রুশ ধনকুবের আব্রামোভিচের গ্রহণযোগ্যতা ইউক্রেনেও

রাশিয়ার ধনকুবের রোমান আব্রামোভিচ।
ফাইল ছবি: রয়টার্স

রাশিয়ার ধনকুবের রোমান আব্রামোভিচ বিশ্বজুড়ে পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছিলেন যুক্তরাজ্যের ফুটবল ক্লাব চেলসির মালিকানা কিনে। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কারণে তাঁর ওপরও নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। জব্দ করা হয়েছে তাঁর সম্পদও। রুশ এই ধনকুবের নতুন করে আলোচনায় এসেছেন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের সমঝোতা আলোচনায় উপস্থিতির মধ্য দিয়ে।

মঙ্গলবার তুরস্কের ইস্তাম্বুল শহরে রাশিয়া-ইউক্রেনের প্রতিনিধি দলের সমঝোতা বৈঠকে দেখা যায় আব্রামোভিচকে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেছেন তিনি।

তুরস্কের ইস্তাম্বুল শহরে মঙ্গলবার রাশিয়া-ইউক্রেনের শান্তি আলোচনায় দেখা যায় আব্রামোভিচকে।
ছবি: রয়টার্স

গত শতকের নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রাশিয়ার যাঁরা বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন, তাঁদের একজন আব্রামোভিচ। ১৯৯১ সাল থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ছিলেন বোরিস ইয়েলৎসিন। তাঁর সঙ্গে সখ্য গড়ে ক্রেমলিনেও ব্যাপক প্রভাব তৈরি করেন আব্রামোভিচ।

বোরিস ইয়েলৎসিনের হাত ধরেই প্রথমে রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ও পরে ২০০০ সালে প্রেসিডেন্ট হন পুতিন। তাঁকে যাঁরা সমর্থন দেন, তাঁদের একজন আব্রামোভিচ। প্রেসিডেন্ট হিসেবে পুতিনের ক্ষমতায় বসার বছরেই রাশিয়ার চুকোৎকার অঞ্চলের গভর্নর নির্বাচিত হন তিনি। ২০০৮ সালে গভর্নরের পদ ছাড়েন আব্রামোভিচ।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের আলোচনায় একজন মধ্যস্থতাকারী হিসেবে আব্রামোভিচের ভূমিকা নিয়ে কথা বলেছেন রাশিয়ার বিরোধী দলীয় নেতা গেনাদি গুদকভ। দেশটির পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ ডুমার সদস্য হিসেবে তিন মেয়াদে দায়িত্ব পালন করা এই রাজনীতিবিদ এখন নির্বাসনে রয়েছেন। তিনি আল-জাজিরাকে বলেন, ‘আব্রামোভিচের একটি চমত্কার গুণ রয়েছে। ভবিষ্যতে কী ঘটছে, তা তিনি বুঝতে পারেন। ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ধারণা করার বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে তাঁর।’

২০০৫ সালে ক্রেমলিনে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাতে আব্রামোভিচ।
ছবি: রয়টার্স

আব্রামোভিচকে নিয়ে ইউক্রেনেরও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়া রাশিয়ার ধনকুবেরদের তালিকায় তাঁকে না রাখতে গত ২৩ মার্চ মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে বিশেষ অনুরোধ করেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, রাশিয়ার সঙ্গে শান্তি আলোচনায় আব্রামোভিচের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।

শান্তি আলোচনায় আব্রামোভিচের উপস্থিতি নিয়ে তাত্ক্ষণিকভাবে কোনো মন্তব্য করেনি জেলেনস্কির দপ্তর। তবে ইস্তাম্বুলে রাশিয়ার এই ধনকুবেরের উপস্থিতি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের দল সার্ভেন্ট অব দ্য পিপল পার্টির এক রাজনীতিক অবাক হয়েছেন। তিনি বলেন, ‘এটা পুরোপুরি বিস্ময়কর। এ নিয়ে কী বলব, তা বুঝে উঠতে পারছি না।’

বিশ্লেষকেরা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন আলোচনায় কেন আব্রামোভিচ অংশ নিলেন-এই প্রশ্নের জবাব রয়েছে ২০০৮ সালে চুকোৎকার অঞ্চলের গভর্নর হিসেবে মেয়াদ শেষের পর তাঁর নেওয়া সিদ্ধান্তে। এরপর ক্রেমলিনের বলয় থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন আব্রামোভিচ। এমনকি হাতেগোনা কয়েকজন ধনকুবের যাঁরা রাশিয়ায় থেকে সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে ব্যবসা চালিয়ে যান, তাঁদের এড়িয়ে চলা শুরু করেন তিনি।

