ফিরে দেখা
দ্বিতীয় এলিজাবেথ যেভাবে ব্রিটেনের রানি হয়ে উঠলেন
নিজ কৃতিত্বে নয় বরং বংশানুক্রমে ব্রিটিশ সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। তিনি যখন সিংহাসনে বসেন, তত দিনে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সূর্য ঢলে পড়েছে। এরপরও রাজদণ্ড হাতে নিয়ে নিজেকে নিয়ে গেছেন অন্য উচ্চতায়। ৭০ বছর বিশ্বের প্রায় অর্ধেক মানুষের রানি হয়ে থাকা এলিজাবেথ ২০২২ সালের ৮ সেপ্টেম্বর মারা যান। তাঁর স্মরণে আমাদের আজকের এই আয়োজন।
মৃত্যুর মাত্র কয়েক মাস আগে জাঁকজমকভাবে নিজের সিংহাসনে আরোহণের ৭০ বছর ‘প্লাটিনাম জুবিলি’ পালন করেছিলেন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। ২০২২ সালের ৮ সেপ্টেম্বর তিনি মারা যাওয়ার পর ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান লিখেছিল, নিয়ম অনুসরণ করে সিংহাসন পেলেও দ্বিতীয় এলিজাবেথ তাঁর দীর্ঘ শাসনকালের পট এঁকেছেন প্রায় নির্ভুলভাবে।
বিবিসির মূল্যায়ন ছিল, কর্তব্য নিষ্ঠা, সিংহাসন আর জনগণের জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে নিবেদিতপ্রাণ হয়ে কাজ করার উদাহরণ তৈরি করে গেছেন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৫৩ সালে এলিজাবেথ যখন ব্রিটিশ সিংহাসনে বসেন, বিশ্ব তখন খুব দ্রুত বদলাচ্ছে। অর্ধ পৃথিবীর অধীশ্বর ব্রিটিশ সাম্রাজ্য তখন পড়তির মুখে।
রাজা-রানির আর প্রয়োজন আছে কি না, সেই প্রশ্নও উঠছিল জোরালোভাবে। এই রকম একটা অস্থির সময়ে সিংহাসনে বসেন এলিজাবেথ। শুধু বসেননি, রাজতন্ত্রের অবসানের দাবির মুখেও রাজ পরিবারের গুরুত্ব তিনি হারাতে দেননি, নেন ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে বেরিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোর জোট কমনওয়েলথ প্রধানের আসন।
রয়টার্স লিখেছিল, পরিবর্তনশীল বিশ্বের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়ে চলেছেন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ।
রানি এলিজাবেথ কি ‘নারীবাদী’ ছিলেন
প্রয়াত রানি এলিজাবেথকে নিয়ে সবচেয়ে বিতর্কিত মন্তব্যটি খুব সম্ভবত করেছেন অলিভিয়া কোলম্যান। রানি এলিজাবেথকে নিয়ে নেটফ্লিক্সের সিরিজ ‘দ্য ক্রাউন’–এ রানির চরিত্রে অভিনয় করেছেন কোলম্যান। রানি এলিজাবেথকে তিনি ‘চূড়ান্ত নারীবাদী’ বলেছেন। যিনি ‘একেবারেই লজ্জা পেতেন না’। কোলম্যানের এই মন্তব্য যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাজ্যের বাইরে বিতর্ক উসকে দিয়েছিল। প্রয়াত রানি কি আসলেই নারীবাদী ছিলেন?
যুক্তরাজ্যের রাজনীতিতে রানির আসনটি ছিল মূলত আলংকারিক। তিনি নিজেও খুবই সতর্ক থেকে রাজনীতিতে জড়িয়ে যাওয়া এড়িয়ে গেছেন। যে কারণে নারীদের অগ্রযাত্রা নিশ্চিত করার পথে তিনি সুনির্দিষ্টভাবে ঠিক কী করেছেন, তা বলা কঠিন বলে মত কানাডার সাবেক প্রধানমন্ত্রী কিম ক্যাম্পবেলের। ক্যাম্পবেল কানাডার প্রথম ও একমাত্র নারী প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।
তবে ক্যাম্পবেল এটাও বলেন, ‘উদাহরণ সৃষ্টি করে নেতৃত্ব দেওয়া, এটাও বড় প্রভাব ফেলতে পারে। সব সময় নারী অথবা সাধারণ মানুষ যখন কিছু করেন, যা গুরুত্বপূর্ণ ও দৃশ্যমান, এটা ওই সব কাজ করার ক্ষেত্রে আমাদের ধারণায় পরিবর্তন আনে।’
২০১১ সালে কমনওয়েলথ সম্মেলনের উদ্বোধনী বক্তব্যে প্রয়াত রানি এলিজাবেথ বলেছিলেন, ‘নারীরা পরিবর্তন আনতে পারে’।
