রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ
রাশিয়ার সঙ্গে আপসে কার লাভ, কার ক্ষতি
রাশিয়ার দাবি মেনে আপসের প্রস্তাব দিয়েছেন হেনরি কিসিঞ্জার। কিসিঞ্জারের পরামর্শের মোক্ষম জবাব দিয়েছেন ভারতের সাংবাদিক শেখর গুপ্ত।
ইউক্রেনে রুশ হামলার ১০০ দিন পূর্ণ হচ্ছে আজ। রাশিয়ার হিসাবে যে যুদ্ধ ৪৮ ঘণ্টার বেশি স্থায়ী হওয়ার কথা নয়, তা চতুর্থ মাসে গড়িয়েছে। ইউক্রেনীয় প্রতিরোধের মুখে কিয়েভ ছেড়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে রুশ বাহিনী। পরিস্থিতি সামলাতে তাঁর সামরিক কৌশল বদলে ফেলেছেন প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।
পুরো ইউক্রেন দখল বা কিয়েভে একটি তাঁবেদার সরকার গঠনের পরিবর্তে এখন তাঁর লক্ষ্য শুধু পূর্বাঞ্চলের দনবাস এলাকার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা। অব্যাহত পশ্চিমা সামরিক সাহায্য সত্ত্বেও সর্বাত্মক রুশ হামলার মুখে ইউক্রেনের প্রতিরোধ দুর্বল হয়ে আসছে। প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি স্বীকার করেছেন, তাঁর দেশের ২০ শতাংশ ভূমি এখন রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে। এই অবস্থায় কোনো কোনো পশ্চিমা মহল যুদ্ধ বন্ধের পূর্বশর্ত হিসেবে রাশিয়ার সঙ্গে আপস রফার প্রস্তাব করেছে। যাঁরা রাশিয়ার দাবি মেনে আপসের পক্ষে, তাঁদের অন্যতম হলেন সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার।
৯৯ বছর বয়সী হেনরি কিসিঞ্জার আবার মুখ খুলেছেন। হ্যাঁ, সেই কিসিঞ্জার, বাংলাদেশ ও দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ায় গণহত্যার দোসর হিসেবে যুদ্ধাপরাধে যাঁর বিচার চেয়েছিলেন ব্রিটিশ সাংবাদিক ক্রিস্টোফার হিচেন্স। এবার কিসিঞ্জারের লক্ষ্য ইউক্রেন। দিন দশেক আগে সুইজারল্যান্ডের দাভোসে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের এক বৈঠকে তিনি ইউক্রেন যুদ্ধ সমাপ্তির এক ফয়সালা পেশ করেছেন।
তাঁর প্রস্তাব, অহেতুক হানাহানি না বাড়িয়ে ইউক্রেনের উচিত হবে রাশিয়ার দাবি মেনে নেওয়া, যে জায়গা সে দখল করেছে, তার মালিকানা ছেড়ে দেওয়া। তাঁর যুক্তি, রাশিয়া সামরিকভাবে ইউক্রেনের তুলনায় অনেক শক্তিশালী, এই যুদ্ধ অব্যাহত থাকলে রাশিয়াকে পরাস্ত করা তো দূরের কথা, নিজের অস্তিত্ব নিয়েই হুমকির মুখে পড়বে দেশটি। পশ্চিমা দেশগুলোকে তিনি এ–ও বলেছেন, রাশিয়াকে বিব্রতকর পরাজয়ের মুখে ঠেলে দেওয়া সুবুদ্ধির পরিচয় হবে না, কারণ এর ফলে আঞ্চলিক ভারসাম্য বিঘ্নিত হবে, অশান্তি বাড়বে, নিরাপত্তা পরিস্থিতি জটিলতর হবে। অন্য কথায়, তাঁর প্রস্তাব, রাশিয়ার সঙ্গে একটা আপসরফা করে নাও সবাই।
