‘এখন সব নিয়ম বদলে গেল’: মঞ্চে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় ট্রাম্প আসার অপেক্ষা

যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। ট্রাম্প রিপাবলিকান পার্টির প্রেসিডেন্ট প্রার্থী মনোনীত হওয়ার পর গত বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে ট্রাম্প টাওয়ারে তাঁদের এই সাক্ষাৎ হয়ছবি: রয়টার্স

ইউক্রেন যুদ্ধ আরও এক বছর পেরিয়ে নতুন বছরে পা রাখল। তবে সদ্য যে বছরটি শেষ হলো, নতুন বছরের শুরুটাও হলো তেমনি, ইউক্রেনজুড়ে রাশিয়ার প্রাণঘাতী ড্রোন হামলায়। ২০২৫ সালের প্রথম প্রহরেই রাশিয়ার হামলায় কিয়েভে একজন নিহত হন। আহত হন অন্তত ছয়জন।

রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসনের পর যুদ্ধের মধ্যে এ নিয়ে তৃতীয়বার নতুন বছর শুরু করল ইউক্রেন। ইউক্রেন ২০২৩ সাল এ আশা নিয়ে শুরু করেছিল যে সম্মুখসমরে ইউক্রেনীয় বাহিনীর অগ্রসর হওয়ার মধ্য দিয়ে পিছু হটবে রাশিয়া এবং এর মধ্য দিয়ে কিয়েভ একটি পূর্ণ বিজয়ের দিকে এগিয়ে যাবে। তবে ২০২৪ সালের শুরুতে এসে দেখা গেল, দীর্ঘ যুদ্ধের বিষয়টি মেনে নিয়েছে ইউক্রেনের সেনাবাহিনী ও দেশটির মানুষ। পাশাপাশি দ্রুত বিজয়ের যে কথা বলা হচ্ছিল, সেটাও ছিল একটা বিভ্রম।

২০২৫ সালটা ইউক্রেন এমন একটা পরিস্থিতিতে শুরু করল, যখন যুদ্ধ নিয়ে তাদের মনোবল সবচেয়ে খারাপ অবস্থা গিয়ে ঠেকেছে। পাশাপাশি ডোনাল্ড ট্রাম্প আবারও ওয়াশিংটনে ক্ষমতার মসনদে বসতে যাচ্ছেন। গত নভেম্বরে দ্বিতীয়বারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত ট্রাম্প বলেছেন, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তাঁর সবচেয়ে অগ্রাধিকারে থাকা বিষয়গুলোর একটি হবে ইউক্রেনে যুদ্ধ থামানো। আর এই কাজের জন্য তিনি মার্কিন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল কেইথ কেলগকে বিশেষ দূত হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন।

২০ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেবেন ট্রাম্প। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই বর্ষীয়ান সামরিক কর্মকর্তা কেইথ কেলগ কিয়েভ সফর করবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ কাজের জন্য কেলগকে নিয়োগ দেওয়ায় ইউক্রেনও খুশি। কারণ, তিনি ছাড়া ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠজনদের অনেকের রাশিয়াপন্থী হওয়ার বিষয়টি বেশ স্পষ্ট। কেলগ অবশ্য আগেই কিয়েভ সফর করেছেন। স্বচক্ষে তিনি যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি দেখে এসেছেন। ইউক্রেনের কর্মকর্তাদের ধারণা, এ ধরনের সফর ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে পশ্চিমা রাজনীতিকদের মনোভাব পুরোপুরি বদলে দেবে।

ট্রাম্পের ইউক্রেনবিষয়ক বিশেষ দূত হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার আগে কেলগের মন্তব্যে যুদ্ধ নিয়ে তাঁর অবস্থান বোঝা যায়। রাশিয়ার সঙ্গে সমঝোতায় ইউক্রেন যদি রাজি না হয়, তাহলে কিয়েভকে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ার নীতি নেওয়া যেতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন কেলগ। পাশাপাশি তিনি বলেছিলেন, রাশিয়া যদি সহযোগিতা না করে, তাহলে ইউক্রেনকে অস্ত্র সরবরাহ বাড়িয়ে দিতে হবে। সাম্প্রতিক দিনগুলোতে অবশ্য ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার সমালোচনা করতে দেখা গেছে তাঁকে। পাশাপাশি মস্কোয় রাশিয়ার এক জেনারেলকে ইউক্রেনের গুপ্তহত্যার সমালোচনাও করেছেন কেলগ।

বড়দিনে ইউক্রেনের বিভিন্ন শহরে রাশিয়ার হামলার নিন্দা জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া এক পোস্টে কেইথ কেলগ লিখেছিলেন, ‘দুই পক্ষের তৎপরতাই গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে বিশ্ব।’

