লিজ ট্রাসের দ্রুত পতনের পর যেভাবে অবিচল ঋষি সুনাক
তুলনামূলক কম যোগ্যতা নিয়ে বড় পদে বসলে তার ফল কী হয়, লিজ ট্রাস এর প্রকৃত উদাহরণ। যুক্তরাজ্যের ইতিহাসে সবচেয়ে কম সময় প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা এই রক্ষণশীল রাজনীতিকের জীবনের নানা পটভূমি বিশ্লেষণ করলে একটি অস্থিরমতি নারী চরিত্র বেরিয়ে আসে, যিনি তরতরিয়ে কেবল ওপরের সিঁড়ির দিকে উঠে গেছেন। কীভাবে, কার সাহায্যে উঠছেন, কেন উঠছেন, তা ভাবেননি। শেষ পর্যন্ত পরিণতি যা হওয়ার তা–ই হয়েছে। দ্রুত উল্লম্ফন থেকে হঠাৎ পতন।
বিদায়ী বছরে যুক্তরাজ্যের রাজনীতিতে ক্ষত রেখে বিদায় নেওয়া লিজ ট্রাস যেখানে ব্যর্থ হয়েছেন, সেখানেই সাফল্য দেখানোর ইঙ্গিত দিচ্ছেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক। যদিও তাঁর ওপর নিজ দল থেকেই প্রবল চাপ রয়েছে। অপরদিকে বিরোধী দল লেবার পার্টির দিক থেকে রয়েছে পার্লামেন্ট ভেঙে দ্রুত নির্বাচন দেওয়ার দাবি। এত কিছুর পরও অবিচল রয়েছেন ঋষি। সেটা কীভাবে সম্ভব হচ্ছে সার্বিকভাবে বিশ্লেষণ করা যাক।
লিজ ট্রাসের ভাই বিবিসিকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তাঁদের পরিবার দাবা খেলায় ভালো ছিল। কিন্তু খেলা শুরু হলেই লিজকে পাওয়া যেত না। কারণ, সে পরাজয়ের ভয়ে ভীত থাকত। হারতে চাইত না সে।
বামপন্থী থেকে রক্ষণশীল রাজনীতিক
আসল নাম এলিজাবেথ ট্রাস। কিন্তু পরিচিত হয়ে ওঠেন লিজ ট্রাস নামে। অক্সফোর্ডে জন্ম নেওয়া লিজ ট্রাসের বাবা গণিতের শিক্ষক, মা একজন নার্স। এই পরিবার বামপন্থী আদর্শে বিশ্বাসী ছিল। ছোটবেলায় লিজ ট্রাসও মায়ের হাত ধরে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিলে অংশ নিতে যেতেন। সে সময় ‘লৌহমানবী’ মার্গারেট থ্যাচার সরকার লন্ডনের পশ্চিমে রয়্যাল এয়ারফোর্সের ঘাঁটিতে যুক্তরাষ্ট্রের পরমাণুশক্তিসম্পন্ন সমরাস্ত্র বসানোর অনুমতি দিয়েছিল। ‘ক্যাম্পেইন ফর নিউক্লিয়ার ডিসআর্মামেন্ট’ নামে একটি পরমাণু অস্ত্রবিরোধী সংস্থা এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে ছিল। ছোটবেলায় এই সংগঠনের হয়েই মিছিলে অংশ নিতেন লিজ ট্রাস। আর বড় হয়ে লিজ ট্রাস সেই কনজারভেটিভ নেত্রী থ্যাচারের আদর্শ অনুসরণ করেই রাজনীতি করেছেন।
ছাত্রজীবনে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টিতে যোগ দেন লিজ ট্রাস। সে সময় (১৯৯৪) তিনি দলীয় ফোরামগুলোতে রাজতন্ত্র অবসানের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরতেন। পরবর্তী সময়ে তিনি আবার বলেছেন, তাঁর ওই সব বক্তৃতা ভুল ছিল। তাঁর মতে, যুক্তরাজ্যের ভবিষ্যৎ সাফল্যের জন্য রানি ও রাজপরিবারের ভূমিকা অপরিহার্য।