কিসিঞ্জার যে ফর্মুলাটি প্রস্তাব করেছেন, কূটনৈতিক ভাষায় তা হলো ‘স্ট্যাটাস কো–অ্যান্টি’। সোজা বাংলায়, পূর্বাবস্থায় ফিরে যাওয়া। এই ফর্মুলা অনুসারে, রাশিয়া ইতিমধ্যে ইউক্রেনের যেসব এলাকা দখল করে নিয়েছে, তা মেনে নিয়ে আলাপ-আলোচনা শুরু করতে হবে। তা না করে যদি রাশিয়ার দখলকৃত এলাকা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করা হয়, তাহলে ইউক্রেনের স্বাধীনতার বদলে উল্টো রাশিয়ার ঘাড়ে যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হবে, যা বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। ঠিক কোন কোন সীমানা ইউক্রেনকে রাশিয়ার হাতে ছেড়ে দিতে হবে, সে কথা দাভোসে কিসিঞ্জার খুব খোলাসা করে না বললেও মনে হয় তিনি ক্রিমিয়া ছাড়াও পুরো দনবাস অঞ্চলে রুশ দখলদারি মেনে নেওয়ার কথাই বলেছেন।
কিসিঞ্জার যে এই প্রথম রাশিয়ার দখলদারি মানার পক্ষে ওকালতি করলেন, তা নয়। ২০১৪ সালে রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখলের পর তিনি একই যুক্তিতে সে দখলদারত্ব মানার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি এ–ও বলেছিলেন, নিজের জাতীয় স্বার্থেই ইউক্রেনের উচিত হবে ন্যাটো ও রাশিয়া উভয় জোট থেকেই সমান দূরত্ব বজায় রেখে ‘নিরপেক্ষ’ অবস্থান গ্রহণ করা।
রাশিয়ার দখলদারত্ব মানার পক্ষে কিসিঞ্জারের এই অযাচিত ওকালতির একটি যথাযথ জবাব দিয়েছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি। তিনি বলেছেন, রাশিয়াকে খুশি করতে ইউক্রেনের নিজস্ব ভূখণ্ড ছেড়ে দেওয়ার যে পরামর্শ কিসিঞ্জার দিয়েছেন, তা থেকে স্পষ্ট তিনি ২০২২ সালে নয়, ১৯৩৮ সালে বাস করছেন। জেলেনস্কি বলেন, ‘তাঁর (কিসিঞ্জার) কথা শুনে মনে হয় তিনি দাভোসে বক্তব্য দিচ্ছেন না, তিনি ১৯৩৮-এর মিউনিখে বক্তব্য দিচ্ছেন।’
মিউনিখ ১৯৩৮
জার্মানির মিউনিখের উল্লেখ মোটেই অপ্রাসঙ্গিক নয়। ১৯৩৮ সালে এই শহরে স্বাক্ষরিত এক চুক্তিতে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও ইতালির তিন নেতা অ্যাডলফ হিটলারের দাবি মেনে চেকোস্লোভাকিয়ার সুদেতল্যান্ডের ওপর জার্মানির মালিকানা মেনে নেন। হিটলারের দাবি ছিল, সুদেতল্যান্ডে যে কয়েক লাখ জার্মান বংশোদ্ভূত মানুষের বাস, তারা নিগ্রহের শিকার। এদের রক্ষা করতে তিনি সামরিক অভিযানে প্রস্তুত। যদি ঝুটঝামেলা ছাড়া চেকোস্লোভাকিয়া ও তার পশ্চিমা মিত্ররা সে দাবি মেনে নেয়, তাহলে কোনো যুদ্ধ ছাড়াই সমস্যার সমাধান সম্ভব। হিটলার কথা দিলেন, এটাই হবে উত্তর ইউরোপে তাঁর শেষ অভিযান।
এর আগে অবশ্য হিটলার ‘বৃহত্তর জার্মানি’ গঠনের লক্ষ্যে প্রতিবেশী অস্ট্রিয়া দখলে নেন। সে দখলদারির সময় ইউরোপের অধিকাংশ দেশ মুখে কুলুপ এঁটে ছিল। সুদেতল্যান্ড ছেড়ে দিলে হিটলার অন্য কারও ওপর নজর দেবেন না, এ কথা মোটেই সত্য নয়, ইউরোপের সব মোড়ল তা খুব ভালো করেই জানতেন। তা সত্ত্বেও হিটলারের সঙ্গে আপস করার পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী নেভিল চেম্বারলিন বলেন, হিটলারকে মোকাবিলার জন্য যে সামরিক প্রস্তুতি দরকার, তাদের কারও তা নেই। সুদেতল্যান্ড হিটলারকে ছেড়ে দিলে তাঁকে আপাতত পোষ মানানো যাবে। এর ফলে যে সময় পাওয়া যাবে, তার মধ্যে সামরিক প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব হবে।
