পূর্তি হয়। যুক্তরাজ্যের রাজতন্ত্রের ইতিহাসে তিনিই সবচেয়ে দীর্ঘ সময় সিংহাসনে অধিষ্ঠিত থেকেছেন।
এ উপলক্ষে গত জুনে ব্রিটেনে এবং কমনওয়েলথভুক্ত বিভিন্ন দেশে চার দিন নানা রাজকীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন ছিল। তবে গত ৮ সেপ্টেম্বর সে আনন্দের মাঝে বেজে ওঠে বিষাদের সুর। এদিন স্কটল্যান্ডের বালমোরাল প্যালেসে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। আর এর মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ রাজশাসনের একটি বর্ণাঢ্য অধ্যায়ের ইতি ঘটে। তাই বলা চলে, ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের ইতিহাসে ২০২২ সালটি একই সঙ্গে উদ্যাপনের এবং কান্নার।
মাত্র ২৫ বছর বয়সে ব্রিটিশ রাজত্বের দায়িত্ব নিয়েছিলেন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। আর তাঁর জীবনাবসান হয় ৯৬ বছর বয়সে।
রাজকুমারী দ্বিতীয় এলিজাবেথের রানি হয়ে ওঠা
রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের পুরো নাম এলিজাবেথ আলেকজান্দ্রা মেরি উইন্ডসর। তিনি ১৯২৬ সালের ২১ এপ্রিল লন্ডনের বার্কলে স্কয়ারের কাছে একটি বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ ব্রিটিশ রাজা জর্জ ও রানি এলিজাবেথের প্রথম সন্তান। তাঁর বাবা ১৯৩৬ সালে সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন। সেই সময় থেকেই এলিজাবেথ সিংহাসনের উত্তরাধিকারী ছিলেন।
১৯৪৭ সালে প্রিন্স ফিলিপকে বিয়ে করেন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাবা রাজা জর্জ মারা গেলে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ সিংহাসনে বসেন এবং কমনওয়েলথের প্রধান হন। যুক্তরাজ্যসহ ১৫টি কমনওয়েলথভুক্ত দেশ ও অঞ্চলের আলংকারিক প্রধান ছিলেন তিনি।
এলিজাবেথ-ফিলিপ দম্পতির চার সন্তান। তাঁরা হলেন—ওয়েলসের যুবরাজ চার্লস (তিনি এখন ব্রিটেনের রাজা); প্রিন্সেস অ্যান; ইয়র্কের ডিউক যুবরাজ অ্যান্ড্রু এবং আর্ল অব ওয়েসেক্স যুবরাজ এডওয়ার্ড। ৭৪ বছরের বিবাহিত জীবনে রানি এলিজাবেথ বেশির ভাগ সময়ই ব্যস্ত থেকেছেন রাজকীয় দায়িত্ব পালনে। রানিকে তাঁর রাজকীয় দায়িত্ব পালনে সহায়তা করেছিলেন প্রিন্স ফিলিপ। রানি তাঁর রাজকীয় নিয়মের কর্মপরিধির বাইরেও সক্রিয় ছিলেন নানাবিধ সেবা ও মানবিক কাজে। পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন ছয় শতাধিক দাতব্য প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার।
অভিষেকের ৭০ বছর উদ্যাপনে বর্ণাঢ্য আয়োজন
২০২১ সালের এপ্রিল মাসে প্রিন্স ফিলিপের মৃত্যু হলে একা হয়ে পড়েন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। ওই বছরের অক্টোবরে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাঁকে হাসপাতালে যেতে হয়েছিল। সে সময় শারীরিক দুর্বলতা ও বার্ধক্যজনিত অসুস্থতার কারণে তাঁকে জনসমাগম এড়িয়ে থাকার পরামর্শ দেন চিকিৎসকেরা। এর পর থেকে তিনি খুব একটা জনসমক্ষে আসছিলেন না। তবে শারীরিক অসুস্থতা সত্ত্বেও ২০২২ সালের জুনে অভিষেকের ৭০ বছর উদ্যাপন অনুষ্ঠানে হাসিমুখে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। অনুষ্ঠানে ৯৬ বছর বয়সী ব্রিটিশ রানিকে লাঠিভর দিয়ে হাঁটতে দেখা গিয়েছিল।
‘ট্রুপিং দ্য কালার’ (ব্রিটিশ সার্বভৌমত্বের জন্মদিন উদ্যাপন) কুচকাওয়াজ, গান স্যালুট, বিমানের ফ্লাইপাস্ট, কনসার্ট, আলোকশিখা জ্বালানোসহ নানা আয়োজন ছিল। কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর রাজধানীতে মশাল জ্বালিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়।
সরকারে টালমাটাল অবস্থা এবং রানির বিদায়