ক্যাম্পবেল বলেন, ‘এলিজাবেথের ওই বক্তব্য সমাজে আমাদের সম্ভাবনার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। সেটা হলো, সমাজ এখনো আমাদের জন্য সম্পূর্ণ উন্মুক্ত এবং এটা আমাদের এই সাহস দেয় যে মেয়ে ও নারীদের নিজেদের পূর্ণ ভূমিকা পালন করার পথ খুঁজে বের করার সুযোগ রয়েছে।’
অনন্য নেতৃত্ব
প্রয়াত রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ তাঁর দায়িত্বের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ও নিবেদিত ছিলেন। যা অন্য নারীদের তাঁদের ক্যারিয়ারের প্রতি পূর্ণ নিবেদিত হওয়ার পথ তৈরি করে দিয়েছে।
ক্যাম্পবেল বলেন, ‘তিনি (রানি) খুবই পরিশ্রমী ছিলেন এবং একই সঙ্গে তিনি একজন মা ছিলেন। তিনি দেখিয়েছেন নারীরা একাধারে সবই করতে পারেন। আমার মনে হয়, তিনি ওই সব মানুষদের দলে, যারা অন্যদের প্রায়ই বলেন, “ঠিক আছে, নারীরা এসব করতে পারেন।” তিনি এটা করেছেন এবং বেশির ভাগ সময় এটা খুবই কঠিন কাজ।’
১৫ জন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী রানি এলিজাবেথের হাত ধরে ক্ষমতায় এসেছেন। তাঁদের মধ্যে তিনজন নারী। রানির হাত ধরেই যুক্তরাজ্যের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১৯৭৯ সালে ক্ষমতায় আসেন মার্গারেট থ্যাচার। যিনি ‘লৌহ মানবী’ হিসেবে পরিচিতি পান। গত শতাব্দীতে থ্যাচারই সবচেয়ে দীর্ঘসময় যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। অন্য দুজন হলেন টেরেসা মে (২০১৬ থেকে ২০১৯) ও লিজ ট্রাস (কয়েক সপ্তাহ)।
এ ছাড়া রানি হিসেবে এলিজাবেথ যুক্তরাষ্ট্রের ১৫ জন প্রেসিডেন্ট পরিবর্তন হতে দেখেছেন। তাঁদের রাজনৈতিক বিশ্বাস, দেশ পরিচালনার কৌশল ও মতাদর্শ ভিন্ন ছিল। তাঁদের প্রায় সবার সঙ্গেই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন প্রয়াত রানি।
রানি এলিজাবেথের সঙ্গে বেশ কয়েকবার সাক্ষাৎ হয়েছে নিউজিল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী হেলেন ক্লার্কের। তিনি বলেন, ‘রানি হিসেবে তাঁর শেষ দিকের কিছু কর্মকাণ্ড তাঁর অনন্য নেতৃত্বশৈলী নিয়ে অনেক কিছু বলেছে। তিনি (রানি) বলেছিলেন, “আমি শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত সেবা দিয়ে যেতে চাই” এবং তিনি আদতে সেটা করতে পেরেছেন।’
ক্লার্ক বিশ্বাস করেন, রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের নেতৃত্বশৈলী প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে নারীদের প্রভাবিত করে যাবে। তিনি বলেন, ‘একজন নারীও যে সম্মানের সঙ্গে নেতৃত্ব দিতে পারেন, তিনি সেই উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন এবং আমরা সম্ভবত আমাদের জীবনে তাঁর যে ধরনের প্রভাব রয়েছে, সেটিকে হয়তো ঠিকঠাক মূল্যায়ন করছি না।’
ক্যাম্পবেল মনে করেন, যুক্তরাজ্য ও কমনওয়েলথে নিজের ভূমিকা নিয়ে রানি এলিজাবেথ খুবই সচেতন থাকতেন এবং এটাই তাঁকে সফল নেতা বানিয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘যুক্তরাজ্যের ক্ষমতা দিন দিন ক্ষয়ে আসছে। তেমন একটি সময়ে সচেতন রানি জানতেন কখন পিছিয়ে আসতে হবে। তিনি যুক্তরাজ্যের রাজনীতিতে কখনো প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেননি। এটা তাঁর ভূমিকা নিয়ে নয় বরং তিনি সব সময় সেখানেই থাকতে চেয়েছেন, যেখানে থাকা তাঁর জন্য মানানসই ছিল।’