একই যুক্তিতে ১৯৩৯ সালে হিটলার ও স্তালিনের মধ্যে একটি অনাক্রমণ চুক্তি হয়েছিল। মলোতভ-রিবেনট্রপ চুক্তি নামে পরিচিত সেই আপসরফার মাধ্যমে হিটলারের ক্ষুধা মেটাতে সোভিয়েত নেতা স্তালিন পোল্যান্ড ও বাল্টিক রাজ্যসমূহের ওপর জার্মানির কার্যকর নিয়ন্ত্রণ মেনে নিয়েছিল। তাতে যে হিটলারের খিদে মেটেনি, সে তো আমরা খুব ভালো করেই জানি। বস্তুত, এই আপসরফার জন্য সবচেয়ে বেশি দাম দিতে হয়েছিল সেই সোভিয়েত ইউনিয়নকেই।
কিসিঞ্জারের আপস প্রস্তাব ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ঠিক আগে হিটলারকে তুষ্ট করার খোঁড়া চেষ্টার মধ্যে যে মিল রয়েছে, তা বলাই বাহুল্য। কিসিঞ্জারের এই ‘লজ্জাকর’ পরামর্শ প্রত্যাখ্যান করে প্রেসিডেন্ট জেনেলস্কি বলেছেন, এসব পণ্ডিত যা প্রস্তাব করছেন, তা হলো শান্তি নয়, মরীচিকা মাত্র। জেলেনস্কির অন্যতম উপদেষ্টা মিখাইল পদোলিয়াক বিষয়টি খোলাসা করে বলেছেন, ‘আমাদের ভূমির ওপর নিয়ন্ত্রণ ছাড়লে রাশিয়ার সঙ্গে শান্তি হবে বলে যাঁরা ভাবেন, তাঁরা আসলে নির্বোধের স্বর্গে বাস করেন।’ তিনি বলেন, এখন যুদ্ধ থামলেও কয়েক বছর পর রাশিয়া আবার থাবা বাড়াবে।
শেখর গুপ্তর কাল্পনিক চিত্রনাট্য
জেলেনস্কি বা পদোলিয়াক নন, কিসিঞ্জারের পরামর্শের মোক্ষম জবাবটি দিয়েছেন ভারতের নামজাদা সাংবাদিক শেখর গুপ্ত। তাঁর নিয়মিত পডকাস্ট ‘দি প্রিন্ট’-এ তিনি একটি বিকল্প চিত্রনাট্য প্রস্তাব করেছেন। এই প্রস্তাবিত চিত্রনাট্যে রাশিয়ার স্থলে চীন এবং ইউক্রেনের স্থলে ভারত। রাশিয়ার মতো চীনও পারমাণবিক অস্ত্রে সুসজ্জিত এক মহাশক্তিধর দেশ। অন্যদিকে ভারত চীনের তুলনায় নস্যি।
ধরা যাক, পশ্চিমে লাদাখ ও পূর্বে অরুণাচল প্রদেশে ভারতের সঙ্গে তার যে সীমান্ত বিরোধ রয়েছে, তার ফয়সালার লক্ষ্যে চীন বিপুল সৈন্যসামন্ত নিয়ে প্রতিবেশী দেশটি আক্রমণ করে বসল। একই সময় চীনকে মদদ দিতে কাশ্মীর সীমান্ত বরাবর হামলা চালাল পাকিস্তান। সামরিক শক্তিতে চীন ও পাকিস্তান যৌথভাবে ভারতের তুলনায় সাত গুণ অধিক শক্তিশালী। এত বিশাল সামরিক শক্তির সঙ্গে মোকাবিলা করা ভারতের একার পক্ষে অসম্ভব বা খুবই কঠিন। কয়েক সপ্তাহ যুদ্ধ চলার পর ভারতের অবস্থা বেহাল হয়ে উঠলে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং শান্তির প্রস্তাব পাঠালেন।
