ঠিক ৩৪ বছর আগে ১৯৯০ সালের ৩ অক্টোবর পূর্ব জার্মানি এবং পশ্চিম জার্মানি তাদের মতপার্থক্যের অবসান ঘটিয়ে ফেডারেল রিপাবলিক অব জার্মানি হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে আবির্ভূত হয়।
জার্মানি মূলত কবি এবং দার্শনিকদের জাতি হিসেবে পরিচিত। জার্মানির রয়েছে ঐতিহ্যবাহী জাতিগত ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য। প্রাচীন রোমান যুগে এই অঞ্চল জার্মানিয়া নামে পরিচতি ছিল। আশ্চর্যের বিষয়, জার্মানি আধুনিক বিশ্বের একমাত্র দেশ, যার বিভিন্ন ভাষায় ১০০টিরও বেশি ভিন্ন নাম রয়েছে। রোমান সাম্রাজ্যের বৃহত্তম অঞ্চল হিসেবেও জার্মান রাজ্যকে বিবেচনা করা হতো।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালটা জার্মানির জন্য কষ্টকর। ১৯৪৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে পুরো বিশ্বের ভাগ্য নির্ধারণ করতে একটি রিসোর্ট বসেছিলেন তিনজন মানুষ। নাৎসি জার্মানির অবস্থা সঙ্গিন। সোভিয়েত বাহিনী বার্লিনের কাছে, অন্যদিকে মিত্র বাহিনী জার্মানির পশ্চিম সীমান্ত অতিক্রম করেছে। প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনী অগ্রসরমাণ জাপানের দিকে। নিজেদের সেনাবাহিনী যখন জয়ের সুবাতাস পাচ্ছে, তখন কথিত বিগ থ্রি মানে তিন পরাশক্তি—যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল এবং সোভিয়েত নেতা জোসেফ স্তালিন কৃষ্ণসাগরের তীরে সোভিয়েত রিসোর্ট ইয়াল্টায় বৈঠকে বসতে সম্মত হন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রেসিডেন্ট জোসেফ স্তালিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত লাল ফৌজের রণকৌশল ও বীরত্ব সর্বজনবিদিত। বার্লিন বিজয়ের তিন বছর পর সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক বার্লিনকে পূর্ব ও পশ্চিম অংশে বিভক্তকরণ এবং বার্লিনের পশ্চিম অংশকে ১৯৪৮ সালের জুন থেকে প্রায় এক বছর অবরুদ্ধ করে খাদ্য, পানীয় ও জ্বালানি বন্ধ করে দেওয়ার অমানবিক সিদ্ধান্ত জোসেফ স্তালিনের নির্দেশেই হয়েছিল।
সে সময় যুক্তরাজ্য ও মার্কিন বিমান অবরুদ্ধ পশ্চিম বার্লিনবাসীকে বিমানে করে খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি পৌঁছে দিয়েছিল। ১৯৪৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্সসহ ৯টি দেশ মিলে ন্যাটো সামরিক জোট তৈরি করেছিল।
স্তালিন যেভাবে জার্মানিকে দুটি পৃথক রাষ্ট্রে ভাগ করেছিলেন, তাতে উভয় পক্ষের জার্মান জনগণকে পরস্পরের অপরিচিত হিসেবে বসবাস করতে বাধ্য হতে হয়। স্নায়ুযুদ্ধকালে পূর্ব জার্মানির আনুষ্ঠানিক পরিচয় ছিল জার্মান ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক (জিডিআর)। এটি মূলত সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাববলয়ে ছিল। অন্যদিকে পশ্চিম জার্মানি বা ফেডারেল রিপাবলিক অব জার্মানি যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা ব্লকের সক্রিয় অংশ হয়ে ওঠে। দৈনন্দিন যোগাযোগ ও আলোচনায় কঠোর বিধিনিষেধের কারণে দুই জার্মানির মধ্যে একত্রীকরণের ইচ্ছা অবিশ্বাস্য স্বপ্ন বলেই মনে হতো।
কিন্তু পরে আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের সামরিক আগ্রাসন তাদের প্রভাবে থাকা বিভিন্ন সোভিয়েত রাষ্ট্র ও দেশে প্রভাব ফেলতে শুরু করে। ১৯৮০–এর দশকের শেষদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন তার শেষ ক্ষণগণনা শুরু করে, তখন উভয় জার্মানির মধ্যে বসবাসকারী জনগণ আবার একত্রিত হওয়ার জন্য উচ্চাভিলাষী হয়ে ওঠতে শুরু করে।