গেনাদি গুদকভ বলেন, ‘তিনি (আব্রামোভিচ) পুতিনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে এখন অতোটা গভীরভাবে সংশ্লিষ্ট নেই। রাশিয়ার বাদবাকি ধনকুবেরদের সঙ্গে দূরত্ব গড়ে তুলেছেন। এসবের মধ্য দিয়ে দেশের বাইরে খ্যাতি অর্জন ও ভাবমূর্তি তৈরির চেষ্টা করেছেন।’

এতো সবকিছুর পরও পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা এড়াতে পারেননি আব্রামোভিচ। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন দুই পক্ষের কাছেই একজন বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তি হিসেবে গণ্য হয়েছেন। ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভভিত্তিক গবেষক অ্যালেস্কি কুশচ আল-জাজিরাকে বলেন, ‘আব্রামোভিচ পশ্চিমা দেশগুলো ও রাশিয়ার অভিজাতদের মধ্যে সেতুবন্ধন হিসেবে আছেন।’

অ্যালেস্কি কুশচ বলেন, রাশিয়ার অন্য ধনকুবেরদের হয় রাশিয়া বা ইউক্রেন, কোনো না কোনো পক্ষ অবিশ্বাস করে। সেখানে আব্রামোভিচ সব পক্ষের কাছেই পছন্দের ব্যক্তি।
জটিল সব পরিস্থিতিতে সঠিক পথ দেখনোর ক্ষেত্রে আব্রামোভিচের সক্ষমতার প্রশংসা করেছেন তাঁর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীরাও। এমনই একজন আলেকসান্দার কোরঝাকভ। প্রেসিডেন্ট ইয়েলৎসিনের নিরাপত্তা বিষয়ক প্রধান ছিলেন তিনি।

গত শতকের নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে আব্রামোভিচের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়েছিলেন কোরঝাকভ। তিনি বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের মধ্যে আব্রামোভিচ সব সময় সম্মান পেয়ে এসেছেন। তিনি সব সময় কথা রেখেছেন। আর কখনও কারোর সম্পদ মেরে দেননি।’

মধ্যস্থতাকারী হিসেবে দক্ষতার পাশাপাশি দুঃখ-কষ্ট ও সফলতা মিলিয়ে আব্রামোভিচের একটি ব্যক্তিগত ইতিহাস রয়েছে। তাঁর নানা-নানি ছিলেন ইহুদি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তাঁরা তত্কালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের অধীনে থাকা ইউক্রেন থেকে রাশিয়ায় পালিয়ে এসেছিলেন। আব্রামোভিচের বয়স তিন বছর হওয়ার আগেই তাঁদের মৃত্যু হয়।

কিশোর বয়সে আব্রামোভিচ মস্কোর রাস্তায় প্লাস্টিকের খেলনা ফেরি করতেন। সেখান থেকেই ধীরে ধীরে রাশিয়ার সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিদের একজন হয়ে ওঠেন। এ সময় ইউক্রেনের ইহুদি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন তিনি।

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিও রুশ ভাষাভাষী ইহুদি পরিবার থেকে এসেছেন।
ইউক্রেনের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রতারণার শিকারও হয়েছিলেন আব্রামোভিচ। সে ঘটনা আবার নিজ মুখে শুনিয়েছিলেন পুতিন। ২০১৪ সালে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ইউক্রেনের ধনকুবের ইহর কলোমোইস্কির সঙ্গে একটি চুক্তি করেছিলেন আব্রামোভিচ। কয়েক শ কোটি ডলারও দিয়েছিলেন। তবে সেই অর্থ পকেটে ভরেন কলোমোইস্কি।

আরও পড়ুন

এ নিয়ে পরে প্রতিবেদন প্রকাশ করে দুর্নীতি নিয়ে কাজ করা ইউক্রেনীয় সংস্থা অ্যান্টিকোর। সেখানে বলা হয়, কলোমোইস্কির সঙ্গে আব্রামোভিচের ওই চুক্তি হয় ২০০৭ সালে। ইউক্রেনের এই ব্যবসায়ীর কাছ থেকে পাঁচটি কারখানা কিনতে চুক্তিটি করা হয়েছিল।

ইহর কলোমোইস্কির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল জেলেনস্কির। বেশ কয়েক বছর ধরে এই ব্যবসায়ীর নিয়ন্ত্রণে থাকা টেলিভিশন চ্যানেলে কৌতুক অভিনেতা জেলেনস্কির অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হয়। ইউক্রেনের বিগত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় কলোমোইস্কির চেনাজানা গণমাধ্যমগুলোও জেলেনস্কির সমর্থনে কাজ করেছিল।

আরও পড়ুন