গুপ্তচরবৃত্তি: ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যেই চলছে আরেক যুদ্ধ
রাশিয়া ও পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যে এক দশকের বেশি সময় ধরে চলা গুপ্তচরবৃত্তির লড়াই ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে আরও জোরালো হয়েছে। প্রকাশ্য যুদ্ধের পাশাপাশি চলছে গুপ্তচরবৃত্তির গোপন লড়াইও।
বিবিসির প্রতিবেদনে শনিবার বলা হয়েছে, রাশিয়া ও পশ্চিমাদের ‘গুপ্তচরবৃত্তি’র এই লড়াই শুরু হয় ২০১৪ সালে। তখন রাশিয়া ইউক্রেনের সেনাবাহিনীকে লক্ষ্যবস্তু করে; যা পশ্চিমা দুনিয়ার কাছে রুশ গোয়েন্দা সংস্থার ভূমিকাকে প্রকাশ্যে নিয়ে আসে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সাইবার হামলা বা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গুপ্ত হামলা—যেটিই হোক, তার মধ্য দিয়েও রুশ গোয়েন্দাদের গোপন কার্যক্রমের ধারণা পাওয়া যায়।
সাম্প্রতিক মাসগুলোয় পশ্চিমা বিভিন্ন দেশ রুশ গোয়েন্দা সংস্থাকে পাল্টা আঘাত করে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতি করার চেষ্টা করছে। রুশ গোয়েন্দা সংস্থা যেন গোপনে হামলা চালাতে না পারে, সেটাই পশ্চিমাদের লক্ষ্য। এ জন্য পশ্চিমা দেশগুলো থেকে পাঁচ শ রুশ কর্মকর্তার বহিষ্কারকে প্রতীকী হিসেবে ধরে নেওয়া যায়। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে এসব কর্মকর্তাকে ‘কূটনীতিক’ বলা হচ্ছে। কিন্তু মনে করা হয়, তাঁদের বেশিরভাগই ছদ্মবেশী গোয়েন্দা, গুপ্তচর। তাঁরা মূলত যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ও এজেন্ট নিয়োগের কাজে যুক্ত ছিলেন। পশ্চিমা দেশগুলোও রাশিয়ার অভ্যন্তরে এ ধরনের কার্যক্রম চালিয়ে থাকে।
পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ২০১৪ সাল থেকেই ইউরোপজুড়ে বিভিন্ন কার্যক্রমে যুক্ত রুশ গোয়েন্দাদের চিহ্নিত করতে কাজ করছে। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো মনে করে, ইউরোপজুড়ে ছড়িয়ে থাকা রুশ গোয়েন্দাদের মধ্যে রাশিয়ার সেনা গোয়েন্দা সংস্থার জিআরইউ ইউনিট ২৯১৫৫–এর সদস্যরাও আছেন। নাশকতা ও গুপ্তহত্যা তাঁদের অন্যতম কাজ।
ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা মনে করে, ইউরোপজুড়ে ছড়িয়ে থাকা রুশ গোয়েন্দাদের মধ্যে রাশিয়ার সেনা গোয়েন্দা সংস্থার জিআরইউ ইউনিট ২৯১৫৫–এর সদস্যরাও আছেন। নাশকতা ও গুপ্তহত্যা তাঁদের অন্যতম কাজ।
২০১৪ সালের পর ইউরোপজুড়ে সংঘটিত ছোট–বড় নাশকতার ঘটনাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল চেক প্রজাতন্ত্রে গোলাবারুদের মজুতে বিস্ফোরণ। ২০১৪ সালের এ নাশকতার ঘটনার পেছনে কারা দায়ী, সেটা খুঁজে বের করতে প্রায় সাত বছর লেগে যায়।
সেই হামলাকারীদের কয়েকজন ২০১৮ সালে যুক্তরাজ্যের সলসবেরিতে বিষ প্রয়োগের ঘটনায়ও জড়িত ছিলেন। একই দল চেক প্রজাতন্ত্রে এক বুলগেরীয় ব্যবসায়ীকে বিষ প্রয়োগের চেষ্টা করে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গুপ্তচরদের চিহ্নিত করা ব্যয়বহুল কাজ। যুক্তরাষ্ট্রের এক কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেন, ‘যত বেশি মানুষের (গোয়েন্দা) উপস্থিতি থাকে, তাঁরা কী নিয়ে কাজ করছে, সেটার ওপর নজর রাখা তত কঠিন হয়ে পড়ে।’ যদিও রাশিয়ায় কাজ করা পশ্চিমা গোয়েন্দারা সারাক্ষণই সেদেশের নজরদারিতে থাকেন। পশ্চিমারাও বসে নেই। এসব দেশের কর্মকর্তারা বলছেন, রুশ কর্মকর্তাদের বহিষ্কারাদেশ প্রতীকী ঘটনার চেয়েও বেশি কিছু।