সেই সময়ে কেব্ল টেলিভিশন সম্প্রচার নতুনভাবে চালু হয়েছিল এবং বিশ্বজুড়ে দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৯৮৯ সালের ৯ নভেম্বর পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানিকে পৃথক করা বার্লিন দেয়ালের পতনের ঘটনা টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হয়। জার্মানির বাসিন্দাদের ওই আবেগঘন উদ্যাপনকে আধুনিক ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা বলে ঘোষণা করা হয়।
সোভিয়েত ইউনিয়নের মুঠি যখন দুর্বল হতে শুরু করে, তখনই একীভূত হতে পূর্ব জার্মানির নানা সংগ্রাম ও ঘটনাগুলো দ্রুত ঘটতে থাকে। পরের বছরের মার্চে পূর্ব জার্মানিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। জার্মানির একত্রীকরণের পথ তাতে আরও স্পষ্ট হয়ে যায়। জুলাইয়েই পূর্ব জার্মানি অর্থনৈতিক লেনদেনের জন্য পশ্চিম জার্মানির মুদ্রা গ্রহণ করে। এরপর ১৯৯০ সালের ৩১ আগস্ট একত্রীকরণ চুক্তি সই হয়। এরপর ১৯৯০ সালের ৩ অক্টোবর আসে সেই ঐতিহাসিক দিন। বার্লিন দেয়াল পতনের একবছরের মাথায় আনুষ্ঠানিকভাবে একীভূত হয় পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানি।
ন্যাটোর চোখে জার্মানির একীভূত
৪৫ বছর ধরে দুই জার্মানির বিচ্ছিন্ন থাকার ঘটনাটি কয়েক প্রজন্মের মানুষকে কষ্ট দিয়েছে। একদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন, আরেক দিকে পশ্চিমা মিত্রদের শাসনের কারণে বিভক্তির জীবন বেছে নিতে হয়েছে তাদের। মিত্র বাহিনী ১৯৪৫ সালে পরাজিত নাৎসি জার্মানি বা থার্ড রাইখকে চারটি সামরিক দখলের অঞ্চলে বিভক্ত করে। এর মধ্যে ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিমাঞ্চল দখল করে। ১৯৪৯ সালের ২৩ মে আরও তিনটি অঞ্চল নিয়ে এটি ফেডারেল রিপাবলিক অব জার্মানি হয়ে এবং ১৯৪৯ সালের ৭ অক্টোবর সোভিয়েত ইউনিয়ন পূর্বাঞ্চল দখল করে, যা জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র (জিডিআর) হয়ে ওঠে।
বার্লিনেরও একই পরিণতি হয়। এটি দুটি ভাগে বিভক্ত হয়েছিল এবং সোভিয়েত-অধ্যুষিত পূর্বের গভীর প্রভাব থাকলেও পশ্চিম বার্লিন পশ্চিমাদের বড় একটি ছিটমহল হয়ে উঠেছিল।
পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানির সম্পর্ক দ্রুত খারাপ হতে শুরু করে এবং স্নায়ুযুদ্ধে রূপ নেয়। তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের লৌহ পর্দার রূপক বার্লিন প্রাচীরে রূপ নিয়েছিল, যা ওই সময়কার অস্থিরতার প্রতীক হয়ে উঠে এসেছিল। এ সময় পরিবারগুলোকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল এবং বার্লিনবাসীদের প্রায়ই প্রাচীরের অপর পাশে তাদের প্রিয়জনদের সঙ্গে দেখা–সাক্ষাৎ করার জন্য তাদের জীবনের ঝুঁকি নিতে হয়েছিল।
১৯৫৫ সালের ৬ মে পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটো পশ্চিম জার্মানিকে সদস্য হিসাবে স্বাগত জানায়। অধিকৃত দেশ হিসেবে এর মর্যাদা শেষ হওয়ার একদিন পরে বন–প্যারিস সম্মেলনে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর কয়েক দিন পর ১৯৫৫ সালের ২২ মে পূর্ব জার্মানি ওয়ারশ চুক্তির সদস্য হয়। এর পর থেকে স্নায়ুযুদ্ধকালীন জার্মানি গোয়েন্দাগিরি এবং সামরিক কার্যকলাপের কেন্দ্র হয়ে ওঠে। সোভিয়েত-অধিকৃত বার্লিন পূর্ব জার্মানির রাজধানী হয় এবং পশ্চিম জার্মানি বনকে বেছে নেয়।
স্নায়ুযুদ্ধের সমাপ্তি ছিল আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ব্যাপক ইউটার্ন বা ঘুরে দাঁড়ানোর ঘটনা। এটি খুব অল্প সময়ের মধ্যে ঘটেছিল এবং এর পেছনে ছিল রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিক প্রচেষ্টা, যা ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেঙে পড়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তবে ১৯৮৯ সালে বার্লিন দেয়ালের পতনের বিষয়টি আন্তর্জাতিক সম্পর্কে আমূল পরিবর্তনের চিহ্ন হয়ে আছে এবং একটি নতুন যুগের সূচনার প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। জার্মানির পুনরেকত্রীকরণের পর বার্লিনকে জার্মানির রাজধানী হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা হয়।
