ইউরোপকে সুরক্ষা দিতে গড়ে ওঠা ন্যাটো কি টিকে থাকবে

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ–পরবর্তী  বিপর্যস্ত, অনৈতিকভাবে বিধ্বস্ত ও ক্লান্ত ইউরোপকে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাবমুক্ত রাখতে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে ১৯৪৯ সালের এদিনে গঠিত হয়েছিল সামরিক জোট ন্যাটো। সঙ্গে আটলান্টিকের ওপারে সমাজতন্ত্রের বিস্তার আটকে দিয়ে নিজেদের পুঁজিবাদী ধারণা বিস্তারের পথ প্রশস্ত করা, আর বিশ্বের একক ক্ষমতাধর হয়ে ওঠার সুপ্ত বাসনাও যুক্তরাষ্ট্রের মনে ছিল। নিজের লক্ষ্যে একসময় দারুণ সফলভাবে পথচলা ন্যাটো এখন অস্তিত্বের সংকটে। প্রতিষ্ঠার ৭৬ বছর পর এসে সামরিক এই জোটকে এখন নিজেকে রক্ষার পথ খুঁজতে হচ্ছে।

ওয়াশিংটনে ন্যাটো প্রতিষ্ঠার চুক্তিতে সই করে ১২টি দেশ। ৪ এপ্রিল, ১৯৪৯ছবি: ন্যাটোর ওয়েবসাইট থেকে

আজ ৪ এপ্রিল, ১৯৪৯ সালের এই দিনে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে গঠিত হয় একটি সামরিক জোট। পুরো নাম নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন, সংক্ষেপে ন্যাটো। প্রতিষ্ঠা থেকে এখন পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে বড় সামরিক জোট বলা যায় একে।

৭৬ বছর আগে সই হওয়া ন্যাটো প্রতিষ্ঠার চুক্তিকে ‘ওয়াশিংটন চুক্তি’ নামেও ডাকা হয়। চুক্তিতে সই করে মোট ১২টি দেশ—যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, কানাডা, ডেনমার্ক, আইসল্যান্ড, ইতালি, লুক্সেমবার্গ, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে ও পর্তুগাল।

ধীরে ধীরে আরও দেশ এ জোটে শরিক হয়, বাড়তে থাকে ন্যাটোর পরিধি। বর্তমানে ৩২টি দেশ এ জোটের সদস্য। সর্বশেষ ২০২৪ সালের মার্চে ন্যাটোয় যোগ দেয় সুইডেন। দীর্ঘদিনের নিরপেক্ষতার নীতি ছুড়ে ফেলে সুইডেন ন্যাটোয় যুক্ত হয়েছে। ন্যাটোর সদর দপ্তর বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে। ন্যাটোর বর্তমান মহাসচিব মার্ক রুটে। তিনি একসময় নেদারল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।

একজন ট্রাম্প ও ন্যাটোর অস্তিত্বের সংকট

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীকে সামনে রেখে গতকাল বৃহস্পতিবার ব্রাসেলসে শুরু হয়েছে দুই দিনব্যাপী ন্যাটো সম্মেলন। এবারের সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্র যে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হয়ে উঠবে, সে আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আর এর কারণ হলেন খোদ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।

যে জুজু তাড়াতে যুক্তরাষ্ট্র একসময় ন্যাটো গড়েছিল, সেই জুজুকেই এখন দুহাত বাড়িয়ে আলিঙ্গন করতে আগ্রহী ট্রাম্প। তিনি সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্তরসূরি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াচ্ছেন।

ইউক্রেনের ন্যাটো সদস্যপদ চাওয়া নিয়ে প্রবল আপত্তি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের। ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করতে ট্রাম্প রাশিয়ার সঙ্গে যে আলোচনা শুরু করেছেন, সেখানে তিনি ইউরোপ ও ন্যাটোকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে গেছেন। আর শান্তি আলোচনা শুরু করার আগে পুতিনের অন্যতম শর্ত, ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দিতে পারবে না।

অন্যদিকে বাকি অংশীজনেরা নিজেদের সামরিক ব্যয় না বাড়ালে ট্রাম্প ন্যাটো থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নেওয়ার হুমকি দিচ্ছে যাচ্ছেন। যদিও মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ব্রাসেলসে গিয়ে বলেছেন, ন্যাটোতে যুক্তরাষ্ট্র আগেও যেমন তৎপর ছিল, এখনো তা–ই আছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পরিষ্কার করে বলেছেন, তিনি ন্যাটোকে সমর্থন করেন। যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটোতে থাকবে। তবে শর্ত হলো, বাকি অংশীদারদের সম্মিলিত প্রতিরক্ষা ব্যয় দ্বিগুণ করতে হবে।

