ইউক্রেনের সীমান্ত থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে রাশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলের বেলগোরোদ অঞ্চল, যেখানে যুদ্ধের উত্তাপ উপেক্ষা করা অসম্ভব। ইউক্রেনের পাল্টা আক্রমণের মুখে পিছু হটতে থাকা রুশ সেনারা সেখানে রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এ এলাকায় দিনে বেশ কয়েকবার বোমার শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। আবারও শরণার্থীতে ভরে উঠেছে শহরটি। শহর পেরিয়ে সীমান্তে এপারে রুশ এবং ওপারে ইউক্রেনীয় সেনারা পাহারায় রয়েছেন।
এক সন্ধ্যায় ওসেতিয়ার তিন রুশ সেনা এ শহরের গ্র্যান্ড ট্রান্সফিগারেশন ক্যাথেড্রালের পাশে অপরিচিত রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। তাঁদের পা টলমল করছিল। হয়তো মাতাল ছিলেন বা ক্লান্ত। মূলত তাঁরা খাবারের একটি জায়গা খুঁজছিলেন।
এই তিন সেনার ভাষ্য, তাঁরা গত ফেব্রুয়ারি থেকে ইউক্রেনে যুদ্ধ করেছেন। ইউক্রেনের খারকিভের ঠিক উত্তরে ভেলিকি প্রোখোদি গ্রামে ছিলেন তাঁরা। বার্তা পেয়ে গত সপ্তাহে যুদ্ধের ময়দান থেকে রাশিয়ায় ফিরে এসেছেন। তাঁদের একজন বললেন, ‘আমরা কী বলতে পারি? আদেশ তো আদেশই। আমাদের কাছে কোনো বিকল্প ছিল না।’ তাঁর মাথায় ছিল জেড অক্ষর খোদাই করা টুপি। রাশিয়ায় যুদ্ধকে সমর্থনের প্রতীক এই জেড।
খারকিভে রুশ বাহিনী পিছু হটার পর সেখানকার রুশপন্থী ইউক্রেনীয় নাগরিকেরাও এখন পালিয়ে এই সীমান্তের দিকে আসছেন। সাধারণ মানুষের মনে এখন ভয়, এ যুদ্ধ রাশিয়ায় ছড়িয়ে পড়তে পারে। এ পরিস্থিতিতে রুশ এই তিন সেনাকে জিজ্ঞাসা করা হয়, ‘এখন কোথায় যাবেন?’ এর জবাবে তাঁরা বললেন, তাঁদের তা জানা নেই। তবে তাঁরা মনে করেন, সম্ভবত ‘সীমান্ত রক্ষার জন্য’ তাঁদের দক্ষিণে ফেরত পাঠানো হবে।
এর পরের দিনই রাশিয়ার ন্যাশনাল গার্ডের প্রায় ৪০০ সেনাকে বেলগোরোদে সীমান্ত রক্ষায় মোতায়েন করা হয়। সেখানকার এক অধিকারকর্মী ওই সেনাদের কথোপকথন শুনেছেন। চলমান এ যুদ্ধ নিয়ে ওই সেনারা নিজেরাই নিজেদের প্রশ্ন করছেন।
স্থানীয় বেশির ভাগ মানুষ মনে করেন, বেলগোরোদে সংঘাত ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা কম। এখানে ওলেগের একটি রেস্তোরাঁ আছে। তিনি মূলত ইউক্রেনের বাসিন্দা। তাঁর পরনে ‘জন্ম খারকিভে’ লেখা শার্ট। তিনি যুদ্ধের ভয়ে যদি কখনো তাঁর রেস্তোরাঁর জানালা ঢেকে রাখার প্রয়োজন পড়ে, তাই প্লাইউড বোর্ড কিনেছেন।
ওলেগের রেস্তোরাঁর আরেক অংশীদার ডেনিস। তিনিও বোমা হামলার হাত থেকে বাঁচতে বাড়ির পেছনের উঠানে একটি আশ্রয়স্থল তৈরি করেছেন। তিনি তাঁর দাদিকে পূর্ব ইউক্রেনের একটি শহর থেকে নিয়ে এসেছেন। রুশ বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকা যে শহরগুলোয় এখন লড়াই চলছে, সেগুলোর একটি ওই শহর। ডেনিসের আশা, এ উত্তেজনা কমবে। তারপরও তাঁরা সতর্কতা অবলম্বন করছেন। ওলেগ বলেন, ‘এই যুদ্ধ এখানে ছড়িয়ে পড়ুক, এটা কেউ চায় না। তবে আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে।’