জার্মানির এই পুনরেকত্রীকরণের সময়টিকে ইতিহাসের একটি উত্তাল সময় বলা হয়। এ সময় কয়েকজন দূরদর্শী এবং সাহসী নেতার ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য।
সাবেক মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা স্টিফেন জে হ্যাডলি বলেন, পুনরেকত্রীকরণের জন্য প্রচুর কূটনীতি, শক্তিশালী আন্তর্জাতিক অংশীদারত্ব এবং নিপুণ রাজনৈতিক কৌশল নেওয়া হয়েছিল। প্রক্রিয়াটির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত অনেকের কাছে এটি একটি অলৌকিক ঘটনা থেকে কম কিছু ছিল না।
জার্মানির এই একত্রীকরণকে স্নায়ুযুদ্ধের সমাপ্তির শুরু হিসেবে দেখা হয়। বিশেষ করে সোভিয়েতের পতনের শুরু হিসেবে দেখা হয়। সোভিয়েত অধিকৃত পূর্ব জার্মানির সঙ্গে পশ্চিম জার্মানির এক হওয়ার এক বছরের মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটে।
যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত সাবেক জার্মান রাষ্ট্রদূত এমিল হেবারের মতে, বার্লিন ওয়ালের পতন ছিল একেবারে শূন্য থেকে আকস্মিক পাওয়া এক উপহার। তিনি আরও বলেন, পরে কী হবে তা স্পষ্ট ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন তখনো একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক শক্তি ছিল এবং ঐক্যবদ্ধ জার্মানি ইউরোপের সর্বোত্তম স্বার্থে ছিল, তা অনেক দেশ বিশ্বাস করতে পারেনি। অনিশ্চয়তার এই মুহূর্তে, দূরদর্শী নেতারা সামনে এসেছিলেন। তাঁদের একজন ছিলেন জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ। আরেকজন ছিলেন গর্বাচেভ।
গর্বাচেভের ভূমিকা
১৯৯০ সালের ৩০ জানুয়ারি মিখাইল গর্বাচেভই প্রথম দুই জার্মানিকে একত্রীকরণের ব্যাপারে বক্তব্য দেন। ইউরোপের দেশগুলোসহ যুক্তরাষ্ট্রও এ ব্যাপারে প্রথমে গররাজি ছিল। আশঙ্কা ছিল, ঐক্যবদ্ধ জার্মানি আবার ইউরোপীয় মহাশক্তি হয়ে দাঁড়াতে পারে। তবে জার্মানির গণতান্ত্রিক রাজনীতিকেরা এ ব্যাপারে সন্দিহান প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন, বৃহৎ জার্মানি ইউরোপীয় তথা বিশ্ব ঐক্য ও শান্তির পথে কাজ করে যাবে। এ ব্যাপারে ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৯০ সালের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিজয়ী চার মিত্রশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র ও ইংল্যান্ড তাদের সম্মতি জানানোর পর ১৯৯০ সালের ৩ অক্টোবর দুই জার্মানি একত্রীকরণের প্রক্রিয়া শেষ হয়।
দুই জার্মানি একীভূত হওয়ার দিনটি স্মরণ করিয়ে দেয় যে চার দশকেরও বেশি সময় ধরে জার্মান পরিবার, বন্ধুবান্ধব এবং একটি জাতির জোরপূর্বক বিচ্ছেদ সত্ত্বেও, জার্মান জনগণের পুনর্মিলনের দৃঢ় সংকল্পকে পরাজিত করা যায়নি। জনগণের শক্তিই ঘৃণা ও বিচ্ছিন্নতার প্রতীক বার্লিন দেয়ালের পতন ঘটিয়েছে। জার্মান ঐক্য দিবসকে বিশ্ব শান্তি, স্থিতিশীলতা, গণতন্ত্র এবং সংঘাতের শান্তিপূর্ণ সমাধানের আশার রশ্মি হিসেবেও দেখা হয়। দিনটি জোর দেয় যে পারস্পরিক সহযোগিতা এবং সাধারণ মূল্যবোধের প্রচার শেষ পর্যন্ত শান্তি ও সমৃদ্ধির দিকে পরিচালিত করে। এটি সংলাপ, কূটনীতি এবং পুনর্মিলনের গুরুত্বকে আরও তুলে ধরে। জার্মানরা প্রমাণ করেছে, দিনের শেষে মানবতা, ভালবাসা, সত্য ও ন্যায়ের জয়ই হয়ে থাকে।
তথ্যসূত্র : দ্য নিউজ, ন্যাটো ও বিবিসি