উত্তর সাগরে রুশ জাহাজের রহস্যজনক চলাচলে পশ্চিমাদের নতুন শঙ্কা

অ্যাডমিরাল ভ্লাদিমিরিস্কি নামের এই রুশ জাহাজ থেকে উত্তর সাগরে যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশের স্থাপনা সম্পর্কে গোপনে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে
ছবি: ভিডিও থেকে নেওয়া

উত্তর সাগরে বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প ও সাবমেরিন কেব্‌ল নিশানা করে পরিকল্পিতভাবে নাশকতা চালানোর জন্য একটি কর্মসূচি হাতে নিয়েছে রাশিয়া। এটি সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে মস্কো থেকে। ডেনমার্ক, নরওয়ে, সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারমাধ্যমের এক যৌথ অনুসন্ধানের ভিত্তিতে সম্প্রতি এই অভিযোগ তোলা হয়েছে।

বলা হয়েছে, উত্তর সাগরে রাশিয়ার একটি নৌবহর আছে। মাছ ধরার ট্রলার ও গবেষণায় নিয়োজিত জাহাজের ছদ্মবেশে এগুলো চলাচল করছে। নৌযানগুলোয় সমুদ্র তলদেশে নজরদারি চালানোর যন্ত্র ও প্রযুক্তি রয়েছে। কোথায় কোথায় নাশকতা চালানো যেতে পারে, তার তালিকা করে এসব নৌযান।

উত্তর সাগর ইউরোপীয় মহীসোপানের ওপর অবস্থিত। এটি দক্ষিণে ইংলিশ চ্যানেলের মাধ্যমে আটলান্টিক মহাসাগরের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। আর এর উত্তরে রয়েছে নরওয়েজিয়ান সাগর। যুক্তরাজ্য, ডেনমার্ক, নরওয়ে, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম ও ফ্রান্সে এর উপকূল রয়েছে।

ডেনমার্কের একজন কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স কর্মকর্তা বলছেন, পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে যদি রাশিয়ার পুরোদমে সংঘাত শুরু হয়, সে জন্য নাশকতার ছক করা হচ্ছে। এদিকে নরওয়ের গোয়েন্দাপ্রধান বলেছেন, এ কর্মসূচিকে রাশিয়ার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে এবং মস্কো থেকে এটা সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে।

চার দেশের চার রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারমাধ্যম বলেছে, রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের যেসব তথ্য তাদের হাতে এসেছে, সেসব বিশ্লেষণ করে দেখা কথিত ‘ভৌতিক’ জাহাজ উত্তর সাগরের জলসীমায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। এসব জাহাজের ট্রান্সমিটারগুলো বন্ধ করে রাখা হয়, যাতে কেউই জাহাজগুলোর অবস্থান শনাক্ত করতে না পারে।

সম্প্রচারমাধ্যমগুলো যে অনুসন্ধান চালিয়েছে, তার কেন্দ্রে ছিল অ্যাডমিরাল ভ্লাদিমিরিস্কি নামের একটি রুশ জাহাজ। রুশ সরকারের তথ্য অনুযায়ী, এটি সমুদ্রবিষয়ক গবেষণার কাজে নিয়োজিত জাহাজ। তবে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, আদতে এটি সে ধরনের কোনো জাহাজ নয়। প্রকৃতপক্ষে এটি রাশিয়ার গোয়েন্দা জাহাজ।

সম্প্রচারমাধ্যমগুলো এ নিয়ে যে তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছে, সেখানে যুক্তরাজ্যের নৌবাহিনীর সাবেক একজন বিশেষজ্ঞের মাধ্যমে রাশিয়ার জাহাজের গতিবিধির ওপর নজর রাখা হয়েছে। তাতে দেখা যায়, রুশ জাহাজটি একটি মিশনের অংশ হিসেবে যুক্তরাজ্য ও নেদারল্যান্ডসের উপকূলে সাতটি বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্পের পাশ দিয়ে চলাচল করে। বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্পের কাছাকাছি গেলে জাহাজটির গতি কমে যেত। এতে আরও বলা হয়, ট্রান্সমিটার বন্ধ করে প্রায় এক মাস ধরে রুশ জাহাজটি এ মিশন চালিয়েছে।