লিজ ট্রাসের ভাই বিবিসিকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তাঁদের পরিবার দাবা খেলায় ভালো ছিল। কিন্তু খেলা শুরু হলেই লিজকে পাওয়া যেত না। কারণ, সে পরাজয়ের ভয়ে ভীত থাকত। হারতে চাইত না সে।
প্রধানমন্ত্রী পদে শপথ নিয়েই সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের পথে নামেন লিজ ট্রাস। এমনিতে করোনার কারণে অর্থনীতি ছিল পিছিয়ে। এরপর ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন যখন ঝুঁকিতে, মূল্যস্ফীতির হার বাড়ছে হুহু করে, প্রবৃদ্ধি যখন ঋণাত্মক, তখন লিজ ট্রাস ঘোষণা করেন তিনি নিম্ন করহার এবং উচ্চ প্রবৃদ্ধির যুক্তরাজ্য গড়ে তুলবেন।
প্রথমে বামপন্থী, পরে উদারপন্থী, শেষে কট্টরপন্থী—এই হলো লিজ ট্রাসের রাজনৈতিক জীবন। ১৯৯৬ সালে তিনি রক্ষণশীল দল হিসেবে পরিচিত কনজারভেটিভ পার্টিতে যোগ দেন। এর ১০ বছর পর ২০০৬ সালে দক্ষিণ–পূর্ব লন্ডনের গ্রেনিচ থেকে তিনি পৌরসভার কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। মাঝে অবশ্য দুটি নির্বাচনে দাঁড়িয়ে পরাজয় বরণ করেন। ২০১০ সালে প্রথমবারের মতো এমপি নির্বাচিত হন লিজ ট্রাস। অর্থাৎ এমপি হওয়ার মাত্র ১২ বছরের মধ্যে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বনে যান তিনি!
লিজ ট্রাস কীভাবে প্রথমবার এমপি হলেন, তা যদি বিশ্লেষণ করি, তবে দেখতে পাব, সেখানে রয়েছে তাঁর প্রতি সাবেক প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের বিশেষ আনুকুল্য।
কলাগাছ দাঁড়ালেও কনজারভেটিভ পার্টির প্রার্থী পাস করবেন, দক্ষিণ-পশ্চিম নরফোকের এমন একটি নিরাপদ আসনে তাঁকে জিতিয়ে আনেন ক্যামেরন। ওই সময় একজন এমপির সঙ্গে তাঁর গোপন প্রেমের সম্পর্ক ফাঁস নিয়ে বিব্রত হয়ে পড়ে রক্ষণশীল শিবির। তারপরও সে ধাক্কা সামাল নিয়ে উতরে যান লিজ ট্রাস।
এরপর ডেভিড ক্যামেরন, থেরেসা মে এবং বরিস জনসনের মন্ত্রিসভায় সব মিলিয়ে ছয়টি দপ্তরের দায়িত্ব দেওয়া হয় তাঁকে। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে বিরোধিতার নামে নিজ দলকে বিব্রত করেছেন লিজ ট্রাস। ২০১৬ সালে যুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকবে কি না, সে প্রশ্নে গণভোটে তিনি ব্রেক্সিটের বিরোধিতা করেন, অর্থাৎ ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকার পক্ষে মত দেন তিনি। তাঁর যুক্তি ছিল, ব্রেক্সিটের পর ইইউর কাছে কোনো পণ্য বিক্রি করতে চাইলে সে ক্ষেত্রে আসবে আরও আইনকানুন। কিন্তু ভোটে ব্রেক্সিটপন্থীরা বিজয়ী হলে তিনি ইউটার্ন নেন। বলেন, বর্তমানে যেভাবে কাজকর্ম হয়, তা সংস্কারের সুযোগ সৃষ্টি করে দেবে ব্রেক্সিট।
