ক্যামেরনের ফেরায় কী বার্তা পাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্য
যুক্তরাজ্যে প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের সরকারে বড় রদবদল ঘটে গেছে। গত সোমবার বরখাস্ত করা হয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুয়েলা ব্রেভারম্যানকে। লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশ ফিলিস্তিনপন্থী বিক্ষোভকারীদের প্রতি বাড়তি সহানুভূতি দেখিয়েছে বলে মন্তব্য করে সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন ব্রেভারম্যান। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেমস ক্লেভারলি।
এরপর ক্লেভারলির জায়গায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী পদে নিয়োগ পেয়েছেন ডেভিড ক্যামেরন। কনজারভেটিভ পার্টির নেতা ক্যামেরন ২০১০ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। পরবর্তী সময় গণভোটে ব্রেক্সিটের পক্ষে রায় আসার পর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব ছেড়েছিলেন তিনি। ঋষি সুনাকের সরকারে নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে ক্যামেরনের নিয়োগ দেশে-বিদেশে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
ক্যামেরন এমন সময়ে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব নিলেন, যখন উত্তপ্ত রয়েছে মধ্যপ্রাচ্য। নির্বিচার বোমা ফেলা হচ্ছে ফিলিস্তিনের গাজায়। মাসখানেকের বেশি সময় ধরে চলা ইসরায়েলি হামলায় প্রাণ গেছে শিশু, নারীসহ ১১ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনির। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোয় ক্ষোভ বাড়ছে।
এমন সংঘাতময় পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠেছে, মধ্যপ্রাচ্যের এ সংকটে ক্যামেরন যুক্তরাজ্যের স্বার্থ কতটা অক্ষুণ্ন রাখতে পারবেন?
সৌদি আরবের সঙ্গে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরনের ব্যক্তিগত সম্পর্ক তাঁর রাজনৈতিক পুনঃপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।বেন হুইথাম, লন্ডনের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক।
কট্টর ইসরায়েলপন্থী
এর আগে ক্যামেরন গাজা উপত্যকাকে ‘একটি বন্দিশিবির’ বলে অভিহিত করেছিলেন। সেই সঙ্গে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের ‘দ্বিরাষ্ট্র’ সমাধানের পক্ষে কথা বলেছেন। যদিও ক্যামেরন একজন ইসরায়েলপন্থী, এতে সন্দেহ নেই। গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েল ভূখণ্ডে নজিরবিহীন হামলা চালায় ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস। এর দুই দিন পরেই অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় সর্বাত্মক হামলা শুরু করে ইসরায়েলি বাহিনী। তখন ইসরায়েলের পক্ষে নিজের সমর্থন জানিয়েছিলেন ক্যামেরন।
২০১৪ সালে অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ভয়াবহ বোমা হামলা চালিয়েছিল ইসরায়েলি বাহিনী। ওই সময় হামলা বন্ধের লক্ষ্যে জোটসঙ্গীরা ইসরায়েলকে অস্ত্র রপ্তানির লাইসেন্স পুনর্মূল্যায়ন করতে সরকারকে চাপ দেয়। ক্যামেরনের নেতৃত্বে থাকা কনজারভেটিভ পার্টি তা প্রত্যাখ্যান করে।
গাজায় ইসরায়েলি হামলা শুরুর পর এক্সে (সাবেক টুইটার) পোস্ট করেন ক্যামেরন। পোস্টে ইসরায়েলের নীল-সাদা রঙের পতাকার ছবি জুড়ে দেন তিনি। লেখেন, ‘সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং এ সময়ে আমি ইসরায়েলের পাশে আছি। সেই সঙ্গে ইসরায়েলের প্রতি প্রধানমন্ত্রী (ঋষি সুনাক) ও যুক্তরাজ্য সরকারের দ্ব্যর্থহীন অবিচল সমর্থনে আমার পূর্ণ আস্থা রয়েছে।’
