রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে মস্কোর সঙ্গে ভিন্ন এক লড়াইয়ে নেমেছে পশ্চিমা দেশগুলো। রাশিয়ার অর্থনীতিকে চাপে ফেলতে একের পর এক নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে তারা। এরই ধারাবাহিকতায় রাশিয়ার জ্বালানি তেলের দাম বেঁধে দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, শিল্পোন্নত দেশগুলোর জোট জি-৭ ও অস্ট্রেলিয়া। সে অনুযায়ী, ব্যারেলপ্রতি ৬০ ডলারের বেশি দাম দিয়ে সমুদ্রপথে রাশিয়ার তেল আমদানি করা যাবে না। ৫ ডিসেম্বর থেকে তা কার্যকরও হয়েছে।
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে নিজেদের জ্বালানি তেলকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে রাশিয়া। তেলের দাম বেঁধে দেওয়া হয়তো এর একটি বড় জবাব। তবে এই পদক্ষেপ কিন্তু রাশিয়ার তেল রপ্তানি বন্ধের জন্য নয়। এর উদ্দেশ্য হলো তেলের দাম বেঁধে দিয়ে রাশিয়ার আয় কমিয়ে আনা। কারণ, তেল থেকে পাওয়া অর্থ ইউক্রেনে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে কাজে লাগাচ্ছে রাশিয়া। যদিও চীন, ভারতসহ বিভিন্ন দেশ ইতিমধ্যেই রাশিয়ার কাছ থেকে ছাড়মূল্যে তেল কিনছে। পশ্চিমারা চাইছে এই ছাড়মূল্যকে স্থায়ী করতে।
ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বড় একটি অংশ রাশিয়ার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। তবে তেলের দাম বেঁধে দেওয়ার সিদ্ধান্তে ঐকমত্যে আসাটা তাদের জন্য অতটাও সহজ ছিল না। শেষমেশ ২ ডিসেম্বর চূড়ান্ত শর্তগুলোর বিষয়ে একমত হয় সব পক্ষ। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধাটা ছিল, তেলের দাম কত ডলারে বেঁধে দেওয়া হবে সেটি। শেষ পর্যন্ত ৬০ ডলারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়।
দাম বেঁধে দেওয়ার আগে রাশিয়া যে দামে তেল বিক্রি করছিল, ৬০ ডলারের মূল্যসীমা অবশ্য তার চেয়ে বেশি। তাই এই মূল্যসীমা নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে যুদ্ধ শুরুর পর ইউক্রেনের পাশে দাঁড়ানো কোনো কোনো দেশ। যেমন পোল্যান্ড। সম্প্রতি ওয়ারশ বলেছে, দাম বেঁধে দেওয়ার পরও তেল রপ্তানি করে রাশিয়া কিছুটা হলেও মুনাফা করতে পারবে।
তাহলে কেন ৬০ ডলার দাম বেঁধে দেওয়া হলো? উত্তরটা হচ্ছে, এই দাম বেঁধে দিলে রাশিয়ার মুনাফা একদিকে কমে যাবে, আর বাজারে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয়ে তেলের দাম আকাশচুম্বীও হবে না। বলতে গেলে এর চেয়ে কম দাম বেঁধে দিলে রাশিয়া হয়তো কঠোর পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হতো। যেমন তারা তেলের রপ্তানি একেবারে বন্ধ করে দিতে পারত। এতে করে তেলের বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টির পাশাপাশি তেলের জন্য মস্কোর ওপর নির্ভরশীল দেশগুলো চরম ক্ষতির মুখে পড়ত।
এখন এই মূল্যসীমা বাস্তবায়নের জন্য আলাদা কিছু পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে পশ্চিমারা। যেমন, বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে বেশি দামে রুশ তেল কেনা হলে ওই তেল সরবরাহের জন্য জাহাজ ভাড়া ঠিক করে দেওয়ার সেবা এবং বীমা সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হবে। এর জন্য মস্কো শুধু নিজেদেরই দোষারোপ করতে পারে। কারণ, ইউক্রেনে হামলা চালানো এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনার যে পরিকল্পনা পুতিন করেছিলেন, তাঁর সে হিসেবে গুরুতর অনেক ভুল ছিল।
প্রথম ও সবচেয়ে বড় যে ভুল সিদ্ধান্তটি পুতিন নিয়েছিলেন, সেটি হলো ইউক্রেন সম্পর্কে ভুল ধারণা। পুতিন ভেবেছিলেন ইউক্রেনে অভিযান শুরু করলে দেশটির অনেক মানুষ রুশ সেনাদের স্বাগত জানাবেন। এতে তাঁর পক্ষে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়াটা সহজ হবে এবং তিনি কিছুদিনের মধ্যে ইউক্রেন যুদ্ধে জয়ী হবেন।
