জেলেনস্কি থাকলে কি চলতি বছর ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ হবে

দেখতে দেখতে আরেকটি বছর শেষ হয়ে গেল। শুরু হয়েছে নতুন বছর। নির্বাচন, মূল্যস্ফীতি আর যুদ্ধের বছর ছিল ২০২৪। গত বছর বিশ্বের নানা প্রান্তে ঘটে যাওয়া বিশেষ বিশেষ ঘটনা নিয়ে পাঠকদের জন্য আমাদের বিশেষ আয়োজন।

নতুন বছরের প্রাক্কালে দুষ্ট আত্মাকে তাড়াতে ও শুভ আত্মার আহ্বান জানিয়ে উদ্‌যাপন করা হচ্ছে ইউক্রেনের মালাঙ্কা লোকজ উৎসব। ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪ছবি : রয়টার্স

‘যুদ্ধ একদিন শেষ হবে। নেতারা করমর্দন করবেন। বৃদ্ধ মা তাঁর শহীদ তরুণ সন্তানের জন্য গোপনে অশ্রুপাত করবেন। নারী অপেক্ষায় থাকবেন তাঁর প্রিয় জীবনসঙ্গীর; শিশুরা তাদের বীর বাবাকে দেখবে বলে প্রহর গুনবে। মাঝখান দিয়ে কারা স্বদেশ ভাগ-বাঁটোয়ারা করে দিয়েছে, তা আমি জানি না। কিন্তু এ যুদ্ধের মূল্য কারা চুকেছেন, তা আমি জানি।’

ফিলিস্তিনের বিখ্যাত কবি মাহমুদ দারবিশ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ১৯৮৭ সালে প্রথম ইন্তিফাদার (গণ-অভ্যুত্থান) আগে ‘যুদ্ধ একদিন শেষ হবে’ নামের একটি কবিতা লিখেছিলেন। উল্লিখিত চরণগুলো সেই কবিতার। ইউক্রেন যুদ্ধের শুরুতে কবিতাটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। এখন কবিতাটির প্রাসঙ্গিকতা কবির জন্মভূমি ফিলিস্তিনের পাশাপাশি ইউক্রেনের জন্যও সমানতালে বেড়েছে।

আগামী ফেব্রুয়ারিতে তিন বছর পূর্ণ হতে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধও এভাবে একদিন শেষ হবে। বিশ্লেষকদের একাংশের মতে, এই যুদ্ধ শেষ হওয়ার জন্য যেসব শর্ত দরকার, তা এরই মধ্যে পূর্ণ হয়েছে। তাই আগামী বছরের মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ–পরবর্তী ইউরোপের সবচেয়ে ভয়াবহ এ যুদ্ধের পরিসমাপ্তি হতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

আরও পড়ুন

ট্রাম্পের বিজয়

ডোনাল্ড ট্রাম্প আবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়াকে আগামী বছরের মধ্যে ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ হওয়ার প্রধানতম কারণ বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। শুরু থেকেই তিনি ইউক্রেনকে বিপুল মার্কিন সহায়তা দেওয়ার ঘোরবিরোধী। তাঁর দল রিপাবলিকান পার্টির অধিকাংশ সদস্যের মনোভাবও তা–ই।

ট্রাম্প বলেছেন, ক্ষমতা গ্রহণের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই তিনি ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করবেন। তবে কীভাবে করবেন, সে বিষয়ে বিস্তারিত কিছু তিনি বলেননি।

নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প (বাঁয়ে) ও ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ। প্যারিসের নটর-ডেম ক্যাথেড্রালের ভেতরে, ৭ ডিসেম্বর ২০২৪
ছবি : এএফপি

চলতি মাসের শুরুর দিকে প্যারিসে ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে বৈঠক করেন ট্রাম্প। বৈঠক শেষে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক পোস্টে ট্রাম্প লেখেন, ‘জেলেনস্কি ও ইউক্রেন একটি চুক্তি করে এই পাগলামি বন্ধ করতে রাজি হতে পারে বলে মনে হচ্ছে। অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি হওয়া দরকার, এ জন্য আলোচনা শুরু হওয়া উচিত।’