যুক্তরাজ্যের মানুষদের একটি অংশের কাছে ঋষির সুনাম রয়েছে। বরিস জনসনের মন্ত্রিসভায় ২০২০ সালে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে পরিচিতি লাভ করেন তিনি। করোনাভাইরাসের সংক্রমণের সময় লকডাউনে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী ও শ্রমিকদের জন্য আর্থিক সহায়তা প্যাকেজের বন্দোবস্ত করে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।
সর্বশেষ বরিস জনসনের সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে ঘটে ন্যক্কারজনক ঘটনা। গত ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রুশ সৈন্য সমাবেশের প্রেক্ষাপটে কূটনৈতিক উপায়ে সমস্যা সমাধানের লক্ষে৵ রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভের সঙ্গে আলোচনায় বসেন লিজ ট্রাস। পরে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে তাঁকে পোডিয়ামে রেখেই নেমে যান লাভরভ। বলেন, ‘লিজ ট্রাসকে কিছু বলা একজন বধিরকে কিছু বলার মতো।’
এতকিছুর পরও প্রধানমন্ত্রী পদে দলীয় মনোনয়নে কনজারভেটিভরা লিজ ট্রাসকে বেছে নেন। এর কারণ দুটি। বরিস জনসনের বিপদের সময় তাঁর পাশে থাকা। এবং ভারতীয় বংশোদ্ভূত কাউকে (ঋষি সুনাক) ঠেকানো।
শেষ পর্যন্ত ৪৪ দিন দায়িত্ব পালনের পর ২০ অক্টোবর সরে যেতে হয় লিজ ট্রাসকে। কিন্তু কেন?
যে কারণে পদত্যাগ করতে হয় লিজ ট্রাসকে
প্রধানমন্ত্রী পদে শপথ নিয়েই সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের পথে নামেন লিজ ট্রাস। এমনিতে করোনার কারণে অর্থনীতি ছিল পিছিয়ে। এরপর ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন যখন ঝুঁকিতে, মূল্যস্ফীতির হার বাড়ছে হুহু করে, প্রবৃদ্ধি যখন ঋণাত্মক, তখন লিজ ট্রাস ঘোষণা করেন তিনি নিম্ন করহার এবং উচ্চ প্রবৃদ্ধির যুক্তরাজ্য গড়ে তুলবেন। তার প্রথম অর্থমন্ত্রী কোয়াজি কোয়ার্টেং যে ছোট বাজেট দেন তাতে ব্যাপক কর ছাঁটাইয়ের কথা ছিল। কিন্তু এর জন্য অর্থ সংস্থান করতে হাজার হাজার কোটি পাউন্ড ঋণ নিতে হতো।
ওই বাজেট ঘোষিত হওয়ার পর যুক্তরাজ্যের অর্থনীতিতে নজিরবিহীন সংকটের সৃষ্টি হয়। ব্রিটিশ মুদ্রা পাউন্ডের দর পড়ে যায়, তার সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুদের হার বৃদ্ধি, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি, জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যায়। কয়েক দিনের মধ্যেই গুরুতর চেহারা নেয় যুক্তরাজ্যের অর্থনীতি।
এমন অবস্থায় পদত্যাগ করেন অর্থমন্ত্রী কোয়াজি কোয়ার্টেং। নতুন অর্থমন্ত্রী জেরেমি হান্ট এসে আগের পরিকল্পনা বাতিল করে সংকট কিছুটা ঠেকানোর চেষ্টা করেন। প্রশ্ন ওঠে, লিজ ট্রাসের পরিকল্পনা যেখানে ব্যর্থ, সেখানে তিনি ক্ষমতায় থাকেন কী করে, কোন যুক্তিতে? নিজ দলের মধ্যেই শুরু হয় বিদ্রোহ। কনজারভেটিভ দলের অন্তত ১৩ জন এমপি প্রকাশ্যে তাঁর পদত্যাগ দাবি করেন। এমন অবস্থায় প্রথম অনড় ভাব দেখালেও ব্যর্থতা স্বীকার করে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হন লিজ ট্রাস।