সে প্রস্তাবের মোদ্দা কথা, পূর্ব ও পশ্চিমে ইতিমধ্যে যে জায়গা তাঁরা দখল করে নিয়েছেন, ভারতকে তা মেনে নিতে হবে। লাদাখ, অরুণাচল প্রদেশ ও উত্তরাখন্ডের বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডের ওপর তার দাবির কথা চীন অনেক দিন থেকেই বলে আসছে। শান্তিব্যবস্থার অধীনে ভারতকে সে দাবি মেনে নিয়ে নতুন মানচিত্র আঁকতে হবে। এই সামরিক অভিযানের অপর সদস্য পাকিস্তান ভারতকে বাগে পাওয়া গেছে এই ভেবে গোঁফ পাকিয়ে জানাল, কাশ্মীরের ওপর ভারতের নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহার করে তা পাকিস্তানের হাতে ছেড়ে দিতে হবে।
তারা অবিবেচক নয় এ কথা প্রমাণের জন্য চীন ও পাকিস্তান জম্মুর ওপর ভারতের নিয়ন্ত্রণ মেনে নিতে সম্মত হলো। এমনকি লাদাখে যাওয়ার জন্য একটা যথাযোগ্য করিডোর দিতেও তারা প্রস্তুত বলে জানানো হলো।
ব্যস, এই সামান্য ছাড় দিলেই চীন ও পাকিস্তান যুদ্ধ থামিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সম্মত হবে।
শেখর গুপ্ত তাঁর এই কাল্পনিক চিত্রনাট্যটি আরও সম্প্রসারিত করে ইউক্রেনের চলতি অবস্থার সঙ্গে মিল নির্দেশ করেছেন। তাঁর নকশা অনুসারে, চীনের দাবির যৌক্তিকতার সপক্ষে ভারতকে নসিহত করতে কিসিঞ্জারের মতো আন্তর্জাতিক উকিলদের অভাব হলো না। তাঁরা উপযাচক হয়ে ভারতকে পরামর্শ দিলেন, এই সামান্য দাবি মেনে নাও। চীন ও পাকিস্তান উভয়েই পারমাণবিক শক্তিধর দেশ।
তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে তোমরা বাপু পারবে না। তারা তো বেশি কিছু চাইছে না, দুই দেশের সীমান্তবর্তী যে এলাকাগুলো তারা নিজেদের মনে করে, যেখানে তাদের নিজেদের লোক বাস করে, কেবল সেগুলো দাবি করছে। এমন ন্যায্য দাবি না মেনে একগুঁয়েমিপনার ফলে ভারতের জন্য মহাবিপর্যয় ডেকে আনা হবে। ভুলেও এমনটি কোরো না।
শেখর গুপ্তের প্রশ্ন, সত্যি সত্যি যদি এমন একটি পরিস্থিতির উদ্ভব হয়, তাহলে ভারত কী করবে? তাঁর সহজ উত্তর, ‘আমরা লড়াই করব, নিজের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য আপ্রাণ যুদ্ধ করব। আমরা মরব কিন্তু নতজানু হয়ে বাঁচব না। ঠিক যেমন ইউক্রেনের মানুষ এখন যুদ্ধ করছে।’
শুধু ইউক্রেন বা ভারত নয়, আত্মসম্মান রয়েছে এমন যেকোনো দেশই শিরদাঁড়া শক্ত করে দাঁড়াতে চাইবে। একা তাদের পক্ষে অসম কোনো যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়, তা আমরা জানি। সে জন্য খুবই জরুরি দুর্বল ও আক্রান্ত দেশের সঙ্গে ব্যাপক আন্তর্জাতিক সংহতি। জাতিসংঘের ভেতরে ও বাইরে ইউক্রেনের পক্ষে সে সংহতির প্রকাশ আমরা দেখেছি, যা এই অসম যুদ্ধ চালিয়ে যেতে তাকে বল দিয়েছে।
আজ হোক অথবা কাল, এই যুদ্ধ বন্ধের জন্য কূটনৈতিক আলাপ-আলোচনার উদ্যোগ নিতে হবে। সেই আলাপ-আলোচনায় ইউক্রেন যাতে কোণঠাসা হয়ে না পড়ে, সে জন্যও প্রয়োজন তার সমর্থনে আন্তর্জাতিক সংহতি। কিসিঞ্জারের মতো মোড়লদের কথায় যত কম কান দেওয়া যায়, ইউক্রেনের জন্য ততই মঙ্গলজনক হবে।
মিউনিখে হিটলারের সঙ্গে আপসরফা করে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ ঠেকানো যায়নি। সে শিক্ষা মাথায় রেখে ইউক্রেনের পক্ষে দাঁড়ানোই শান্তির পক্ষে সবচেয়ে বড় ঢাল।