যুক্তরাজ্য সরকার ইসরায়েলকে অবিচল সমর্থন জোগালেও লন্ডনের রাজপথে ফিলিস্তিনপন্থীদের মিছিলে জনসমাগম ক্রমেই বাড়ছে। সেই তুলনায় ইসরায়েলপন্থীদের সমাবেশে ভিড় বেশ কম। বরখাস্ত হওয়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুয়েলা বলেছিলেন, লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশ ফিলিস্তিনপন্থী বিক্ষোভকারীদের প্রতি বাড়তি সহানুভূতি দেখিয়েছে। এ মন্তব্য নিয়ে তুমুল বিতর্ক-সমালোচনার মুখে পড়েন সুয়েলা। অতঃপর গতকাল তাঁকে পদ ছাড়তে হয়। এর পরপরই ঋষি সুনাক সরকারে যুক্ত হন ক্যামেরন।
মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে সুসম্পর্ক
ক্যামেরনের প্রশাসনে ফেরার বিষয়ে লন্ডনের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক বেন হুইথাম বলেন, এটা নিশ্চিত যে চলমান সংঘাতে ক্যামেরন ফিলিস্তিনিদের পক্ষে থাকবেন না। তবে তাঁর কথায় ‘আরও সমঝোতামূলক সুর’ আশা করা হয়েছিল।
যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স ২০১১ সালে লিবিয়ায় হস্তক্ষেপ করে। ওই সময় ক্যামেরন যুক্তি দেখান যে এর মধ্য দিয়ে স্বৈরশাসক গাদ্দাফির হাত থেকে দেশটির সাধারণ মানুষকে রক্ষা করা হবে। পরবর্তী সময় যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক কমিটি এই সিদ্ধান্ত পর্যালোচনা করে। জানায়, ক্যামেরনের এই নীতি সঠিক ছিল না।
বেন হুইথাম আরও বলেন, কনজারভেটিভ দলের অন্য জ্যেষ্ঠ রাজনীতিকদের মতো তিনিও (ক্যামেরন) ইসরায়েলের আত্মরক্ষা এবং গাজায় ব্যাপক হামলা চালানোর অধিকারের পক্ষে রয়েছেন। এ পরিস্থিতিতে ক্যামেরনকে প্রশাসনে যুক্ত করার উদ্দেশ্য হলো, কনজারভেটিভ পার্টিতে বিদ্যমান বিভাজন কমিয়ে আনা।
সৌদি আরবের বর্তমান শাসক পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিগত সম্পর্ক রয়েছে ক্যামেরনের। সেই সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ক্যামেরনের কৌশলগত অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব বেশ পোক্ত—এমনটা জানিয়েছেন বেন হুইথাম।
অনেকটা নেতানিয়াহুর মতো
প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে ক্যামেরন ইসরায়েলের সমালোচনা করেছিলেন। ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে দেশটির বসতি স্থাপনকে ‘বেআইনি’ বলেছিলেন। ২০১০ সালে তুরস্কে সফরে যান ক্যামেরন। তখন বলেন, ‘গাজা কখনোই একটি বন্দিশিবির হতে পারে না।’
কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে উল্টো ঘটনা দেখা গেছে। ২০১৪ সালে অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ভয়াবহ বোমা হামলা চালিয়েছিল ইসরায়েলি বাহিনী। ওই সময় হামলা বন্ধের লক্ষ্যে জোটসঙ্গীরা ইসরায়েলকে অস্ত্র রপ্তানির লাইসেন্স পুনর্মূল্যায়ন করতে সরকারকে চাপ দেয়। ক্যামেরনের নেতৃত্বে থাকা কনজারভেটিভ পার্টি তা প্রত্যাখ্যান করে।
ওই ঘটনার পর ইসরায়েলি সংবাদপত্র হারেৎজ এক নিবন্ধে ক্যামেরনকে ইসরায়েলের প্রতি ‘সবচেয়ে সহানুভূতিশীল’ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে উল্লেখ করে। নিবন্ধে বলা হয়, ‘মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে ক্যামেরনের চিন্তাভাবনা অনেকটা ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর মতো।’
নেতানিয়াহু ২০০৯ সাল থেকে ইসরায়েলে ক্ষমতায় আছেন। তাঁর নেতৃত্বে গাজায় নির্বিচার হামলা ও প্রাণহানি চলছে। যুদ্ধবিরতির আন্তর্জাতিক চাপ একাধিকবার প্রত্যাখ্যান করেছেন তিনি। এর আগে ২০১৪ সালের আগস্টে ইসরায়েলি হামলায় ২ হাজার ২৫১ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছিলেন। গাজার পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাজ্য সরকারের অবস্থানের প্রতিবাদে পদত্যাগ করেছিলেন ক্যামেরন সরকারের জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী সাঈদা ওয়ারসি। তিনি যুক্তরাজ্যের ইতিহাসে প্রথম মুসলিম মন্ত্রী ছিলেন।
সৌদি আরবের ভূমিকা আছে
