স্পেনে এক নির্বাচনকে ঘিরে অনেক চাহিদা
স্পেনের মাদ্রিদ শহরের মাঝ বরাবর এগিয়ে চলেছে মিছিলটি। ৫০ হাজার ক্ষিপ্ত নাগরিক সমবেত হয়েছেন মিছিলে। সবাই এসেছেন বিভিন্ন গ্রাম থেকে। নানা রঙের ব্যানার ও প্ল্যাকার্ড বহন করছেন তাঁরা। নানা ছন্দে লেখা স্লোগানগুলোয় ফুটে উঠেছে বিচিত্র সব চাহিদার কথা। বিয়ামাইয়োরে দেল রিওর দাবি একটি ঔষধালয়, ওরিওয়েলা দেল ত্রেমেদালের প্রয়োজন দ্রুতগতির ইন্টারনেট, আরানদা দেল দুয়েরো চান উন্নত অবকাঠামো। তাঁরা সবাই ২৮ এপ্রিলে অনুষ্ঠেয় দেশটির জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে এ আন্দোলনের ডাকে সাড়া দিয়েছেন।
ইউরোপের দেশ হলেও স্পেনে নগরায়ণের শুরুটা হয়েছে একটু দেরিতে, তবে বিস্তার ঘটেছে দ্রুত। এ সময় হাজারো মানুষ গ্রাম ছেড়ে ছুটেছেন শহুরে জীবনের স্বাদ নিতে। এতে গ্রামের পরে গ্রাম ধুঁকতে থাকে জনশূন্যতায়, যে ধারা এখনো বিদ্যমান। অন্যদিকে, গ্রামে যাঁরা রয়ে যান, তাঁরাও পেতে চান আধুনিক জীবনের সুযোগ-সুবিধা। সে দাবিতেই নেমে এসেছেন রাজপথে।
দ্য ইকোনমিস্টকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সমাজকর্মী পাওলা সিলেস বলেন, তাঁদের নিজেদের স্পেনের নাগরিক মনে হয় না। মনে হয় যেন তাঁরা পরিত্যক্ত। তাঁদের প্রয়োজন ডাক্তার। কিন্তু সেখানে সেটা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। পলের বাড়ি লাস পেরেস ডেল ক্যাসতেলটেতে। ৪২ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের ক্যাসতেলটে স্পেনের উত্তর–পূর্বের আরাগন অঞ্চলে অবস্থিত। এই আয়তনে ২০০৪ সালে জনসংখ্যা ছিল ৮৬ জন, যা বর্তমানে নেমে এসেছে ৫৭-তে।
দেশের মোট ৩৫০ আসনের ৯৯টি গঠিত শূন্য হতে থাকা ওই সব পল্লি অঞ্চল নিয়ে। তবে এসব অঞ্চল দীর্ঘদিন রক্ষণশীল পিপলস পার্টির ভোটব্যাংক হিসেবে ধরা হতো। কিন্তু ২০১৬ সালের নির্বাচনে সেখানে বিভক্তি দেখা দিয়েছে।
অন্যদিকে, গত নির্বাচনে কোনো দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় জোট সরকার গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু জোট সরকার পরিচালনায় বেশ বেকায়দায় পড়েছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেভ। কাতালনের স্বায়ত্তশাসনের দাবির প্রতি উদারপন্থী হিসেবে পরিচিত সানচেভের দল সোশ্যালিস্ট ওয়ার্কার পার্টি। ফলে, কাতালনের স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনের পরে তিনি পার্লামেন্টে বাজেট পাস করাতে ব্যর্থ হন। এতে মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগে নতুন নির্বাচন দিয়ে বসেন তিনি। ২৮ এপ্রিল ওই নির্বাচন হবে। আর এ জন্য শূন্য হতে থাকা স্পেনের ওই ৯৯ আসন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। যে দল সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করবে, তাদেরই নতুন সরকার গঠনে সম্ভাবনা বাড়বে।
এ জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও হঠাৎ এসব এলাকা নিয়ে আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। দলগুলো নেমেছে নানা ঢঙের প্রচারণায়, দিচ্ছেন কাঁড়ি কাঁড়ি প্রতিশ্রুতি। যেমন ক্ষমতাসীন সোশ্যালিস্ট পার্টির নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেভ গত মাসে এসব এলাকার উন্নয়নে ৭০টি প্রস্তাব দিয়েছেন। তাঁর প্রস্তাবের মধ্যে এলাকাগুলোর জনসংখ্যার শূন্যতা রোধে ব্যবস্থা নেওয়া, উন্নত ইন্টারনেট সেবা দেওয়াসহ সামরিক স্থাপনা গড়ারও প্রতিশ্রুতি রয়েছে।
দেশটির মধ্যডানপন্থী দল সিউদাদোনসের নেতা আলবার্ট রিভেরা আয়কর ছাড়ের ঘোষণা দিয়েছেন। একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে, রিভেরা ট্রাক্টরের ওপর চড়ে বসেছেন। পিপলস পার্টির নেতা পাবলো কাসাদো খেতে দাঁড়িয়ে গভীর মনোযোগে টমেটো পর্যবেক্ষণ করছেন। নতুন তৈরি হওয়া কট্টর ডানপন্থী ভেস্ক নামক দলের সঙ্গে গলা মিলিয়ে পিপলস পার্টির নেতারাও বলছেন, যেকোনোভাবেই হোক, শিকার ও ষাঁড়ের লড়াইকে তাঁরা রক্ষা করবেন।
তবে প্রশ্ন হলো, আদৌ এসব উদ্যোগ স্পেনেরও গ্রামগুলোকে জনশূন্য হওয়া থেকে রক্ষা করতে পারবে? দেশটিতে ২০১৬ সালে সর্বোচ্চ সংখ্যায় বিক্রীত বই ছিল ‘লা স্পেনা ভ্যসিয়া’ বা শূন্য স্পেন নামের। বইটির লেখক সার্জিও ডেল মলিনো যুক্তি দেখান, এটা কখনো পূর্ণ হবে না। তিনি বলেন, শহুরে জীবনের স্বাদ আস্বাদনের যে প্রবণতা, তা স্পেনের জনগণের মধ্য ঐতিহাসিক কাল থেকে বিরাজমান। তাই অল্প সংখ্যায় জনগণের জন্য নাগরিক সেবা বাড়াতে গেলে সেটা শুধু বাজেটের ওপর চাপ বাড়াবে। আদতে কোনো ফল পাওয়া যাবে না। অন্যদিকে, ওই ব্যয়ের চাপ রাজধানী মাদ্রিদের ওপর পড়বে। ব্যাহত হবে রাজধানীর নাগরিক সেবা। আর এটা ধীরে ধীরে মাদ্রিদের বাসিন্দাদের ঠেলে দিতে পারে আন্দোলনের দিকে, ফ্রান্সের যেমনটা দেখা গেছে ‘হলুদ ভেস্ট’ আন্দোলনে।