ইউরোপীয় এক কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেন, আমরা রুশদের আক্রমণ করার ক্ষমতা, প্রতিবেশীদের ওপর তাদের হুমকি তৈরি করে এমন প্রকল্প বাস্তবায়নের সক্ষমতা কমানোর চেষ্টা করছি। অপর একজন কর্মকর্তা বলেন, রাশিয়ার বিরুদ্ধে সব পদক্ষেপই নেওয়া হচ্ছে পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে হুমকি কমাতে।
ইউরোপের কয়েকটি দেশ মনে করে, সেসব দেশে ব্যাপকসংখ্যক রুশ গুপ্তচরের উপস্থিতি আছে। এ জন্য সম্প্রতি জার্মানি ৪০ জন রুশ কর্মকর্তাকে বহিষ্কার করেছে। এক পশ্চিমা গোয়েন্দা কর্মকর্তা মনে করেন, জার্মানি আগেও আরও এক শ রুশ গোয়েন্দাকে বহিষ্কার করেছিল।
কিন্তু রুশ কর্মকর্তাদের সাম্প্রতিক এ ‘বহিষ্কারের মিছিলে’ নেই যুক্তরাজ্য। জানা গেছে, দেশটির কাছে সন্দেহভাজন মনে হয়েছিল, এমন অনেককেই সলসবেরিতে হামলার পরই যুক্তরাজ্য থেকে বের করে দেওয়া হয়। এর পরও যাঁরা রয়ে গেছেন, তাঁরা প্রাত্যহিক কাজের আড়ালে অন্য কোনো কার্যক্রম চালাচ্ছেন কি না, সেটা জানতে ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা ‘এমআই৫’ তাঁদের ওপর নজর রাখছে।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র রুশ কর্মকর্তাদের বহিষ্কার করেছে প্রত্যেকের বিরুদ্ধে আলাদা তদন্তের পর। মার্কিন কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা এফবিআই এসব তদন্ত পরিচালনা করেছে বলে বিবিসিকে নিশ্চিত করেন দেশটির এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা। দেশটির গোয়েন্দারা মনে করেন, অল্প সময়ের মধ্যে এত রুশ গুপ্তচরের বহিষ্কার রাশিয়ার কার্যক্রমকে দুর্বল করে দেবে।
এদিকে পশ্চিমাদের পাল্টা জবাব দিতে রাশিয়াও ৪০ জন জার্মান কর্মকর্তাকে বহিষ্কার করেছে; যা দেশটিতে কর্মরত জার্মান কর্মকর্তার এক–তৃতীয়াংশ।
২০১৪ সাল থেকে ইউক্রেন পশ্চিমা ও রুশ গোয়েন্দাদের গোপন অপারেশনের ঘাঁটি হয়ে ওঠে। বিবিসির প্রতিবেদনের তথ্য, উভয় পক্ষই ইউক্রেনে একই সঙ্গে নিজেদের এজেন্ট নিয়োগ ও প্রতিপক্ষকে সমূলে উৎপাটনের চেষ্টা করে। সঙ্গে উচ্চপদস্থ ইউক্রেনীয় কর্মকর্তাদের হত্যার অভিযানও চলতে থাকে। পশ্চিমা কয়েকটি দেশ রুশ গুপ্তচরদের ধরতে সাহায্য করতে ইউক্রেনকে প্রশিক্ষণ দেয়।
আগামী দিনগুলোয় এ ‘গুপ্তচরবৃত্তির যুদ্ধ’ আরও জোরালো হতে পারে, বিশেষ করে মস্কোর জন্য। ইউক্রেনের জন্য পাঠানো সামরিক সহায়তা রুশ গোয়েন্দাদের লক্ষ্যবস্তু হতে পারে। তবে ইউক্রেনে পশ্চিমা সহায়তা আসার অন্যতম পথ পোল্যান্ডে এমন কোনো সামরিক সহায়তার বহরে হামলা করা হবে খুব ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ, এর ফলে ন্যাটোর আইন অনুযায়ী, আত্মরক্ষায় পোল্যান্ডকে ন্যাটো জোটের সহায়তা করার সুযোগ তৈরি হবে; যা রাশিয়ার সঙ্গে সর্বাত্মক যুদ্ধের দিকে মোড় নিতে পারে।
পশ্চিমা গোয়েন্দারা আশঙ্কা করছেন, ২০১৪ সালে চেক প্রজাতন্ত্রে যে ধরনের গুপ্ত হামলা হয়েছে, আগামী দিনগুলোয় পোল্যান্ডেও একই ধরনের হামলার চেষ্টা হতে পারে। এক পশ্চিমা গোয়েন্দা কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেন, এ ধরনের গোপন অভিযান প্রায়ই এমন রুশদের মাধ্যমে পরিচালিত হয়, যাঁরা দেশে যাওয়া–আসার মধ্যেই থাকেন। বিভিন্ন দেশের রুশ দূতাবাস তাঁদের কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ করে দেয়।
ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে নানা আশঙ্কার মধ্যেও পশ্চিমা দেশগুলোর আশা, রুশ কর্মকর্তাদের বড় আকারের এই বহিষ্কারাদেশের পর প্রথাগত গুপ্তচরবৃত্তি এখন দেশটির জন্য বেশ কঠিন হয়ে উঠবে।