ন্যাটোর পতাকা
ফাইল ছবি: এএফপি

রুবিও যতই ট্রাম্পের ন্যাটোর প্রতি সমর্থন অটুট থাকার কথা বলুন, ইউরোপ তাতে পুরোপুরি আশ্বস্ত হতে পারছে না। ট্রাম্পের ইচ্ছার সঙ্গে ন্যাটোর স্বার্থের দ্বন্দ্ব নানামুখী। যেমন ট্রাম্প গ্রিনল্যান্ড দখল করতে চান। আধা স্বায়ত্তশাসিত গ্রিনল্যান্ড ডেনমার্কের অংশ। ডেনমার্ক ন্যাটোর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। এখন ট্রাম্প যদি সত্যিই গ্রিনল্যান্ডের দখল নিতে চান, তবে সেটা ন্যাটোর ওপর সরাসরি আঘাত হবে।

ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার আগেই যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটো জোটের সব সদস্যকে প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়িয়ে জিডিপির ২ শতাংশ করার আহ্বান জানায়। জোটের বেশির ভাগ সদস্য এখন এটা করছেন। ২০২৪ সালে তাদের গড় ব্যয় ছিল গড় জিডিপির ২ দশমিক ৭ শতাংশ।

অথচ ন্যাটো গঠনের মূলমন্ত্রই হলো সম্মিলিত নিরাপত্তা। ন্যাটো চুক্তির পঞ্চম ধারায় বলা আছে, জোটভুক্ত কোনো দেশ যদি বিদেশি শক্তির আক্রমণের শিকার হয়, তাহলে জোটের সব সদস্যদেশ একযোগে তা প্রতিহত করবে; অর্থাৎ সদস্যদেশগুলো সম্মিলিতভাবে একে অপরকে সুরক্ষা দেবে।

ইউক্রেন যুদ্ধ ও ন্যাটোর ভবিষ্যৎ

ন্যাটোর বিপরীতে একই রকম একটি সামরিক জোট গড়তে ১৯৫৫ সালে ওয়ারশ জোট গড়েছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তার মিত্ররা। সোভিয়েত পতনের মধ্য দিয়ে এ জোটও বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ওয়ারশ সামরিক জোটের বেশির ভাগ সদস্য পরে ন্যাটো জোটে যোগ দেয়। পরিধি বাড়াতে বাড়াতে ন্যাটো পৌঁছে যায় রাশিয়ার সীমান্তে।

ইউক্রেন ও বেলারুশ বাদে রাশিয়ার সীমান্তের সব কটি দেশ ন্যাটোতে যোগ দিয়েছে। ইউক্রেন ন্যাটোতে ঢুকতে মুখিয়ে আছে। বিশেষ করে রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধের পর ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বারবার ন্যাটোভুক্ত হওয়ার কথা বলছেন।

অন্যদিকে ইউক্রেনের ন্যাটোর সদস্য হতে চাওয়া নিয়ে প্রবল আপত্তি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের। ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করতে ট্রাম্প রাশিয়ার সঙ্গে যে আলোচনা শুরু করেছেন, সেখানে তিনি ইউরোপ ও ন্যাটোকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে গেছেন। আর শান্তি আলোচনা শুরু করার আগে পুতিনের অন্যতম শর্ত, ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দিতে পারবে না।

বিশেষ করে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর ন্যাটো বারবার স্পষ্ট করে বলেছে, তারা রাশিয়ার সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে জড়াতে চায় না। পুতিনও ন্যাটোর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামতে আগ্রহী নন। তবে তিনি এ–ও বলেছেন, সবার আগে তিনি রাশিয়ার স্বার্থ দেখবেন এবং রাশিয়ার জাতীয় স্বার্থে সামান্যতম আঘাতও তিনি মেনে নেবেন না।

নিজেদের সীমান্তে ন্যাটোর বিস্তার নিয়ে রাশিয়া বহু বছর ধরেই আপত্তি তুলে আসছিল। এবার দেশটি সে আপত্তি জোরালোভাবে তোলার সুযোগ পেয়েছে। পুতিনকে যুদ্ধের অবসানে রাজি করাতে ন্যাটোর বিষয়ে ট্রাম্প কী সিদ্ধান্ত নেন, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

ইউরোপ কী ন্যাটোকে বাঁচাতে পারবে

ন্যাটো মহাসচিব রুটে বলেছেন, ‘আমরা জানি, যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটোর দৃঢ় মিত্র। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রতিশ্রুতি এসেছে একটি প্রত্যাশাকে সঙ্গে নিয়ে। সেই প্রত্যাশা হলো, ইউরোপীয় মিত্রদের এবং কানাডাকে আরও ব্যয় করতে হবে।’

কানাডা এবং ইউরোপীয় মিত্ররা ২০১৭ সাল থেকেই ব্যয় বাড়িয়েছে বলেও জানান রুটে। তিনি বলেন, ন্যাটো মিত্রদের উচিত, তাদের প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়িয়ে তা নিজেদের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৩ শতাংশ করা।

‘আমরা জানি, যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটোর দৃঢ় মিত্র। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রতিশ্রুতি এসেছে একটি প্রত্যাশাকে সঙ্গে নিয়ে। সেই প্রত্যাশা হলো ইউরোপীয় মিত্রদের এবং কানাডাকে আরও ব্যয় করতে হবে।’
ন্যাটো মহাসচিব মার্ক রুটে

ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার আগেই যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটো জোটের সব সদস্যকে প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়িয়ে জিডিপির ২ শতাংশ করার আহ্বান জানায়। জোটের বেশির ভাগ সদস্য এখন সেটা করছে। ২০২৪ সালে তাদের গড় ব্যয় ছিল গড় জিডিপির ২ দশমিক ৭ শতাংশ।

কিন্তু ট্রাম্প এখন নতুন লক্ষ্য ঠিক করেছেন। রুবিও সে বার্তা নিয়েই ব্রাসেলসে গেছেন। রুবিও বলেছেন, জোটের প্রতিটি সদস্যকে প্রতিরক্ষা ব্যয় সর্বোচ্চ জিডিপির ৫ শতাংশ করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া এবং তা পূরণ করার চেষ্টা করতে হবে।

ট্রাম্প যে প্রত্যাশা রেখেছেন, ন্যাটোর কোনো সদস্যের পক্ষে সেটা সম্ভবত পূরণ করা সম্ভব নয় বলে মনে করেন ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের রাফায়েল লস।

ব্রাসেলসে ন্যাটোর সদর দপ্তরে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওকে স্বাগত জানাচ্ছেন জোটের বর্তমান মহাসচিব মার্ক রুটে। ৩ এপ্রিল ২০২৫
ছবি: এএফপি

লস বলেন, ‘স্নায়ুযুদ্ধের সময় ন্যাটোর কয়েকটি সদস্যদেশ ৫ শতাংশ বা তার বেশি প্রতিরক্ষা ব্যয় করেছে। কিন্তু সেটা ব্যতিক্রম অবস্থা ছিল, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এটা সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ হতে পারে।’

যুক্তরাষ্ট্র নিজে জিডিপির ৩ দশমিক ৫ শতাংশ প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করে। রাশিয়া ২০২৫ সালে তাদের প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়িয়ে জিডিপির ৬ শতাংশ পর্যন্ত করতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর থেকে ন্যাটো নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইউরোপের দূরত্ব বাড়ছে। যদিও রুবিও এই টানাপোড়েনকে সংবাদমাধ্যমের সৃষ্টি বলে দাবি করছেন। তিনি বলছেন, ‘বিশ্বজুড়ে সংবাদমাধ্যমগুলোতে এবং যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে কিছু দেশীয় সংবাদমাধ্যমে ন্যাটো সম্পর্কে যে অতি আবেগ ও অতিরঞ্জন দেখতে পাচ্ছি, তা অযৌক্তিক।’

তবে রুবিও যতই অযৌক্তিক বলুন, ‘খ্যাপাটে’ ট্রাম্প কখন কী করে বসেন, তা আগে থেকে অনুমান করা কঠিন। ট্রাম্প তো ন্যাটোকে হুমকি দিয়ে বলেই রেখেছেন, যদি জোটের অন্য সদস্যরা নিজেদের হিস্যার চাঁদা না দেয়, তবে তিনি রাশিয়াকে ‘যা খুশি তা–ই’ করতে উৎসাহ দেবেন। ন্যাটোর জন্মের সময় কেউ হয়তো কল্পনাও করতে পারেনি তাদের এ দিনও দেখতে হবে।

তথ্যসূত্র: ডয়চে ভেলে, ন্যাটো ওয়েব সাইট, এনসাইক্লোপিডিয়া অব ব্রিটানিকা