বেলগোরোদের মূল বাজার ঘুরে ঘুরে সেনারা শীতের জন্য প্রয়োজনীয় পোশাক, খাবার সংগ্রহ করে মজুত করছেন। এ থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায়, এ যুদ্ধ আগামী মাস বা তারও বেশি সময় ধরে চলতে পারে।
শীতের পোশাক বিক্রি করে এমন কয়েকটি স্টলের একটি থেকে এক ক্রেতার গলা ভেসে আসে। তিনি জানতে চাইছিলেন, বালাক্লাভাস (মাথা, কান, নাক ও গলা ঢাকা টুপি) কোথায়? এসব দোকানে ক্যামোফ্লেজ টুপি, জ্যাকেট, থার্মাল আন্ডারওয়্যার এবং শীতের অন্যান্য পোশাক বিক্রি হচ্ছিল। ক্যামোফ্লেজ বিক্রেতা মারিনা বলেন, প্রতিদিন কয়েক ডজন ছেলে আসেন। ইউক্রেনের পাল্টা আক্রমণের পর থেকে এ সংখ্যা বেড়েছে। প্রত্যেকের চেহারাতেই বিষণ্নতার ছাপ।
মারিনা বলেন, ‘আমি তাদের এসব কিনতে দেখে অবাক হই, এখনো এসব কেন তাদের কাছে নেই।’ তিনি জানান, সেনারা খাবার ও রান্নার সরঞ্জাম কিনছেন এ বাজার থেকে। মারিনার কথা, এসব তো সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে সরবরাহ করার কথা।
বেলগোরোদে রাশিয়ার সেনাবাহিনীর জন্য থার্মাল রাইফেল স্কোপ এবং অন্যান্য সরঞ্জাম সরবরাহের জন্য তহবিল গঠন করছেন আন্দ্রেই বোরজিখ। তিনি আইনজীবী। বললেন, ‘আপনি এ শহরে যুদ্ধ আঁচ করতে পারবেন, যা অন্য শহরে আঁচ করা যায় না।’
নিজের নিরাপত্তার স্বার্থে গাড়িতে একটি হেলমেট ও একটি বুলেটপ্রুফ ভেস্ট রাখেন বোরজিখ। যদিও ইউক্রেন এমন কোনো ইঙ্গিত দেয়নি যে তারা সীমান্ত অতিক্রম করতে চায় বা রাশিয়ার দখলকৃত অঞ্চল পুনরুদ্ধার করার চেয়ে বেশি কিছু করতে চায়।
সম্প্রতি বিভিন্ন স্থানে ইউক্রেনের হামলার মুখে রুশ বাহিনী পিছু হটছে। এত দিন ধরে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে দ্রুত জয় পাওয়ার যে আত্মবিশ্বাস ছিল, তা রাশিয়ার জন্য বুমেরাং হয়ে ফিরে এসেছে। এ প্রসঙ্গে বোরজিখের অভিমত, যুদ্ধে হিসাবনিকাশ কিছু ভুল হয়েছে, এমন হতে পারে কিংবা রুশ বাহিনীর জন্য এটা কৌশলগত অবস্থানও হতে পারে বলে মন্তব্য তাঁর। রাশিয়ার সেনাবাহিনীকে সহায়তাকারী অন্যদের মতো বোরজিখও মনে করেন, সম্প্রতি রুশ বাহিনীর পিছু হটার কারণ ইউক্রেনের প্রতি পশ্চিমাদের সমর্থন। তিনি বলেন, বিশ্ব সম্প্রদায়ের এক-তৃতীয়াংশের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছে রাশিয়া।
বেলগোরোদে সম্প্রতি নীল রঙের ইউনিফর্মে থাকা এক নিরাপত্তা কর্মকর্তা কেন্দ্রীয় নরোদনি বুলভারে লাল ইটের লাইসি নং-৯-এর বাইরে একটি কালাশনিকভ রাইফেল তাক করে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এর ঘণ্টাখানেক আগে খবর আসে, শহরের স্কুল ও গুরুত্বপূর্ণ শপিং সেন্টারগুলো ফাঁকা করা হবে। সাধারণত গোলাগুলি বা বোমা হামলার হুমকি থাকলেই এমনটা করা হয়।