ব্রিটেনের রাষ্ট্রপ্রধান রাজা বা রানি হলেও যুক্তরাজ্যের সরকারব্যবস্থার প্রধান প্রধানমন্ত্রী। দ্বিতীয় এলিজাবেথের ৭০ বছরের শাসনামলে যুক্তরাজ্য ১৬ জন প্রধানমন্ত্রী পেয়েছে। রানির অভিষেকের সময়ে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন কনজারভেটিভ পার্টির নেতা উইনস্টন চার্চিল। আর রানির মৃত্যুর আগে সবশেষ প্রধানমন্ত্রী ছিলেন লিজ ট্রাস। তিনিই সেই ব্যক্তি, যাঁকে দেশের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি রাজ শাসকের সঙ্গে সর্বশেষ ছবিতে দেখা গেছে। মৃত্যুর দুই দিন আগে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ সরকার গঠনের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে লিজ ট্রাসকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। বালমোরাল ক্যাসেলে তাঁদের দুজনের করমর্দনের ছবি প্রকাশ হয়েছিল। এটিই মৃত্যুর আগে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের জনসমক্ষে প্রকাশিত সর্বশেষ ছবি।
রানি এমন সময়ে মারা যান, যখন যুক্তরাজ্যের সরকারব্যবস্থায় টালমাটাল অবস্থা চলছে। একের পর এক প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব নিচ্ছেন আর পদত্যাগ করছেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে লিজ ট্রাস দায়িত্ব গ্রহণের পর মন্ত্রিসভা গঠন হওয়ার আগেই রানির মৃত্যু হয়। রানির মৃত্যুর পর লিজ ট্রাসও পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। পরে প্রধানমন্ত্রী হন ঋষি সুনাক। ২০২২ সালে যুক্তরাজ্যে তিন দফায় প্রধানমন্ত্রী পরিবর্তন হয়েছে।
শেষ শ্রদ্ধা জানাতে দীর্ঘ অপেক্ষা
রানির রাজত্বকালের শুরুর সময় ব্রিটিশ রাজতন্ত্র যে শক্ত ভিতের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল, যে রাজতন্ত্রের প্রতি মানুষের তখন প্রবল আনুগত্য ছিল, তাঁর রাজত্বকালের শেষ সময়ে সেই উচ্ছ্বাস ও আনুগত্যে কিছুটা ভাটা পড়েছিল। তবে ব্রিটিশ জনগণের হৃদয়ে রাজপরিবারের প্রতি ভালোবাসা যাতে চিরস্থায়ী হয়, তা নিশ্চিত করতে সারা জীবন সচেষ্ট ছিলেন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ।
রাজপরিবারের প্রতি ব্রিটেনের মানুষের আগ্রহ, উদ্দীপনা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও ২০০২ সালে মহাসমারোহে উদ্যাপিত হয় রানির সিংহাসন আরোহণের সুবর্ণজয়ন্তী, এরপর রানির ৮০তম জন্মদিনে উইন্ডসরের রাস্তায় সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাঁর বিশেষ সাক্ষাৎ-সফর, রানি ও প্রিন্স ফিলিপের বিয়ের ৬০তম বার্ষিকী উৎসব এবং ২০১১ সালে রানির নাতি উইলিয়াম ও ক্যাথরিনের বিয়ে ও ২০১২–তে রানির সিংহাসন আরোহণের হীরকজয়ন্তী। সবশেষ ২০২২-এর জুন মাসে মহাসমারোহে উদ্যাপিত হয়েছে রানির সিংহাসন আরোহণের ৭০তম বার্ষিকী। এসব উদ্যাপন উপলক্ষে জনতার উচ্ছ্বাস ও অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতো ছিল।
রানির মৃত্যুর পর তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে মানুষকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আগে কয়েক দিন ধরে সর্বস্তরের মানুষ রানির প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানান। অপেক্ষমাণ মানুষের সারি কয়েক কিলোমিটার দূরের টেমস নদী পর্যন্ত গড়ায়। শেষ পর্যন্ত কর্তৃপক্ষকে মানুষকে আর অপেক্ষা না করার অনুরোধ করতে হয়। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের অন্তিমযাত্রার দৃশ্য সরাসরি দেখতে অনেকে লন্ডনের রাস্তার পাশে রাত কাটিয়েছেন।
বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের উপস্থিতি
