তখন রাত আটটা ছুঁই ছুঁই। সংগীতপ্রেমী দর্শক-শ্রোতায় সবে ভরে উঠতে শুরু করেছে ক্রোকাস সিটি হল। শুক্রবারের রাতটি জমে ওঠার কথা বিখ্যাত ব্যান্ড দল ‘পিকনিক’-এর পরিবেশনায়।
দেভ প্রাইমভ একজন আলোকচিত্রী। ওই রাতে মস্কোয় কনসার্টে ভয়ানক হামলার আগমুহূর্তে হলটির ওপরতলার এক বারান্দায় ছিলেন তিনি। বন্দুকধারী হামলাকারীদের চালানো তাণ্ডবের তিনি একজন প্রত্যক্ষদর্শী। দিচ্ছিলেন সেই হামলার বর্ণনা, ‘বাদামি রঙের পোশাক পরা কিছু লোক আসে। তারা কি সন্ত্রাসী, নাকি সামরিক বাহিনীর সদস্য—চিনলাম না। যারাই হোক, মিলনায়তনে ঢুকে পড়ে। শুরু করে দর্শকদের ওপর অ্যাসল্ট রাইফেল দিয়ে গুলি ছোড়া।’
হামলাকারীরা কতজন ছিল, সে বিষয়ে জানেন না কেউ। তবে ভবনের ওপরতলা থেকে ধারণকৃত ভিডিওতে দেখা যায়, বাদামি-ধূসর রঙের মার্বেল টাইলসে মোড়া মেঝেতে চার বন্দুকধারী নিজেদের মধ্যে কয়েক মিটারের দূরত্ব বজায় রেখে আলাদা আলাদা হাঁটছে।
মিলনায়তনে ঢোকার আগে দর্শকদের ঘিরে বন্দুকধারীরা থিয়েটারের বাইরে হাঁটতে থাকে। পরে ছুড়তে থাকে এলোপাতাড়ি গুলি। শুরু হয় আতঙ্ক, চিৎকার-চেঁচামেচি। গুলিতে একে একে মারা পড়তে থাকেন অনেকে। অনেকে আবার আহত হয়ে কাতরানো শুরু করেন।
কনসার্টে অংশগ্রহণের জন্য ৬ হাজার ২০০টি টিকিট বিক্রি হয়েছিল। কিন্তু হামলা শুরু হলে ভবনের প্রবেশপথের বাইরে থাকা নিরাপত্তাব্যবস্থা দ্রুতই ভেঙে পড়ে। সেখানকার চার নিরাপত্তাকর্মীর একজন বলেন, এ সময় তাঁর সহকর্মীরা একটি বিজ্ঞাপনী বোর্ডের পেছনে লুকান। তিনি বলেন, ‘হামলাকারীরা আমাদের ১০ মিটার (৩০ ফুট) দূর দিয়ে হেঁটে ভবনে প্রবেশ করে। নিচতলায় থাকা লোকজনের ওপর এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে থাকে তারা।’
হামলাকারীরা কতজন ছিল, সে বিষয়ে জানেন না কেউ। তবে ভবনের ওপরতলা থেকে ধারণকৃত ভিডিওতে দেখা যায়, বাদামি-ধূসর রঙের মার্বেল টাইলসে মোড়া মেঝেতে চার বন্দুকধারী নিজেদের মধ্যে কয়েক মিটারের দূরত্ব বজায় রেখে আলাদা আলাদা হাঁটছে।
প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছিল, পটকা-আতশবাজি ফুটছে। এ সময় হলঘর ঘুরে দেখি। পরে আরেকবার। তৃতীয়বার বুঝলাম, হলে থাকা প্রত্যেকেই যে যেদিকে পারছেন, ছুটছেন।সোফিকো ভিরিকাশভিলি, কনসার্টে অংশগ্রহণকারী
এ সময় জানালাগুলোর কাছে থাকা লোকজনকে নিশানা বানিয়ে প্রধান হামলাকারী ব্যক্তিটি বন্দুক তাক করে। রাশিয়ায় গত কয়েক বছরে বেসামরিক মানুষের ওপর চালানো সবচেয়ে ভয়াবহ এ হামলার প্রথম শিকার হন এই লোকেরা।
পরে দ্বিতীয় বন্দুকধারী হামলা শুরু করে। এ সময় তৃতীয় ব্যক্তি পিঠে ব্যাগ নিয়ে শান্তভাবে হাঁটছিল। আর চতুর্থজন তার হাতে অস্ত্র তুলে দেয়। এরপর ধাতব বস্তু শনাক্তকারী যন্ত্র বসানো অরক্ষিত দরজা দিয়ে মিলনায়তনের দিকে হেঁটে যায় তারা।
হামলায় হতাহত ব্যক্তিদের অনেকে ক্রাসনোগোরস্ক, খিমকি ও মস্কোর উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় অন্যান্য কাছের শহর থেকে এসেছিলেন।
১১ বছরের কন্যাসন্তান নিয়ে এক নারী ওই প্রবেশপথের কাছে একটি ক্যাফে থেকে আইসক্রিম কিনছিলেন। হঠাৎ গুলির শব্দ শুনলে কেউ একজন চিৎকার করে তাঁদের বসে পড়তে বলেন।
বিবিসিকে এই নারী বলেন, ‘আমরা শিশুদের দিকে ছুটে যাই, শুয়ে পড়ি ও টেবিল-চেয়ার দিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির চেষ্টা করি। তখন কয়েকজন আহত ব্যক্তি আমাদের দিকে দৌড়ে আসছিলেন।’
এদিকে থিয়েটারের ভেতর কনসার্ট শুরু হতে কয়েক মিনিট বাকি ছিল। সেখানে কেউ কেউ মনে করছিলেন, বাইরে গুলির শব্দ, হইহট্টগোল বুঝি কনসার্টকে ঘিরেই। সোফিকো ভিরিকাশভিলি তাঁদের একজন। বলছিলেন, ‘প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছিল, পটকা-আতশবাজি ফুটছে। এ সময় হলঘর ঘুরে দেখি। পরে আরেকবার। তৃতীয়বার বুঝলাম, হলে থাকা প্রত্যেকেই যে যেদিকে পারছেন, ছুটছেন।’
আলোকচিত্রী দেভ প্রাইমভ বলেন, হামলার পর থিয়েটারে থাকা দর্শকেরা শুরু করেন ছুটোছুটি। ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক। কেউ কেউ আসনগুলোর সারির মাঝখানে শুয়ে পড়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু কয়েকজন বন্দুকধারী গুলি ছুড়তে থাকায় তা থেকে সুরক্ষা পাওয়ার সুযোগ ছিল কমই।
এ ছাড়া দর্শক-শ্রোতাদের মধ্যে যাঁরা পারছিলেন, অনুষ্ঠানমঞ্চের দিকে ছুটছিলেন। অন্যরা খুঁজছিলেন বেরিয়ে যাওয়ার পথ। তবে দরজাগুলোর কিছু ছিল তালাবদ্ধ। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, বন্দুকধারীদের হামলার মুখে পড়েন বয়স্ক ব্যক্তি থেকে শুরু করে শিশুরা—সবাই।
আতশবাজির মতো শব্দ শুনে কনসার্ট শুরু ভেবে, মাত্রই অপেরা চশমা তুলে নেন মার্গারিটা বুনোভা। দ্রুতই তা রূপ নেয় বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতিতে। মার্গারিটা ও তাঁর স্বামী বুঝতে পারেন গুলি ছোড়া হচ্ছে।
মার্গারিটা বলেন, ‘কেউ বলছিলেন, “নিচের দিকে দৌড়াও।” সেখানে ছিল পুরোপুরি অন্ধকার...। যখন বের হচ্ছিলাম, তখনো পেছন থেকে গুলির আওয়াজ শুনছিলাম।’
ভিতালি নামের আরেকজন বলেন, বারান্দা দিয়ে হামলা শুরু হতে দেখেন তিনি। হামলাকারীরা ভেতরে কিছু পেট্রলবোমা ছুড়ে মারে। আগুনে সবকিছু জ্বলতে শুরু করে।
হামলাকারীদের ছোড়া পেট্রলবোমা বা অগ্নিসংযোগকারী অন্য ডিভাইস, যা-ই হোক, আগুন ছড়িয়ে পড়ে।
হামলা চলতে থাকায় অগ্নিনির্বাপণকর্মীরা ভবনের কাছে যেতে পারেননি। এতে আগুন হলঘরের ছাদ পর্যন্ত পৌঁছে যায়। ক্রাসনোগোরস্কের সুউচ্চ ভবনগুলো থেকে দেখা যাচ্ছিল এ আগুন। একপর্যায়ে ছাদের একটি অংশ ধসে পড়ে এবং আগুন ভবনের সম্মুখে ছড়িয়ে পড়ে। পুড়ে যায় ভবনের ওপরের দুটি তলা।
এ হামলায় শতাধিক মানুষ মারা গেছেন। আহত হয়েছেন দুই শতাধিক। সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আইএস-কে এ ঘটনার দায় স্বীকার করেছে। মস্কোয় কোনো বড় জমায়েতে সম্ভাব্য সন্ত্রাসী হামলার ব্যাপারে রাশিয়াকে দুই সপ্তাহ আগেই সতর্ক করা হয় বলে মার্কিন কর্মকর্তারা দাবি করেছেন। তবে রুশ কর্মকর্তাদের অভিযোগ, এ গোয়েন্দা সতর্কবার্তায় সুনির্দিষ্ট ও বিস্তারিত তথ্যের ঘাটতি ছিল।
হামলার পরপরই এ ঘটনায় নিজের জড়িত থাকার কথা নাকচ করে দেয় ইউক্রেন। কিয়েভ বলেছে, তাদের হামলা শুধু যুদ্ধক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ। অবশ্য রাশিয়ার এফএসবি গোয়েন্দারা দাবি করেছেন, দুষ্কৃতকারীরা রাশিয়া হয়ে ইউক্রেনে ঢুকতে চেয়েছিল। ইউক্রেন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল তাদের। ইতিমধ্যে সন্দেহভাজন চারজন হামলাকারীসহ বেশ কয়েক ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছে।
শুক্রবারের ওই ঘটনার পর গতকাল শনিবার বিকেল পর্যন্ত প্রকাশ্যে কোনো বক্তব্য দেননি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। পরে হামলাকারীদের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নাৎসি বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে তুলনা করেন তিনি। বলেন, রাশিয়ার ঐক্যে কেউ ফাটল ধরাতে পারবে না। রোববার (আজ) এক দিনের জাতীয় শোক পালন করা হবে।