বেলগোরোদের গভর্নর ব্যাচেস্লাভ গ্ল্যাডকভ গত সোমবার একটি আদেশ পুনরায় জারি করেছেন। এ আদেশে স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে বোমা হামলার হাত থেকে রক্ষা পেতে তৈরি করা আশ্রয়কেন্দ্রগুলো পরীক্ষা করতে বলা হয়। সীমান্তের কাছাকাছি স্কুলগুলো সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অনলাইন ভিডিওতে দেখা যায়, স্বেচ্ছাসেবকেরা শহরের দক্ষিণে বনাঞ্চলে দুর্গ নির্মাণের জন্য গাছ কাটছেন।
এখানকার সাধারণ মানুষ এখন বুঝতে পারছেন, যুদ্ধ পরিস্থিতি ভালোর দিকে যাচ্ছে না। একাধিক ব্যক্তির সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে, স্থানীয় লোকজন যুদ্ধের প্রথম দিনগুলোতে ধাক্কা খেয়েছেন। এরপর ধীরে ধীরে তাঁদের মধ্যে দেশপ্রেমের আবেগ বৃদ্ধি পায়। তখন যুদ্ধ-সমর্থক চিহ্নগুলো যেমন জেড প্রতীকটি গাড়ি ও ভবনগুলোতে দেখা যায়। কিন্তু সেসব চিহ্ন এখন অদৃশ্য। কারণ, বেলগোরোদ একটি দীর্ঘ সংঘাতের প্রস্তুতি নিতে যাচ্ছে। আর এটা যে এত দ্রুত হবে, তা স্থানীয় লোকজন আশা করেননি।
রাশিয়ার শহরে যুদ্ধবিরোধী কর্মকাণ্ড খুব কমই দেখা যায়। ১৯ বছরের ইলিয়া কোস্টিউকভ বর্তমান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সরকারবিরোধী মতাদর্শের মানুষ। এ ছাড়া বেলগোরোদ অ্যান্টি-ওয়ার কমিটির প্রতিষ্ঠাতাও তিনি। ইলিয়া কোস্টিউকভ বলেন, চলমান যুদ্ধের বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য উদ্বুদ্ধ করার কাজটি করছেন তিনি। তবে তিনি এটাও মনে করেন, যুদ্ধের পক্ষের লোকজনের মানসিকতা পরিবর্তনের চেষ্টা অর্থহীন।
বেলগোরোদের মানুষের ওপর যুদ্ধের সরাসরি প্রভাব কী কী, জানতে চাইলে ১৯ বছরের ইলিয়া বলেন, শরণার্থীদের ঢল নেমেছে সেখানে। এ ছাড়া কাছের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিস্ফোরণের পর থেকে সেখানকার মানুষ অন্ধকারে থাকছে। তিনি জানান, কারাওকে ক্যাফেতেও সেনারা হট্টগোল করছিল। সেখানে প্রায়ই মারামারি হয়। সেনাদের একটি দল বিল দিতে অস্বীকার করে, এমনকি ‘বাউন্সারকে’ পিস্তল বের করে হুমকি দেয়।
ইলিয়া কোস্টিউকভ বলেন, ‘বেলগোরোদজুড়ে একধরনের উদাসীনতা দেখা যাচ্ছে। আমাদের জন্য বিষয়টা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, এ যুদ্ধের কারণে কেউ ক্ষতির মুখে না পড়া পর্যন্ত বিষয়টিকে কেউ ব্যক্তিগতভাবে নিচ্ছে না। যতক্ষণ না কেউ আপনার বাড়িতে একটি কফিন নিয়ে আসে, ততক্ষণ কেউ পাত্তা দেয় না।’
এ সীমান্তের কারণে অনেক পরিবার বিভক্ত হয়ে পড়েছে। ট্রাভেল এজেন্ট ইরিনা মেয়েকে নিয়ে বেলগোরোদে বসবাস করেন। তাঁর সাবেক স্বামী ও সন্তানের বাবা খারকিভে রয়েছেন। দুই সপ্তাহের আগের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, তাঁর সাবেক স্বামী তাঁকে বলেছিলেন, তাঁকে ইউক্রেন সেনাবাহিনীতে ডাকা হয়েছে। তিনি (সাবেক স্বামী) মনে করেন, তাঁর যাওয়া উচিত। কারণ, এটি তাঁর কর্তব্য। কিন্তু ইরিনার ভয়, হয়তো তাঁর সন্তানদের বাবা আর ফিরে না-ও আসতে পারেন।
এক সন্ধ্যায় ইউলিয়া নেমচিনোভা নামের এক স্বেচ্ছাসেবকের সঙ্গে কথা হয়। তাঁর কাজ ইউক্রেন থেকে বেলগোরোদে আসা লোকজনকে সহায়তা করা। তাঁর ফোনে তখন এক বিশাল ফর্দ। সবই মৌলিক প্রয়োজন। প্রায় ছয় হাজার লোকের চাহিদা। তিনি বলেন, শরণার্থীতে বেলগোরোদ ভেসে যাচ্ছে। একেকটি অ্যাপার্টমেন্টে দুই ডজনের বেশি মানুষকে থাকতে হচ্ছে।
ইউক্রেন থেকে আসা সাধারণ মানুষের ৮৫ শতাংশই সীমান্তের কাছাকাছি থাকতে চান। সরকারি শরণার্থীশিবিরে গেলে একসময় রাশিয়ার ভেতর পাঠানো হতে পারে, এই ভয়ে তাঁরা সেসব শিবিরে যেতে অনাগ্রহ প্রকাশ করছেন। এমনকি পুতিন সমর্থকদের মধ্যেও একটা ধারণা আছে, ইউক্রেনীয়দের একটি অংশ রাশিয়াকে সমর্থন করতেন। সেই সমর্থন হারাচ্ছে রাশিয়া।
ত্রাণ বিতরণের একটি কেন্দ্রে ক্রেমলিনপন্থী ইউক্রেনীয়রা খোলাখুলি জানতে চাইছিলেন, কেন তাঁদের ইউক্রেনের পাল্টা আক্রমণ সম্পর্কে সতর্ক করা হয়নি বা রাশিয়ায় আসার পর সরকারের কাছ থেকে আরও বেশি সহায়তা দেওয়া হচ্ছে না।
ইউক্রেনের কুপিয়ানস্ক শহরের নিয়ন্ত্রণ আবারও ফিরে পেয়েছে দেশটির বাহিনী। এ শহর থেকে পালিয়ে আসা এক নারী বলেন, ‘আমরা এখানে গৃহহীন। কারোরই আমাদের প্রয়োজন নেই।’
ইউক্রেন থেকে পালিয়ে যাঁরাই রাশিয়ায় আসবেন, তাঁদের রুশ সরকার ১০ হাজার রুবল দেবে বলে প্রতিশ্রুতি ছিল। এই নারীও ১০ হাজার রুবল পেয়েছেন। এই নারী বলেন, ‘আমার বাড়ি ছিল সেখানে। আমি সেখানে সব কিছু ফেলে এখানে এসেছি। এখন আমি গৃহহীন।’
বেলগোরোদে কথা হয় রাশিয়াভিত্তিক এক অধিকারকর্মীর সঙ্গে, যিনি নিয়মিত ইউক্রেনে রুশদের দখলে থাকা এলাকায় আসা-যাওয়া করেন। ইউক্রেন থেকে সাধারণ লোকদের সরিয়ে রাশিয়ায় নিয়ে আসেন তিনি। কিন্তু এসব মানুষের জন্য রাশিয়ার অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগের অভাব দেখে হতবাক হয়েছেন এই অধিকারকর্মী। কুপিয়ানস্কের একটি ফাঁকা মোড়ে দাঁড়িয়ে তিনি যে ধ্বংসযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করেছিলেন, সেই অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করেন।
ইউক্রেনের ভোভচানস্ক শহরে কয়েক মাস ধরে কোনো আলো বা বিদ্যুৎ ছিল না। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, এটি রাশিয়ান সেনাবাহিনীর ব্যর্থতাগুলোর মধ্যে একটি। তারা যথেষ্ট সুবিধা দিতে পারেনি। তাই সেখানকার লোকজন ইউক্রেনীয় সেনাদের আগমনকে স্বাগত জানিয়েছে।’