ঋষি সুনাক যেভাবে অবিচল রয়েছেন
২০১৫ সালে মাত্র ৩৫ বছর বয়সে প্রথমবার পার্লামেন্ট সদস্য হন ঋষি সুনাক। এর সাত বছরের মধ্যেই তিনি প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন, কোনো রকম চ্যালেঞ্জ ছাড়াই। নেতা নির্বাচিত হওয়ার পর দলের নেতাদের ঋষি বার্তা দেন, তাঁর প্রথম কাজ দেশ ও দলকে ঐক্যবদ্ধ করা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, দলকে ঐক্যবদ্ধ করা তাঁর জন্য সহজ হবে না। বরিস জনসনের ব্যর্থতা ও পদত্যাগের জন্য দলের অনেকেই তাঁকে দায়ী করে থাকেন। তাঁদের কাছে ঋষি বিশ্বাসঘাতকের মতো কাজ করেছেন।
এমনিতে যুক্তরাজ্যের মানুষদের একটি অংশের কাছে ঋষির সুনাম রয়েছে। বরিস জনসনের মন্ত্রিসভায় ২০২০ সালে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে পরিচিতি লাভ করেন তিনি। করোনাভাইরাসের সংক্রমণের সময় লকডাউনে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী ও শ্রমিকদের জন্য আর্থিক সহায়তা প্যাকেজের বন্দোবস্ত করে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। সেই ইতিবাচক মনোভাব থেকে ঋষির জয়ের পর ডলারের বিপরীতে পাউন্ডের দর শূন্য দশমিক ১৫ শতাংশ বেড়ে যায়।
ব্রেক্সিটপন্থী ও অভিবাসনবিরোধী হিসেবে পরিচিত সুনাক তাঁর অর্থমন্ত্রী হিসেবে জেরেমি হান্টকেই রেখে দেন। গত ১৭ নভেম্বর জেরেমি হান্ট তাঁর অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন। এতে লিজ ট্রাসের নীতি যে কতটা ভ্রান্ত ছিল, পুনরায় তা দেখিয়েছেন তিনি। কর বাড়িয়ে দিয়েছেন। সরকারি ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরেছেন।
নতুন বাজেটে আয়কর প্রদাণের ক্ষেত্রে স্তর বিন্যাস করা হয়েছে। উচ্চ করযোগ্য আয়ের সর্বোচ্চ সীমা কমিয়ে আনা হয়েছে। ফলে আরও বেশি মানুষকে এখন উচ্চহারে কর দিতে হবে। রাজস্ব আয় বাড়ানোর জন্য এ রকম পদক্ষেপ না নিয়ে উপায় ছিল না ঋষি সরকারের। কারণ, যুক্তরাজ্যের অর্থনীতিতে এরই মধ্যে মন্দাভাব দেখা দিয়েছে। মূল্যস্ফীতির হার এখন ১১ শতাংশের ওপরে। আগামী বছর অর্থনীতি আরও সংকুচিত হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে হবে। বিরোধী দল লেবার পার্টি নতুন নির্বাচন চাইছে বটে, তবে এতে কনজারভেটিভ দলের ঋষি-বিরোধীদের তেমন সায় নেই। এই সংকটের সময় নির্বাচন করে পরাজিত হতে চায় না দলটি। এই পরিস্থিতি হয়তো শাপে বর হতে পারে ঋষির জন্য। বেশ লম্বা সময় কাজের সুযোগ পাবেন ‘অশ্বেতাঙ্গ’ এই প্রধানমন্ত্রী।
সূত্র: বিবিসি, গার্ডিয়ানসহ একাধিক সংবাদ সংস্থা
কাজী আলিম-উজ-জামান প্রথম আলোর উপবার্তা সম্পাদক
[email protected]