সম্প্রতি এক টেলিভিশন অনুষ্ঠানে কেইথ কেলগ ইউক্রেন যুদ্ধ সম্পর্কে বলেন, ‘ভাবুন একটা খাঁচার ভেতর লড়াই চলছে। যুদ্ধে পক্ষ আছে দুটি। উভয় পক্ষই জয়ী হতে চায়। তাদের আলাদা করার জন্য তো একজন রেফারি দরকার। আমার মতে, ডোনাল্ড ট্রাম্প এই কাজ (রেফারি) করতে পারেন। এটা করার মতো দূরদর্শিতা রয়েছে তাঁর।’

রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে মার্কিন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল কেইথ কেলগকে বিশেষ দূত হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প
ছবি: রয়টার্স

কেলগের এমন মন্তব্য কিয়েভ মনে রেখেছে। এটা স্পষ্ট যে যুদ্ধে একটা বড় পরিবর্তনের জন্য মরিয়া হয়ে আছে ইউক্রেন। রাশিয়া স্থলপথে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়তে সম্মুখসমরে সৈন্য পাঠাতে হিমশিম খাচ্ছে কিয়েভ। গত মাসে ইউক্রেনের আকাশ প্রতিরক্ষা ইউনিটের দুটি সূত্র গার্ডিয়ানকে বলেছিল, পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে আকাশ প্রতিরক্ষা বাহিনীতে নিয়োজিত সেনাসদস্যদের সম্মুখসমরে পদাতিক বাহিনীর সঙ্গে লড়াইয়ে যোগদানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

এর বাইরে যুক্তরাষ্ট্রের বিদায়ী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসনকে নিয়েও ইউক্রেনের মধ্যে হতাশা ক্রমে বাড়ছে। কিয়েভের অনেকের মতে, ইউক্রেনের জন্য মার্কিন সহায়তার গতি খুবই ধীর এবং এই ধীর সহায়তা যুদ্ধে তেমন কোনো পরিবর্তন আনতে পারছে না। এদিকে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির প্রশাসনকে নিয়েও ওয়াশিংটনে অস্বস্তি দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে সামরিক বাহিনীতে নতুন করে নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে বয়সসীমা কমানোর ব্যাপারে কিয়েভের অনাগ্রহ নিয়ে অখুশি ওয়াশিংটন।

বাইডেনের বিদায় যত ঘনিয়ে আসছে, দুই পক্ষের একে অপরকে নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ্যে চলে আসছে। আর এ কারণে কিয়েভের অনেকে ট্রাম্পের হোয়াইট হাউসে ফেরা নিয়ে আশাবাদী হয়ে উঠছেন, যদিও সার্বিক পরিস্থিতি ইঙ্গিত দিচ্ছে যে ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে বিষয়গুলো আরও জটিল ও চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠবে। অন্যদিকে এমন একটি বিষয় তৈরি হয়েছে যে ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে ফিরলে ওয়াশিংটনে সম্পূর্ণ নতুন একটি রাজনৈতিক বাস্তবতা তৈরি হবে। এতে করে ইউক্রেন এমন একটা অজানা পরিস্থিতির মধ্যে গিয়ে পড়বে, যখন যুদ্ধক্ষেত্রে রুশ বাহিনীকে মোকাবিলায় হিমশিম খতে হচ্ছে তাদের।

বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গে কিয়েভের সম্পর্ক ও ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তনকে ভিডিও গেম খেলার সঙ্গে তুলনা করলেন ইউক্রেনের নিরাপত্তা বাহিনীর একটি সূত্র। তিনি এর ব্যাখ্যা দিলেন এভাবে, ‘ব্যাপারটা হচ্ছে এমন যে আপনি একটি ভিডিও গেম খেলছেন এবং খেলার পর্যায়গুলো পার করতে অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। অবশেষে আপনি জানতে পেরেছেন কীভাবে একটা করে পর্যায় পার হতে হয়। এখন হঠাৎ করে সেই খেলার নিয়ম বদলে গেল। নতুন করে সব নিয়ম আত্মস্থ করা হবে খুব কঠিন একটা কাজ।’

গত বছরের মে মাসে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সাক্ষাৎকার নিয়েছিল গার্ডিয়ান। ট্রাম্প আবার হোয়াইট হাউসে ফিরলে তখন নতুন প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে তাঁর পরিকল্পনা কেমন হবে—এমন প্রশ্নে জেলেনস্কি বলেছিলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্টকে বোঝানোর চেষ্টা করব যে (রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট) ভ্লাদিমির পুতিনের কথিত শান্তি প্রক্রিয়ায় যদি অংশ নিই, তাহলে আমি হয়ে উঠব একজন পরাজিত প্রেসিডেন্ট। এটা হলে বিষয়টা এমন দাঁড়াবে যে রাশিয়া আমাকে নিয়ে খেলেছে।’