হুইথাম বলেন, সৌদি আরবের সঙ্গে ক্যামেরনের সম্পর্ক এতটাই গভীর যে ২০১৯ সালে ‘দাভোস ইন দ্য ডেজার্ট’ শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নিতে দেশটি সফর করেছিলেন তিনি। এ সময় ক্যামেরনের সঙ্গে ছিলেন ব্রাজিলের সাবেক প্রেসিডেন্ট জইর বলসোনারো, মার্কিন প্রেসিডেন্টের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা জেরার্ড কুশনার প্রমুখ।
হুইথামের মতে, সৌদি আরবের সঙ্গে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরনের ব্যক্তিগত সম্পর্ক তাঁর রাজনৈতিক পুনঃপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তিনি বলেন, যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম একটি স্তম্ভ মধ্যপ্রাচ্য। ব্রেক্সিট-পরবর্তী সময়ে তা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সৌদি আরবের মতো ইউরোপের বাইরের একটি বিদেশি কৌশলগত মিত্র লন্ডনের কাছে সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ।
বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে মধ্যপ্রাচ্যের মিত্রদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা যুক্তরাজ্যের কাছে সবকিছুর ওপরে। এ কাজে ক্যামেরন একজন যোগ্য ব্যক্তি। ঋষি সুনাক এই সুবিধা কাজে লাগানোর জন্য ক্যামেরনকে প্রশাসনে যুক্ত করেছেন বলেই মনে করেন হুইথাম।
শক্তি প্রয়োগের পক্ষে
যুক্তরাষ্ট্রের মতো যুক্তরাজ্যও হামাসের মতো মধ্যপ্রাচ্যের স্বাধীনতাকামী সংগঠনগুলোকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ বিবেচনা করে। ক্যামেরন এসব সংগঠনকে দমাতে যুক্তরাজ্যের সামরিক শক্তি প্রয়োগের পক্ষে ছিলেন। ২০১৪ সালে ইরাক ও সিরিয়ার বড় অংশজুড়ে ‘খেলাফত’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যপূরণে নেমেছিল আইএস। তখন ক্যামেরন বলেছিলেন, আইএসের লক্ষ্য পূরণ হলে ভূমধ্যসাগরের পশ্চিম তীরে একটি ‘উগ্রবাদী’ রাষ্ট্রের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।
ইরাক ও সিরিয়ায় বোমা হামলা জোরালো করতে ক্যামেরনের সরকার অনুমোদন দিয়েছিল। হুইথামের মতে, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্যামেরনের সবচেয়ে বিতর্কিত সিদ্ধান্তগুলোর একটি ছিল সিরিয়ায় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে সমর্থন দেওয়া। এর মধ্য দিয়ে সিরিয়া ভূখণ্ডে ব্যাপক পরিসরে ড্রোন হামলা শুরু হয়, যা আজও অব্যাহত আছে।
ব্রেক্সিট ভোটের পর ২০১৬ সালে পদত্যাগ করেন ক্যামেরন। এরপর তাঁর মধ্যপ্রাচ্য নীতি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এসব নীতি অঞ্চলটির সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে দীর্ঘ মেয়াদে প্রভাব রেখেছে।
লিবিয়ায় ভুল নীতি
যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স ২০১১ সালে লিবিয়ায় হস্তক্ষেপ করে। ওই সময় ক্যামেরন যুক্তি দেখান যে এর মধ্য দিয়ে স্বৈরশাসক গাদ্দাফির হাত থেকে দেশটির সাধারণ মানুষকে রক্ষা করা হবে। পরবর্তী সময় যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক কমিটি এই সিদ্ধান্ত পর্যালোচনা করে। জানায়, ক্যামেরনের এই নীতি সঠিক ছিল না। এর ফলে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে ধসে পড়ে উত্তর আফ্রিকার দেশটি।
পার্লামেন্টারি কমিটির পর্যালোচনায় বলা হয়, লিবিয়ায় হস্তক্ষেপের সিদ্ধান্ত নেওয়া ক্ষেত্রে ক্যামেরন গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক ছিলেন। তাই এই ভুলের দায় তিনি এড়াতে পারেন না।
হুইথাম আরও বলেন, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার মতো ডেভিড ক্যামেরন মধ্যপ্রাচ্যের বড় একটি অংশে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের পথ খুলে দিয়েছিলেন। ক্যামেরন দেখিয়েছেন যে তিনি এই অঞ্চলে সামরিক হস্তক্ষেপে বেশ আগ্রহী।
এখন গাজা ও হামাস ইস্যুতে ইসরায়েলের সঙ্গে সুর মেলাতে পারেন ক্যামেরন। হামাসকে আইএসের বর্ধিতাংশ হিসেবে চিহ্নিত করতে পারেন। তবে সিদ্ধান্ত হয়তো নেবেন ঋষি সুনাক নিজে। ক্যামেরনকে শুধু তা বাস্তবায়ন করতে হবে।
অনুবাদ করেছেন অনিন্দ্য সাইমুম