জন্ম ও বেড়ে ওঠা
রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের জন্ম ১৯২৬ সালের ২১ এপ্রিল লন্ডনে। নাম ছিল এলিজাবেথ আলেকজান্দ্রা মেরি উইন্ডসর। তাঁর বাবা রাজা ষষ্ঠ জর্জ ও মা এলিজাবেথ বাউয়েস-লিয়ন। রাজা ষষ্ঠ জর্জের দুই সন্তানের মধ্যে এলিজাবেথ ছিলেন প্রথম। তাঁর বোন প্রিন্সেস মার্গারেটের জন্ম ১৯৩০ সালে।
স্কুলে নয়, বাড়িতেই শিক্ষাগ্রহণ শুরু হয় ছোট্ট এলিজাবেথের। তাঁর শিক্ষক ছিলেন মারিয়ন ক্রাফোর্ড।
এলিজাবেথের সিংহাসনে আরোহণের পথ খুলে যখন তাঁর চাচা রাজা অষ্টম এডওয়ার্ড যখন রাজদণ্ড ছাড়েন। ১৯৩৬ সালে অষ্টম এডওয়ার্ড পদত্যাগ করলে এলিজাবেথের বাবা ষষ্ঠ জর্জ রাজা হন।
তখন এলিজাবেথের বয়স ১০ বছর হলেও সিংহাসনের পরবর্তী উত্তরাধিকারী হিসেবে পাদপ্রদীপের আলোয় চলে আসেন তিনি। ১৬ বছর বয়সে ১৯৪৩ সালে প্রথম জনসম্মুখে আসেন এলিজাবেথ। ১৯৪৫ সালে প্রশিক্ষণের জন্য যোগ দেন সামরিক বাহিনীতে।
প্রেম-বিয়ে-সন্তান
১৯৪৭ সালে প্রিন্স ফিলিপকে বিয়ে করেন এলিজাবেথ। ২০২১ সালের ৯ এপ্রিল ৯৯ বছর বয়সে মারা যান প্রিন্স ফিলিপ। ফিলিপ ছিলেন গ্রিসের এক রাজপরিবারের সন্তান।
প্রিন্স ফিলিপের সঙ্গে প্রিন্সেস এলিজাবেথের প্রথম দেখা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর ঠিক আগে। তখন প্রিন্সেস এলিজাবেথের বয়স ১৩। রাজা ষষ্ঠ জর্জ এসেছিলেন ডার্টমুথ কলেজ সফরে, সঙ্গে প্রিন্সেস এলিজাবেথ ও প্রিন্সেস মার্গারেট।
প্রিন্স ফিলিপ তখন নৌবাহিনীর এক তরুণ ক্যাডেট। দুই রাজকুমারীকে দেখভাল করার দায়িত্ব চাপে তাঁর ওপর। সুদর্শন ফিলিপ তখন প্রিন্সেস এলিজাবেথের মনে গভীর ছাপ ফেলেন।
এরপর দুজনের মধ্যে প্রেম জমে, শুরু হয় চিঠি চালাচালি। প্রিন্স ফিলিপ বেশ কয়েকবার রাজপরিবারের সঙ্গে থাকার জন্য আমন্ত্রিত হন। সে সময় প্রিন্সেস এলিজাবেথের ড্রেসিং টেবিলে শোভা পেত প্রিন্স ফিলিপের ছবি।
১৯৪৩ সালে প্রিন্স ফিলিপ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রিন্সেস এলিজাবেথকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। কিন্তু তাঁদের বিয়েতে রাজপরিবারের কেউ কেউ আপত্তি তুলেছিলেন এই বলে যে ফিলিপ ‘রুক্ষ ও অভদ্র’। তাঁর জাতীয়তা নিয়েও আপত্তি ছিল।
তাই বাগ্দানের আগে প্রিন্স ফিলিপ গ্রিসের নাগরিকত্ব ত্যাগ করে ব্রিটিশ নাগরিকত্ব নেন, নিজের নামের সঙ্গে যুক্ত করেন মামাদের দিককার মাউন্টব্যাটেন পদবি।
বিয়ের অনুষ্ঠানের আগের দিন রাজা ষষ্ঠ জর্জ হবু জামাই প্রিন্স ফিলিপকে ‘হিজ রয়্যাল হাইনেস’ উপাধি দেন। আর বিয়ের দিন সকালে তাঁকে করা হয় ‘ডিউক অব এডিনবরা’। এরপর ওয়েস্টমিনস্টার গির্জায় ১৯৪৭ সালের ২০ নভেম্বর বিয়ের বাঁধনে বাঁধা পড়েন ফিলিপ ও এলিজাবেথ।
সেই বিয়ে নিয়ে যুক্তরাজ্যের তখনকার প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল বলেছিলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ–পরবর্তী ব্রিটেনে ধূসর দিনগুলোতে ওই বিয়ে ছিল ‘রঙের ঝলকানি’।
এই দম্পতির চার সন্তানের মধ্যে সবার বড় বর্তমান রাজা চার্লসের জন্ম ১৯৪৮ সালে, ৯৬ বছর বয়সে মায়ের মৃত্যুর পরপরই তাঁকে রাজা ঘোষণা করা হয়।
চার্লসের ভাই-বোনের মধ্যে প্রিন্সেস অ্যানের জন্ম ১৯৫০ সালে, ডিউক অব ইয়র্ক প্রিন্স অ্যান্ডুর জন্ম ১৯৬০ সালে আর সবার ছোট প্রিন্স এডওয়ার্ডের জন্ম ১৯৬৪ সালে।
তথ্যসূত্র: ফোবর্স, বিবিসি, রয়টার্স