ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ
রুশ সেনাদের চেয়ে আধুনিক অস্ত্র উত্তর কোরিয়ার সেনাদের হাতে, ‘উটদের’ কাজে লাগাচ্ছে রাশিয়া
তিন বছর ছুঁই ছুঁই রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ। এই যুদ্ধে ক্রমেই অগ্রগতি পাচ্ছে রুশ বাহিনী। তাদের সামাল দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে ইউক্রেনীয়দের। এরই মধ্যে নতুন এক সমস্যার মুখে পড়তে যাচ্ছেন তাঁরা। সেটি হলো রাশিয়ার পক্ষে লড়াই করতে উত্তর কোরিয়া থেকে পাঠানো বিপুল পরিমাণ সেনাসদস্য।
উত্তর কোরিয়া থেকে পাঠানো এই সেনাদের অনেককে আটক করেছে ইউক্রেনীয় বাহিনী। ইউক্রেনের সেনাসদস্যদের ভাষ্যমতে, দিন গড়ানোর সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার এই সেনারা যুদ্ধক্ষেত্রের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া শিখছেন। আগের থেকে তাঁরা আরও বেশি শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়ে উঠছেন।
ইউক্রেনের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা জিআরইউয়ের ধারণা, এখন পর্যন্ত রাশিয়ার কুরস্ক অঞ্চলে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে লড়তে প্রায় ১১ হাজার সেনা পাঠিয়েছে উত্তর কোরিয়া। এই অঞ্চলের বেশ কিছুটা এলাকা দখলে নিয়েছে কিয়েভ। সেখানে উত্তর কোরিয়া আরও সেনাসদস্য পাঠানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানিয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া।
প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, উত্তর কোরিয়ার এই সেনারা গত ৪ নভেম্বর কুরস্কে পৌঁছান। এর ১০ দিন পর তাঁরা যুদ্ধে নামেন। ইউক্রেনের দাবি, তখন থেকে বড় ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়েছেন উত্তর কোরিয়ার ওই সেনারা। তবে ধীরে ধীরে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমছে।
ইউক্রেনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, যুদ্ধে নামার প্রথম ৪০ দিনে উত্তর কোরিয়ার ৩ হাজার সেনা প্রাণ হারিয়েছেন। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে ৭৫ জন নিহত হয়েছেন। তবে পরের ২০ দিনে ১ হাজার সেনা নিহত হয়েছেন। গড় হিসাব করলে দেখা যায়, উত্তর কোরিয়ার সেনাদের নিহত হওয়ার সংখ্যা কমে দিনে ৫০ জনে দাঁড়িয়েছে।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান চ্যাথাম হাউসের বিশেষজ্ঞ কিয়ার গিলস বলেন, যুদ্ধক্ষেত্রে এখনো সেনাসদস্যের বড় প্রয়োজন রয়েছে রাশিয়ার। আর সেনা পাঠানোর বিনিময়ে মস্কোর কাছ থেকে উত্তর কোরিয়া যা পাচ্ছে, সেটাকে এখনো মূল্যবান বলে মনে করছে তারা। তাহলে কেন উত্তর কোরিয়া আরও বেশি সেনা পাঠাবে না?
ইউক্রেনের দোনেৎস্ক অঞ্চলের তরেস্ক এলাকার যুদ্ধক্ষেত্রে রুশ সেনাদের নতুন কৌশলের মুখোমুখি হয়েছেন ইউক্রেনের সেনারা।
যুদ্ধে রাশিয়ার ‘উট’, কোরীয় সেনাদের হাতে উচ্চ মানের গোলাবারুদ
কুরস্ক অঞ্চলে মোতায়েন করা ইউক্রেনীয় বাহিনীর একজন সার্জেন্ট ওলেগ চাউস। তিনি বলেন, গত বড় দিনের আগের সন্ধ্যায় সেখানে হামলা চালিয়েছিল রুশ বাহিনীর তিনটি দল। এই দলগুলোয় উত্তর কোরিয়ার সেনাসদস্যরাও ছিলেন। তাঁরা শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে হামলা চালিয়েছিলেন। যুদ্ধবিমানের সহায়তাও নিয়েছিলেন।
ওলেগ চাউস বলেন, ‘ওই তিন দলের সব সেনাসদস্যের কাছে খুবই উন্নত মানের গোলাবারুদ ছিল। তাঁদের প্রত্যেকের কাছে একবার ব্যবহারযোগ্য গ্রেনেড লঞ্চার ছিল। এ ছাড়া রাতের অন্ধকারে দেখার যন্ত্র এবং বিশেষ ব্যাগ ছিল সবার কাছে।’