রানির শেষকৃত্য ঘিরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, প্রধানমন্ত্রী, রাজা, বাদশাহ মিলিয়ে দুই হাজারের বেশি অতিথিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। তাঁদের নিরাপত্তার জন্য নেওয়া হয় বিশেষ ব্যবস্থা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান যুক্তরাজ্যে এসে রানিকে শ্রদ্ধা জানান। বিশেষ অতিথিদের মিলনমেলায় পরিণত হয় লন্ডন।
যেখানে অভিষেক-বিয়ে সেখানেই অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া
গত ৮ সেপ্টেম্বর মৃত্যুর পরদিন থেকে টানা ১০ দিনের জাতীয় শোক পালন শেষে ১৯ সেপ্টেম্বর আড়ম্বরপূর্ণ আয়োজনে ও রাজকীয় মর্যাদায় তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হয়। ৭০ বছর আগে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে তাঁর আনুষ্ঠানিক রাজ অভিষেক হয়েছিল। তাঁর বিয়ের অনুষ্ঠানও হয়েছিল একই গির্জায়। ১৯ সেপ্টেম্বর রানির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াও সেখানেই হয়েছে।
১৯ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা ৭টায় পরিবারের সদস্য ও ঘনিষ্ঠজনদের উপস্থিতিতে সেন্ট জর্জেস চ্যাপেলের অভ্যন্তরে অবস্থিত রাজা ষষ্ঠ জর্জ মেমোরিয়াল চ্যাপেল সমাধিতে রানিকে সমাহিত করা হয়। রানির সমাধির ওপর মার্বেলের ফলকে খোদাই করে লেখা হয়েছে, ‘দ্বিতীয় এলিজাবেথ ১৯২৬-২০২২’।
মরণোত্তর রেকর্ড
রানির সিংহাসনে অভিষেক অনুষ্ঠান টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার হয়েছিল। তাঁর রাজকীয় শেষকৃত্য অনুষ্ঠানও সম্প্রচার হয়েছে সরাসরি।
তবে অভিষেকের সম্প্রচার ছিল যুক্তরাজ্যের মধ্যে সীমিত, আর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠান প্রচার হয়েছে বিশ্বব্যাপী। এটি ছিল প্রথম কোনো ব্রিটিশ রাজা বা রানির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সরাসরি টেলিভিশন সম্প্রচার।
রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ শুধু সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি রাজ শাসকই নন, সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ রাজ শাসক হিসেবে মৃত্যুবরণ করেছেন।
রানির মৃত্যুর পর প্রথম বড়দিন
রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর পর তাঁর বড় ছেলে ৭৩ বছর বয়সী তৃতীয় চার্লস প্রথা অনুযায়ী নতুন রাজা হন। তাঁর স্ত্রী ক্যামিলা হন ‘কুইন কনসর্ট’। রানির মৃত্যুর পর ১০ দিন ধরেই তাঁর শেষকৃত্য আর নতুন রাজার দায়িত্বগ্রহণের বিষয়টি সারা বিশ্বে আলোচিত ছিল। রাজা চার্লসের পর সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হিসেবে রয়েছেন বড় ছেলে প্রিন্স উইলিয়াম। নিজেদের মধ্যে মনোমালিন্য সত্ত্বেও দাদি এলিজাবেথের মৃত্যুর পর দুই নাতি প্রিন্স উইলিয়াম ও প্রিন্স হ্যারিকে একসঙ্গে দেখা গেছে। একসঙ্গে দেখা গেছে উইলিয়ামের স্ত্রী কেট মিডলটন ও হ্যারির স্ত্রী মেগান মার্কেলকেও।
২০২১ সালের ডিসেম্বরে দেওয়া বড়দিনের বার্তাটির বেশির ভাগ জুড়ে প্রয়াত স্বামী প্রিন্স ফিলিপকে স্মরণ করেছিলেন রানি। ২০২১ সালের বড়দিনে সম্প্রচারিত অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে রানির শুভেচ্ছা বার্তা সবচেয়ে বেশি বার দেখানো হয়েছিল। প্রায় ৯০ লাখ দর্শক অনুষ্ঠানটি দেখেছেন। রানির মৃত্যুর পর এবারই প্রথম বড়দিন উদ্যাপন করছে যুক্তরাজ্যের মানুষ। ১৯৫৭ সাল থেকে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ টিভিতে বড়দিনের শুভেচ্ছা বার্তা দিয়ে আসছিলেন। রানির মৃত্যুর পর এখন থেকে সে দায়িত্বটি সামলাবেন রাজা তৃতীয় চার্লস।
সূত্র: রয়টার্স, বিবিসি, এএফপি