২০ জানুয়ারি ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেবেন। ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই তিনি ইউক্রেনে সামরিক সহায়তা দেওয়া বন্ধ করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া দূরপাল্লার অস্ত্র দিয়ে রাশিয়ার অভ্যন্তরে হামলার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের দেওয়া অনুমতিও তিনি বাতিল করতে পারেন।
ট্রাম্প ন্যাটো থেকে বের হয়ে যাওয়ারও হুমকি দিয়েছেন। গত ৮ ডিসেম্বর এনবিসি টেলিভিশনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমার দ্বিতীয় মেয়াদে পশ্চিমা সামরিক জোটটিতে যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণ অব্যাহত থাকবে, আমি এমন কোনো সম্ভাবনা দেখছি না।’

ট্রাম্প প্রশাসনে ইউক্রেনবিরোধীরা

ট্রাম্প এরই মধ্যে মন্ত্রিসভা ও প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে বিভিন্ন ব্যক্তিকে মনোনয়ন দিয়েছেন। ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের আইনপ্রণেতা মাইক ওয়াল্টজকে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা পদে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক বিশ্লেষক বেন শাপিরোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মাইক বলেছেন, ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) মত বদলাচ্ছে। তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র অনির্দিষ্টকালের জন্য ইউক্রেনকে ‘ব্ল্যাঙ্ক চেক’ দিয়ে যাবে না বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি।

কিথ কেলগকে ইউক্রেন বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ দূত হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন ট্রাম্প। সাবেক এ সেনা কর্মকর্তা ট্রাম্পের গত আমলের ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি কিয়েভকে নির্বিচারে মার্কিন সহায়তা দেওয়া বন্ধের দাবি করেছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে কথা বলছেন ইলন মাস্ক। টেক্সাসের ব্রাউনসভিলে মাস্কের কোম্পানি স্পেসএক্স স্টারশিপ রকেটের ষষ্ঠ পরীক্ষামূলক ফ্লাইট উৎক্ষেপণে, ১৯ নভেম্বর ২০২৪
ছবি : রয়টার্স

আসন্ন ট্রাম্প প্রশাসনে এলব্রিজ কোলবি নীতিমালাবিষয়ক আন্ডারসেক্রেটারি হিসেবে কাজ করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও উপপ্রতিরক্ষামন্ত্রীকে পরামর্শ দেওয়াই তাঁর প্রধান কাজ। ট্রাম্পের প্রথম আমলে তিনি পেন্টাগনে গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন। দেশটির জাতীয় প্রতিরক্ষা কৌশলের খসড়া প্রণয়নে তাঁর অবদান রয়েছে। যেসব কূটনীতিক ও রাজনৈতিক ইউক্রেনে বাইডেন প্রশাসনের উদার হাতে সহায়তা দেওয়ার চরম বিরোধী ছিলেন, এলব্রিজ তাঁদের অন্যতম।

ধনকুবের ইলন মাস্ককে ‘ডিপার্টমেন্ট অব গভর্নমেন্ট ইফিসিয়েন্সি’ নামের একটি নতুন বিভাগের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সরকারের ব্যয় কমানোই এই বিভাগের কাজ। ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা কমিয়ে তিনি যে ব্যয় সংকোচনের উদ্যোগ নেবেন, তা বলা বাহুল্য। তা ছাড়া পুতিন ও মাস্ক নিয়মিত যোগাযোগ করেন বলে গত অক্টোবরে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছিল।

পুতিনের মনোভাব

শুরু থেকেই রাশিয়া বলে আসছে, তারা যুদ্ধ বন্ধে আলোচনায় প্রস্তুত। দেশটির শীর্ষ রাজনীতিবিদ ও কূটনীতিকদের পাশাপাশি পুতিনও একই কথা একাধিকবার বলেছেন।

রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন
ফাইল ছবি: রয়টার্স

গত ১৯ ডিসেম্বর বছরের শেষ সংবাদ সম্মেলনে পুতিন বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে আমি যেকোনো সময় যুদ্ধ বন্ধ নিয়ে আলোচনা করতে প্রস্তুত। তিনি চাইলে যেকোনো সময় এ বৈঠক হতে পারে।’

রাশিয়ার শর্ত

যুদ্ধ বন্ধ করা বা শান্তিচুক্তির জন্য মস্কোর প্রধান শর্ত, ইউক্রেনকে ‘মাঠের বাস্তবতা’ মেনে নিতে হবে। অর্থাৎ রাশিয়া এরই মধ্যে যেসব ভূখণ্ড দখলে নিয়েছে, তা আর কখনো ইউক্রেনের কাছে ফেরত যাবে না। কিয়েভ এসব শর্ত প্রত্যাখ্যান করেছে।

রাশিয়ার আরেকটি অন্যতম শর্ত, কিয়েভকে নিরপেক্ষ থাকতে হবে। এ কথার অর্থ হলো, দেশটি কখনো যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্য হতে পারবে না। মস্কোর এই শর্ত নতুন নয়। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত রাশিয়া বিলুপ্তি ঘোষণার পর থেকেই পশ্চিমাদের কাছে মস্কো এই দাবি করে আসছে। তাদের যুক্তি, কিয়েভ ন্যাটোর ছায়াতলে গেলে মস্কোর নিরাপত্তা বলতে কিছু থাকবে না। এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।

আরও পড়ুন

জেলেনস্কি কী ভাবছেন

ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে জেলেনস্কির সুর নরম হয়ে এসেছে। গত নভেম্বরের মাঝামাঝি ইউক্রেনের সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেছেন, ‘ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁর সঙ্গে আমার “গঠনমূলক” আলোচনা হয়েছে। হোয়াইট হাউসে যে নতুন দলটি আসছে, তাদের নীতির কারণে যুদ্ধ দ্রুত শেষ হবে।’

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি
ফাইল ছবি: রয়টার্স

প্রায় কাছাকাছি সময়ে ইউক্রেনের জাতীয় রেডিওকে জেলেনস্কি বলেছেন, ২০২৫ সালের মধ্যে যাতে “কূটনৈতিক উপায়ে” যুদ্ধ শেষ হয়, সে জন্য তাঁরা সবকিছু করছেন।

পুতিন যেদিন বছরের শেষ সংবাদ সম্মেলন করেছেন, সেদিন ব্রাসেলসে ন্যাটো ও ইইউর নেতারাও ইউক্রেন নিয়ে আলোচনায় বসেছিলেন। সেখানে সবার কণ্ঠে শান্তিচুক্তি কথা প্রাধান্য পেয়েছে।

ইউক্রেন কী চায়

যুদ্ধের শুরু থেকেই জেলেনস্কি বলে আসছেন, ভূখণ্ড নিয়ে মস্কোর সঙ্গে কোনো আপস করা যাবে না। ১৯৯১ সালের সীমারেখায় ফেরত যেতে হবে। ২০১৪ সালে অধিকৃত ক্রিমিয়াসহ ইউক্রেনের প্রতি ইঞ্চি ভূখণ্ড পুনরুদ্ধার করতে হবে। অবকাঠামো ধ্বংসের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে এবং যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য রাশিয়ার অভিযুক্ত সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের কিয়েভের হাতে হস্তান্তর করতে হবে।

কিয়েভের আরেকটি প্রধান দাবি, ইউক্রেনের জন্য ন্যাটোর নিরাপত্তা নিশ্চয়তা মেনে নিলেই কেবল মস্কোর সঙ্গে শান্তিচুক্তি হবে। রাশিয়া এসব দাবি কোনোভাবেই মানা হবে না বলে জানিয়েছে।