তবে এখন জেলেনস্কি তাঁর অবস্থান কিছুটা পাল্টেছেন। এখন তিনি যেসব কথা বলছেন তা দেখে মনে হচ্ছে ‘ডিলমেকার’ হিসেবে ট্রাম্পের প্রশংসা করছেন তিনি। গত বৃহস্পতিবার ইউক্রেনের একটি টেলিভিশনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জেলেনস্কি বলেন, ‘ট্রাম্প এই সংকটের নিষ্পত্তি করতে পারেন...। এই যুদ্ধের নিষ্পত্তি টানার ভূমিকা নেওয়ার মতো সঠিক যোগ্যতা ট্রাম্পের আছে। তিনি পুতিনকে থামানোর নয়তো পুতিনকে থামাতে আমাদের সাহায্য করার সামর্থ্য রাখেন।’

এদিকে পুতিনও ট্রাম্পের প্রশংসা করছেন। ট্রাম্পের বুদ্ধিমত্তার পাশাপাশি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারে গুপ্তহত্যার চেষ্টা থেকে বেঁচে যাওয়া নিয়ে ট্রাম্পের সাহসিকতার প্রশংসা করেছেন পুতিন।

২০১৯ সালের ২৮ জুন জাপানের ওসাকায় জি–টোয়েন্টি শীর্ষ সম্মেলন চলাকালে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করেন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প
ছবি: রয়টার্স

তাতিয়ানা স্তানোভায়া নামে রাশিয়ার একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেন, ‘পুতিন যে ট্রাম্পকে একজন চৌকস ব্যক্তি বলছেন, এর পেছনে একটি কারণ রয়েছে। এটা হলো ট্রাম্পের সঙ্গে পুতিনের একধরনের খেলা। ট্রাম্পকে পুতিন এটা বোঝানোর চেষ্টা করছেন যে, “আপনি তো একজন চৌকস মানুষ, আপনি তো আহাম্মক নন। আপনি জানেন ও বোঝেন কোন কাজটা কীভাবে করতে হয়।”’

ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর ইউক্রেন নিয়ে তাঁর প্রশাসনের নীতি কেমন হবে, তাতেই এখন নজর পুতিন ও জেলেনস্কির। তবে পরিস্থিতি যা তাতে মনে হচ্ছে মস্কো অথবা কিয়েভ কেউই এখন শান্তির জন্য ছাড় দেওয়ার বিষয়ে প্রস্তুত রয়েছে, তার জোরালো কোনো ইঙ্গিতও পাওয়া যাচ্ছে না।

শান্তিচুক্তির জন্য পুতিন অন্তত যেসব অঞ্চল রুশ বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, সেসব অঞ্চল দখলে রাখতে চাইবেন। এ ছাড়া ইউক্রেনের নিরপেক্ষ থাকা ও কিয়েভকে নিরস্ত্রীকরণের দাবি জানাবেন পুতিন। তবে শুধু জেলেনস্কি নন ইউক্রেনের যেকোনো নেতার জন্যই এমন দাবি মেনে নেওয়া সম্ভব হবে না। যদিও জেলেনস্কি স্বীকার করেছেন, এ ক্ষেত্রে হয়তো কিছু ছাড় দেওয়ার প্রয়োজন পড়বে, যা হবে পীড়াদায়ক। তবে তিনি এ–ও বলেছেন, এ ক্ষেত্রে রাশিয়ার সম্ভাব্য হামলার বিরুদ্ধে ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিয়ে অর্থবহ কিছু নিশ্চয়তা দিতে হবে যেমন—ইউক্রেনকে পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্য করে নেওয়া অথবা ইউক্রেনে পশ্চিমা শান্তিরক্ষী মোতায়েন। তবে আপাতত এসব কতটা বাস্তবসম্মত বিকল্প তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।

অবসরে গেলেও ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ আছে যুক্তরাষ্ট্রের এমন একজন জ্যেষ্ঠ প্রতিরক্ষা কর্মকর্তার মতে, এ ধরনের প্রতিশ্রুতি ছাড়া ইউক্রেনের শান্তি চুক্তিতে রাজি হওয়ার তেমন কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি বলেন, ‘যেকোনো ধরনের শান্তি আলোচনায় ইউক্রেনকে পশ্চিমা দেশগুলোর নিরাপত্তার নিশ্চয়তার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এ ধরনের নিশ্চয়তা ছাড়া পুতিন যে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে আবারও ইউক্রেনে সামরিক আগ্রাসন চালাবেন না, তার নিশ্চয়তা কোথায়?’

শন ওয়াকার যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ানের মধ্য ও পূর্ব ইউরোপবিষয়ক সংবাদদাতা। অতীতে তিনি মস্কোয় এক দশকের বেশি সময় কাটিয়েছেন। ‘দ্য লং হ্যাংওভার: পুতিন’স নিউ রাশিয়া অ্যান্ড দ্য ঘোস্টস অব দ্য পাস্ট’ শীর্ষক বইয়ের লেখক তিনি।