কুরস্ক অঞ্চলে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর সদস্য পেত্রো গাইদাশচুক বলেন, কোরীয় সেনারা শুরুর দিকের চেয়ে অনেক বেশি শৃঙ্খলার মধ্যে এসেছেন। গোলাগুলির মধ্যে পড়লে তাঁরা খুব বেশি একটা ভয় পান না। দলের এক বা একাধিক সদস্য আহত হলে তাঁরা পালিয়ে যান না, লড়াই চালিয়ে যান।
অস্ত্র ও সেনাসদস্যের বিনিময়ে উত্তর কোরিয়ায় ট্রেনে করে জ্বালানি তেল পাঠানো হচ্ছে।
এ ছাড়া উত্তর কোরিয়ার সেনাদের হাতে উচ্চ মানের অস্ত্র থাকা নিয়ে রুশ সেনাদের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে বলে জানান পেত্রো গাইদাশচুক। তিনি বলেন, উত্তর কোরিয়ার সেনারা ভালো অস্ত্র পাচ্ছেন, তাঁদের ভালো খাবার দেওয়া হচ্ছে, বেশি সময় ধরে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে—এসব বিষয় নিয়ে রুশ সেনাদের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে।
এদিকে চলতি মাসে ইউক্রেনের দোনেৎস্ক অঞ্চলের তরেস্ক এলাকার যুদ্ধক্ষেত্রে রুশ সেনাদের নতুন কৌশলের মুখোমুখি হয়েছেন ইউক্রেনের সেনারা। ওই কৌশলে সেনাসদস্যরা গোলাবারুদ নিয়ে সম্মুখ সারির দিকে এগিয়ে যান। তারপর সেগুলো রেখে পেছনে ফিরে আসেন। রেখে যাওয়া ওই গোলাবারুদ পরে সম্মুখ সারির দিকে থাকা যুদ্ধরত সেনারা এসে নিয়ে যান। যেসব সেনা সম্মুখ সারিতে গোলাবারুদ রেখে আসেন তাঁরা ‘ক্যামেল’ (উট) নামে পরিচিত।
মাকসিম বেলোউসভ নামে ইউক্রেনের একজন সেনাসদস্য বলেন, কখনো কখনো রাশিয়ার একজন সেনা কোনো অস্ত্র বা সুরক্ষা সরঞ্জাম ছাড়াই যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে এগিয়ে যান। ইচ্ছা করেই তিনি এ কাজ করেন। তাঁর ওপর ইউক্রেনীয় সেনারা গুলি চালালে তাঁদের অবস্থান বুঝতে পারেন বাকি রুশ সেনারা। তারপর সেই অবস্থান লক্ষ্য করে পাল্টা হামলা চালান তাঁরা।
উত্তর কোরিয়ার লাভ
ইউক্রেন যুদ্ধে সেনা পাঠিয়ে উত্তর কোরিয়ার লাভও হচ্ছে। এর আগেও উত্তর কোরিয়া আর্থিক লাভের জন্য আফ্রিকার বিভিন্ন যুদ্ধ ও ভিয়েতনামে ভাড়ায় সেনা পাঠিয়েছে। গত অক্টোবরে সিউলের হ্যানকুক ইউনিভার্সিটি অব ফরেন স্টাডিজের প্রভাষক ওলেনা গুসেইনোভা বলেন, বাস্তবিক অর্থেই অর্থনৈতিক স্বার্থের জন্য ইউক্রেনে সর্বোচ্চ ২০ হাজার সেনা পাঠাতে পারে উত্তর কোরিয়া।
ওলেনা গুসেইনোভা বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে রাশিয়ার কাছে অনুমানিক ৫৫০ কোটি ডলারের অস্ত্র বিক্রি করেছে উত্তর কোরিয়া। গত সেপ্টেম্বর থেকে ইউক্রেনে উত্তর কোরিয়ায় তৈরি ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলা চালানো হচ্ছে। রাশিয়ার হয়ে লড়াইয়ের জন্য ৫ থেকে ২০ হাজার সেনা পাঠাতে পারলে বছরে অতিরিক্ত ১০ কোটি ৩০ লাখ থেকে ৫৭ কোটি ৩০ লাখ ডলার আয় করতে পারবে পিয়ংইয়ং।
২০২৩ সালের গ্রীষ্মকাল থেকে রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়া একে অপরকে সহযোগিতা শুরু করছে। তখন দক্ষিণ কোরিয়ার গোয়েন্দারা জানিয়েছিলেন, রাশিয়ায় ৯০ লাখ কামানের গোলা পাঠানো শুরু করেছে পিয়ংইয়ং। দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা চুক্তিও হয়েছে। এর বাইরে উত্তর কোরিয়াকে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি এবং কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণে সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে মস্কো। এ ছাড়া অস্ত্র ও সেনাসদস্যের বিনিময়ে উত্তর কোরিয়ায় ট্রেনে করে জ্বালানি তেল পাঠানো হচ্ছে।