রণক্ষেত্রে এগিয়ে রাশিয়া

ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের দনবাসে রুশপন্থী বিদ্রোহীদের সঙ্গে দেশটির সরকারি বাহিনীর যুদ্ধ চলছে মূলত ২০১৪ সাল থেকে। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ার ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ শুরুর পর অঞ্চলটিতে এরই মধ্যে চারটি স্বায়ত্তশাসিত প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করে তা নিজেদের ভূখণ্ডের অংশ করে নিয়েছে মস্কো।

রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত একটি আবাসিক ভবনে উদ্ধার তৎপরতা চালাচ্ছেন ইউক্রেনের জরুরি বিভাগের কর্মীরা। জাপোরিঝঝিয়া, ইউক্রেন, ১০ অক্টোবর ২০২২
ছবি: রয়টার্স

প্রজাতন্ত্রগুলো হলো দোনেৎস্ক, লুহানস্ক, খেরসন ও জাপোরিঝঝিয়া। এসব অঞ্চলের জনসংখ্যার বড় অংশ রুশ ভাষায় কথা বলে। সেখানে বর্তমানে রাশিয়ার প্রশাসন চলছে। মুদ্রা রাশিয়ার, সংবাদমাধ্যম, রাস্তার ফলক, স্কুল-কলেজের বই—সবকিছু রুশ ভাষায় হচ্ছে।

এসব প্রজাতন্ত্রের কিছু অংশ এখনো ইউক্রেনের সেনাদের দখলে আছে। তবে চলতি বছর রাশিয়ার সেনারা আগের দুই বছরের চেয়ে অনেক দ্রুত নতুন নতুন অঞ্চল দখলে নিচ্ছেন। রুশ সেনারা শুধু গত নভেম্বরে দৈনিক গড়ে প্রায় ৩০ বর্গকিলোমিটার ভূখণ্ড দখলে নিয়েছেন।

ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ারের তথ্যমতে, ডিসেম্বরের প্রথমার্ধ পর্যন্ত চলতি বছর রুশ বাহিনী ইউক্রেনের প্রায় ২ হাজার ৭০০ বর্গকিলোমিটার ভূখণ্ড দখল করেছে। ২০১৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত সাকল্য ইউক্রেনের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ বা ২০ শতাংশ ভূখণ্ড দখলে নিয়েছে রাশিয়া।

এ জন্য রাশিয়াকে চরম মূল্য দিতে হয়েছে। গত নভেম্বরে যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষা বিভাগের এক মূল্যায়নে বলা হয়েছে, যুদ্ধে রাশিয়ার প্রায় ৩ লাখ ৫০ হাজার সেনা হতাহত হয়েছেন। রাশিয়ার স্বাধীন সংবাদমাধ্যম মিডিয়াজোনা গত সেপ্টেম্বরে শেষ পর্যন্ত রাশিয়ার ৭১ হাজারের বেশি সেনা নিহত হওয়ার কথা নিশ্চিত করেছে।

বিমর্ষ ইউক্রেন

রণক্ষেত্রে ইউক্রেনের বলার মতো কোনো সাফল্য নেই। এখন পর্যন্ত তাদের বড় সাফল্য রুশ সেনাদের কিয়েভ দখলের চেষ্টা সফলভাবে ঠেকিয়ে দেওয়া। গত বছরের গ্রীষ্মে দখলদার রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে পাল্টা হামলা শুরু করেছিল ইউক্রেন। কিয়েভ ও তার মিত্রদের এই পাল্টা হামলা নিয়ে ব্যাপক প্রত্যাশা ছিল, কিন্তু মোটাদাগে তা ব্যর্থ হয়েছে।

আহত এক সহকর্মীকে উদ্ধার করে নিয়ে যাচ্ছেন ইউক্রেনীয় সেনারা
ছবি: এএফপি

গত আগস্টে সীমান্তবর্তী রাশিয়ার কুরস্ক অঞ্চলে ঢুকে পড়েন ইউক্রেনের সেনারা। স্থানীয় কিছু বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সহযোগিতায় তাঁরা সেখানে প্রবেশ করেন। অল্প দিনের মধ্যে তাঁরা প্রায় ১ হাজার ৪০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা দখলে নেন। রাশিয়া সেখানে প্রায় ৫০ হাজার সেনা মোতায়েন করেছে। এর মধ্যে উত্তর কোরিয়ার ১২ হাজার ভাড়াটে সেনা রয়েছেন। বর্তমানে সেখানে তীব্র যুদ্ধ চলছে। ইউক্রেন সম্প্রতি দাবি করেছে, উত্তর কোরিয়ার প্রায় ১ হাজার সেনাকে তারা হত্যা করেছে। কিন্তু রুশ বাহিনী দ্রুত হারানোর ভূখণ্ড পুনরুদ্ধার করছে। সর্বশেষ তথ্যমতে, কুরস্ক অঞ্চলের ৮০০ বর্গকিলোমিটার মতো অঞ্চল এখনো ইউক্রেনের সেনাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
অন্যদিকে নভেম্বরের শেষের দিকে যুক্তরাষ্ট্রের দূরপাল্লার অস্ত্র দিয়ে রাশিয়ার ভূখণ্ডের গভীরে চালানো ইউক্রেনের হামলাও এতটা কার্যকর হয়নি। এর প্রতিক্রিয়ায় রাশিয়া ওরেশনিক নামের নতুন মাঝারি পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। এতে করে ইউক্রেনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোর যে ক্ষতি হয়েছে, তা নজিরবিহীন বলে উল্লেখ করা হয়েছে এশিয়া টাইমসের এক বিশ্লেষণে।

অন্যদিকে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ইউক্রেনের প্রায় ৮০ জন সেনা মারা গেছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে বিভিন্ন পশ্চিমা দেশের পরিসংখ্যানে।

ইউরোপের চিন্তাভাবনা

ইউরোপের দেশে দেশে অতি ডানপন্থীদের উত্থানের পেছনে ইউক্রেন যুদ্ধ বড় ভূমিকা রয়েছে। এর সর্বশেষ নজির, জার্মানির বাম ঘরানার সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এসপিডি) নেতৃত্বাধীন জোট সরকার ভেঙে যাওয়া। এসপিডির চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ অনাস্থা ভোটে হেরে গেছেন। আগামী ২৩ ফেব্রুয়ারি দেশটিতে আগাম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এতে মধ্য-ডানপন্থী রাজনৈতিক দল খ্রিষ্টান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়নের (সিডিইউ) ফ্রেডরিখ মার্জ চ্যান্সেলর হতে পারে। তিনি ইউক্রেনকে শলৎজের চেয়ে বেশি সহায়তা দেবেন বলে আশা করা হচ্ছে।

ইউরোপীয় কাউন্সিলের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ও পর্তুগালের সাবেক প্রধানমন্ত্রী আন্তোনিও কোস্তা, ইইউর বিদেশবিষয়ক নতুন মন্ত্রী ও এস্তোনিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী কাজা কালাজ, ন্যাটোর নতুন মহাপরিচালক ও নেদারল্যান্ডসের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুটে ইউক্রেনকে সর্বাত্মক সহায়তা অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন।

তবে ইউরোপের নেতারা আগের মতো ইউক্রেনের জয়ের কথা বলছেন না। এর বদলে তাঁরা এখন পুতিনের জয় ঠেকানোর কথা বলছেন। যেটাকে ট্রাম্পের সম্ভাব্য জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইক ওয়াল্টজ ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে ইইউ ও ন্যাটোর মতে ‘বদল’ বলে উল্লেখ করেছেন।

ন্যাটো ইউক্রেনকে সদস্য করার ঘোষণা দিয়েছে, কিন্তু এখনো দেশটি কোনো আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণ পাঠায়নি। কিংবা আগামী কত বছরের মধ্যে ইউক্রেন সামরিক জোটটির সদস্য হবে, তা নিয়ে ন্যাটো কোনো কিছু জানায়নি।

যেভাবে শেষ হতে পারে

আগামী বছরের মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ হতে পারে বলে মনে করলেও তা ঠিক কীভাবে হবে, কোনো বিশেষজ্ঞ তা স্পষ্টভাবে বলতে পারছেন না।

‘দ্য ফেইট অব দ্য ওয়েস্ট’ বইয়ের লেখক ও দ্য ইকোনমিস্টের সাবেক সম্পাদক বিল এমটের মতে, ‘যেকোনো দর-কষাকষি অসম্ভব দাবি দিয়ে শুরু হয়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের নতুন আলোচনাও এভাবে শুরু হবে।’

তবে জেলেনস্কি ক্ষমতায় থাকাবস্থায় রাশিয়ার সঙ্গে শান্তিচুক্তি সম্ভব নয় বলে মনে করেন বিল এমট। তাই তাঁর প্রস্তাব, ‘জেলেনস্কি যথেষ্ট বীরত্ব দেখিয়েছেন। এখন তাঁকে বিশ্রাম দেওয়া দরকার।’

ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ ইউক্রেনের সঙ্গে কথা বলতে রাশিয়া প্রস্তুত জানিয়ে সম্প্রতি বলেছেন, ‘২০২২ সালের অক্টোবরে জারি করা এক ডিক্রিতে জেলেনস্কি পুতিনের সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনা সম্ভব নয় বলে ঘোষণা দিয়েছেন। এ অবস্থায় তাঁর সঙ্গে শান্তি আলোচনা কীভাবে হবে?’

এর অর্থ দাঁড়ায়, রাশিয়ার সঙ্গে চূড়ান্ত শান্তি আলোচনার জন্য কিয়েভের নেতৃত্বে পরিবর্তন আনতে হবে।

আরেকটি বিকল্প হতে পারে, যুদ্ধকে হিমাগারে (ফ্রোজেন) পাঠানো। অর্থাৎ রুশ ও ইউক্রেনের সেনারা যে যেখানে আছেন, তাঁরা সেখানেই থাকবেন, সেখান থেকে সামনে-পেছনে নড়বেন না।

ট্রাম্প এই সমাধানের পথে হাঁটবেন বলে আশঙ্কা করছেন কিয়েভ ও ইউরোপের নেতারা। তাঁদের যুক্তি, এতে করে রাশিয়া নতুন করে শক্তি সঞ্চয়ের সুযোগ পাবে। কয়েক বছর পর নতুন উদ্যমে হামলা শুরু করবে। তখন ইউরোপের অন্য দেশেও হামলা চালাতে পারে রাশিয়া। তবে জন মেয়ারশাইমার, জেফ্রি শ্যাক্সসহ যুক্তরাষ্ট্রের অধিকাংশ পণ্ডিত এই ধারণা অমূলক বলে মনে করেন।

যুক্তরাজ্যের রয়াল ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স বা চ্যাথাম হাউসের মতে, ‘যুদ্ধ ২০২৫ সালের মধ্যেই শেষ হবে বলে মনে হচ্ছে। সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে রাশিয়ার ওপর সর্বোচ্চ চাপ তৈরি করতে হবে, যাতে সে সর্বোচ্চ ছাড় দিতে বাধ্য হয়।’

ইউক্রেনের অন্যতম বড় অর্থদাতা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও (আইএমএফ) মনে করে, ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ বা ২০২৬ সালের মধ্যভাগে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ হবে। এর বেশি যুদ্ধটি গড়ানোর আশঙ্কা নেই।

  • সূত্র : রয়টার্স, বিবিসি, গার্ডিয়ান, আরটি, এশিয়া টাইমস, দ্য কনভারসেশন, চ্যাথাম হাউস