একজন সাংবাদিক যখন ছোট একটি নৌকায় করে জাহাজটির কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করেন, তখন মাস্ক পরিহিত একজন ব্যক্তি আগ্নেয়াস্ত্র হাতে সামনে আসেন।
গত বছর ওই জাহাজকে স্কটল্যান্ডের উপকূলেও দেখা গিয়েছিল বলে জানা গেছে। রুশ জাহাজটি ১০ নভেম্বর মোরে ফার্থে প্রবেশ করে এবং ধীরে ধীরে পশ্চিম দিকে যাওয়ার আগে লসিমাউথ থেকে প্রায় ৩০ নটিক্যাল মাইল পূর্বে এটি দেখা যায়। লসিমাউথ ব্রিটিশ নৌবাহিনীর জলসীমায় টহল দেওয়া বিমানের বহরের ঘাঁটি।

গত ফেব্রুয়ারিতে নেদারল্যান্ডসের গোয়েন্দা সংস্থা অস্বাভাবিক একটি সতর্কতা জারি করে। সামুদ্রিক অবকাঠামোর স্বাভাবিক কার্যক্রমে ব্যাঘাত এবং নাশকতার ব্যাপারে প্রস্তুত থাকতে এ সতর্কতা জারি করা হয়। দেশটির সামরিক গোয়েন্দাপ্রধান বলেন, উত্তর সাগরে বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্পের কাছে একটি রুশ জাহাজ শনাক্ত হয়েছে। সেটি স্থাপনাগুলোর নকশা তৈরি করছিল।

জেনারেল ইয়ান সুইলেন্স বলেন, ‘উত্তর সাগরে জ্বালানিব্যবস্থা কীভাবে কাজ করে, তা বের করার জন্য সাম্প্রতিক মাসগুলোতে রাশিয়াকে চেষ্টা চালাতে দেখছি আমরা। এর আগে কখনো এমনটা দেখা যায়নি।’ জেনারেল ইয়ান আরও জানান, জাহাজটির মাধ্যমে রাশিয়া কোথায় কী অবকাঠামো আছে, তা চিহ্নিত করছে।

তবে এখন পর্যন্ত রাশিয়ার বিরুদ্ধে নাশকতা চালানোর পরিকল্পনার অভিযোগ নিয়ে অনেক গোয়েন্দা তথ্য পাওয়া গেলেও সত্যিকার অর্থে নাশকতা চালানোর প্রমাণ খুব কম। এ অনুসন্ধানের পর ধারণা করা হচ্ছে, গত বছর নরওয়ের সালবার্ড দ্বীপপুঞ্জে সমুদ্রে তলদেশে থাকা একটি ডেটা কেব্‌ল বিচ্ছিন্ন হওয়ার ক্ষেত্রে রাশিয়ার হাত থাকতে পারে।

স্যাটেলাইট কমিউনিকেশনের ক্ষেত্রে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক গ্রাউন্ড স্টেশনের জন্য এ ডেটা কেব্‌ল ব্যবহার করা হয়। নরওয়ের পুলিশ তখন জানিয়েছিল, এ নাশকতার পেছনে কোনো মানুষের হাত থাকতে পারে। তবে এই কেবলে নাশকতার ঘটনায় নরওয়ের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কাউকে অভিযুক্ত করা হয়নি।

১৩ এপ্রিল গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে রাশিয়ার ১৫ জন কর্মকর্তাকে বহিষ্কার করে নরওয়ে। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে রুশ বাহিনী ইউক্রেনে হামলা শুরু করার পর থেকে ধারাবাহিকভাবে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ যে রুশ কর্মকর্তাদের বহিষ্কার করছে, তার সবচেয়ে সাম্প্রতিক ঘটনা ছিল নরওয়েতে রুশ কর্মকর্তাদের বহিষ্কার।

গত বছরের অক্টোবরে স্কটল্যান্ডের শেটল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জে সমুদ্র তলদেশে থাকা একটি কেব্‌ল বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর পুলিশ এটাকে একটি বড় ধরনের ঘটনা ঘোষণা করেছিল। এই ঘটনায় দ্বীপপুঞ্জটির সঙ্গে স্কটল্যান্ডের মূল ভূখণ্ডের যোগাযোগব্যবস্থায় মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটে। তখন ঘটনাটির জন্য মাছ ধরার ট্রলারকে দোষারোপ করা হয়েছিল।

তবে নাশকতার সবচেয়ে স্পষ্ট ও উল্লেখ করার মতো ঘটনা ঘটে গত বছরের সেপ্টেম্বরে। রাশিয়া থেকে ইউরোপে গ্যাস সরবরাহের জন্য ব্যবহৃত পাইপলাইন নর্ড স্ট্রিমে হামলা হয়। সে সময় অনেকে এর জন্য রাশিয়াকে দায়ী করে। তবে ইউক্রেনপন্থীসহ অন্যদের নামও আসে। নর্ড স্ট্রিমে নাশকতা নিয়ে তদন্ত এখনো চলছে।