পুতিনের দ্বিতীয় ভুলটি ছিল, তিনি ভেবেছিলেন, বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ওলটপালট করে দিতে পারবেন। এখানে রাশিয়াকে পিছু হটতে হবে না। পুতিনের ধারণা ছিল, তেলের বাজারের ওপর রাশিয়ার প্রভাব সহজেই পশ্চিমাদের মধ্যে ভাঙন ধরাতে পারবে এবং তেলের মূল্যসীমা বেঁধে দেওয়ার মতো কোনো পদক্ষেপ নেওয়া থেকে বিরত থাকবে তারা।
কিন্তু এখন অর্থনৈতিকভাবে পশ্চিমাদের একহাত নেওয়ার মতো অবস্থায় নেই রাশিয়া। বলা যায়, গত জুনের কথাই। ওই সময়ে রাশিয়া থেকে সমুদ্রপথে রপ্তানি হওয়া অপরিশোধিত তেলের তিন ভাগের দুই ভাগই পরিবহন করা হতো মস্কোর ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া দেশগুলোর জাহাজ ব্যবহার করে।
পশ্চিমা দেশগুলোর ওপর এই নির্ভরশীলতা ও তেল রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি মাথায় নিয়ে রাশিয়া একটি ছায়া নৌবহর অর্থাৎ জাহাজের বহর তৈরির চেষ্টা শুরু করেছিল। ওই জাহাজগুলো দিয়ে তারা নিজেদের তেল রপ্তানি করতে চাইছিল। কিন্তু দেখা গেল, এই ছায়া নৌবহরও পশ্চিমা দেশগুলোর ওপর নির্ভরশীল। যেমন তেল সরবরাহের জন্য বিমাসুবিধা দেওয়া দেশগুলোর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার সঙ্গে ঐকমত্য রয়েছে।
পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞা মেনে চলে এমন বহুজাতিক বিমাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নির্ভরশীলতা থেকে বেরিয়ে আসতে ক্রেমলিন নিজেদের একটি বিমাব্যবস্থা তৈরির উদ্যোগ নেয়। তবে চীন ও তুরস্কের মতো অনেক দেশ রাশিয়ার দেওয়া বিমাসুবিধায় দেশটি থেকে তেল আমদানি করতে অপারগতা জানায়।
রাশিয়ার দেওয়া বিমাসুবিধার তেল আমদানিতে চীনা ও তুরস্কের অপারগতার বিষয়টি ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, রাশিয়ার অপরিশোধিত তেলের সবচেয়ে বড় ক্রেতা হলো চীন। এদিকে বসফরাস প্রণালির নিয়ন্ত্রণ তুরস্কের হাতে। কৃষ্ণসাগর থেকে রাশিয়ার অপরিশোধিত তেল রপ্তানির প্রধান পথ হচ্ছে বসফরাস প্রণালি।
পশ্চিমা দেশগুলো একজোট হয়ে রাশিয়ার ওপর যেসব নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, তাতে চীন ও তুরস্ক নেই। এমনকি রাশিয়ার তেল আমদানিতে পশ্চিমাদের বেঁধে দেওয়া মূল্যসীমার আওতায়ও তারা পড়ে না। এ ক্ষেত্রে অবশ্য নিজেদের বিমাপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে রাশিয়ার পাশে দাঁড়াতে পারত চীন। কিন্তু বেইজিং সেটা করেনি এবং এটা করতে ইচ্ছুকও নয়। যদিও ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগে প্রকাশ্যে দুই দেশ ঘোষণা দিয়েছিল যে মস্কো ও বেইজিংয়ের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্কের কোনো সীমা নেই। তবে তারপর থেকে চীন তাদের অবস্থানে পরিবর্তন এনেছে।
সব মিলিয়ে দিন দিন পুতিন আরও একা হয়ে পড়ছেন। এটাও বুঝতে পেরেছেন, যাদের তিনি বন্ধু বলে মনে করতেন, তারা আসলে সত্যিকার অর্থে বন্ধু নয়। এর ফলে তিনি আরও বেশি আগ্রাসী হয়ে উঠতে পারেন। রাশিয়ার তূণে এখনো একটি তির রয়েছে।
সেটি হলো বিশ্বের বিভিন্ন বাজারে তেলের রপ্তানি বাড়িয়ে দেওয়া। তবে এমনটি করার ক্ষেত্রে সমস্যাও আছে। এতে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দামের ওপর প্রভাব পড়তে পারে। ফলে ক্রেমলিনের সঙ্গে শেষ যে কয়েকটি দেশের সখ্য রয়েছে, তা–ও নষ্ট হতে পারে। এই পরিস্থিতির সুযোগ নিতে পারে সৌদি আরব। এরই মধ্যে ইউরোপের তেলের বাজারে বড় ভূমিকা রাখা শুরু করেছে দেশটি। পোল্যান্ডের তেল সংশোধন খাতে বিনিয়োগ করেছে তারা।
বলতে গেলে রুশ তেলের দাম বেঁধে দেওয়াটা পশ্চিম ও রাশিয়ার চলমান অর্থনৈতিক যুদ্ধে একটি মোড় বদল। অবশ্যই এই যুদ্ধের শেষ এখনো অনেক দূরে। আর এই অর্থনৈতিক যুদ্ধের কারণে বিশ্বকে ভবিষ্যতে আরও বিপত্তির মুখে পড়তে হতে পারে।
তবে সময় গড়ানোর সঙ্গে যেটা আরও বেশি করে মনে হচ্ছে, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মূলোৎপাটনের যে স্বপ্ন পুতিন দেখেছিলেন তা ভঙ্গ হওয়ার প্রক্রিয়া ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে।