ইউক্রেনকে রাশিয়ায় দূরপাল্লার মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি দেওয়ার পরিণতি কী
দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারে ইউক্রেনের ওপর থেকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বিধিনিষেধ তুলে নিয়েছেন, সম্প্রতি প্রকাশিত এ খবরের অর্থ হলো দেশটি রাশিয়ায় হামলায় এখন প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের নির্মিত এমন ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করতে পারবে।
৫ নভেম্বর অনুষ্ঠিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জিতেছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। আগামী জানুয়ারিতে তাঁর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে কিয়েভকে মার্কিন দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারের ওই সবুজ সংকেত দিলেন বাইডেন।
ইউক্রেনে অনেক দিন পর রাশিয়া ব্যাপক ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালানোর কয়েক ঘণ্টা পর বাইডেনের দেওয়া এ সবুজ সংকেতে ক্ষুব্ধ ক্রেমলিন। তার অভিযোগ, ওয়াশিংটন ‘আগুনে ঘি’ ঢালছে।
ইউক্রেনে অনেক দিন পর রাশিয়া ব্যাপক ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালানোর কয়েক ঘণ্টা পর বাইডেনের দেওয়া এ সবুজ সংকেতে ক্ষুব্ধ ক্রেমলিন। তার অভিযোগ, ওয়াশিংটন ‘আগুনে ঘি’ ঢালছে।
ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেছেন, বাইডেনের এ সিদ্ধান্তের অর্থ হলো, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে সরাসরি জড়াচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। তাঁর এ বক্তব্য গত সেপ্টেম্বরে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ব্যক্ত করা মনোভাবেরই অনুরূপ।
এ বিষয়ে হোয়াইট হাউস ও নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কোনো মন্তব্য এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তবে তাঁর বড় ছেলে ডোনাল্ড ট্রাম্প জুনিয়র বলেছেন, ‘শান্তি প্রতিষ্ঠা ও মানুষের জীবন বাঁচাতে আমার বাবার উদ্যোগ গ্রহণ করার আগেই দৃশ্যত মনে হচ্ছে, সামরিক বাহিনী তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর বিষয়টি নিশ্চিত করতে চাচ্ছে।’
শান্তি প্রতিষ্ঠা ও মানুষের জীবন বাঁচাতে আমার বাবার উদ্যোগ গ্রহণ করার আগেই দৃশ্যত মনে হচ্ছে, সামরিক বাহিনী তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর বিষয়টি নিশ্চিত করতে চাচ্ছে।ডোনাল্ড ট্রাম্প জুনিয়র, নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ছেলে
আগামী ২০ জানুয়ারি প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিতে যাওয়া ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনী প্রচার চলাকালে ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে মধ্যস্থতা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠেছে, বাইডেন প্রশাসনের সাম্প্রতিকতম এ পদক্ষেপ কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ ও এর পরিণামই–বা কী।
যুক্তরাষ্ট্র কেন দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি দিল
সম্প্রতি রাশিয়ার কুরস্ক অঞ্চলে উত্তর কোরিয়ার সেনা মোতায়েন করেছে মস্কো। এর আগে গত আগস্টে এ অঞ্চলে অভিযান চালায় ইউক্রেনের বাহিনী। কুরস্কে উত্তর কোরীয় সেনা মোতায়েন করার পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে দেওয়া তার দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারের ওই অনুমতি দিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
রুশ সেনারা ধীরে ধীরে পূর্ব ইউক্রেনে নিজেদের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রেখেছেন ও অবস্থান মজবুত করছেন। এ অবস্থায় ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ তার পশ্চিমা মিত্র দেশগুলোকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ক্ষেপণাস্ত্র (পশ্চিমাদের কাছ থেকে পাওয়া) ব্যবহারের অনুমতি দিতে কয়েক মাস ধরে চাপ দিচ্ছিলেন।
আল-জাজিরার কূটনৈতিক সংবাদদাতা জেমস বেস বলেন, ইউক্রেনের চাপ সৃষ্টির অর্থ, পশ্চিমা দেশগুলোর সমর্থন, বিশেষ করে কিয়েভের দখল করা রাশিয়ার কুরস্ক অঞ্চল ধরে রাখতে সহায়তা পাওয়া।
ইউক্রেন চাইলে দূরপাল্লার কৌশলগত এ ক্ষেপণাস্ত্র কুরস্কে রুশ ও উত্তর কোরীয় সেনাদের নিশানা করে হামলায় ব্যবহার করতে পারবে। রাশিয়ার পশ্চিমাঞ্চলীয় এ অঞ্চল ছাড়া দেশটির ভেতরে বিভিন্ন সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে এ ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলা চালাতে পারবে ইউক্রেন।
যুক্তরাষ্ট্র, ইউক্রেন ও দক্ষিণ কোরিয়ার কর্মকর্তাদের তথ্য অনুযায়ী, উত্তর কোরিয়া এ পর্যন্ত ১২ হাজারের মতো সেনা পাঠিয়েছে রাশিয়ায়। মস্কোকে পিয়ংইয়ং অস্ত্র সহায়তা দিচ্ছে বলেও অভিযোগ তাঁদের।
গত মার্চে যুক্তরাষ্ট্র গোপনে ইউক্রেনে ক্ষেপণাস্ত্র পাঠায়। তবে রুশ ভূখণ্ডে এত দিন তা ব্যবহার করার অনুমতি দেয়নি বাইডেন প্রশাসন। শুধু রাশিয়ার দখল করা ক্রিমিয়া উপদ্বীপে গত এপ্রিলে দুবার ওই সব ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে ইউক্রেন।
এখন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব ছাড়ার মাত্র ৯ সপ্তাহ আগে ইউক্রেনকে দূরপাল্লার মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করার অনুমতি দিলেন বাইডেন। তাঁর উত্তরসূরি ট্রাম্প ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন। এতে ইউক্রেনের সর্ববৃহৎ অস্ত্র সরবরাহকারী যুক্তরাষ্ট্র দেশটিকে সামরিক সহায়তা অব্যাহত রাখবে কি না, তা নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা।
কিছুদিন ধরেই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিল যে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে তার দেওয়া দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করার অনুমতি দেবে। গত সেপ্টেম্বরে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ও ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামি কিয়েভ সফরে যান এবং জেলেনস্কির সঙ্গে বৈঠক করেন। কিয়েভ সফর করায় তাঁদের ধন্যবাদ জানিয়ে পরে জেলেনস্কি এক্সে এক পোস্টে লেখেন, ‘তাঁরা ইউক্রেনের যুক্তি শুনেছেন, এটা গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্যে দূরপাল্লার অস্ত্র ব্যবহার করার বিষয়ও রয়েছে।’
উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে যে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করেছে, তা ‘আর্মি ট্যাকটিক্যাল মিসাইল সিস্টেম (এটিএসিএমএস)’ নামে পরিচিত। এটির পাল্লা ৩০০ কিলোমিটার (১৯০ মাইল)। ১৯৮০–এর দশকে এর প্রথম উন্নয়নসাধন করা হয়।
ইউক্রেনে এটিএসিএমএস সরবরাহ করার আগে গত বছরের অক্টোবরে দেশটিতে স্বল্প পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র পাঠায় যুক্তরাষ্ট্র।
ইউক্রেনের জন্য দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র কেন গুরুত্বপূর্ণ
ইউক্রেন চাইলে দূরপাল্লার কৌশলগত এ ক্ষেপণাস্ত্র কুরস্কে রুশ ও উত্তর কোরীয় সেনাদের নিশানা করে হামলায় ব্যবহার করতে পারবে। রাশিয়ার পশ্চিমাঞ্চলীয় এ অঞ্চল ছাড়া দেশটির ভেতরে বিভিন্ন সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে এ ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলা চালাতে পারবে ইউক্রেন।
দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের খবর অনুযায়ী, মার্কিন কর্মকর্তারা বলেছেন, কিয়েভ খুব সম্ভবত কুরস্ক ঘিরে রাশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলেও হামলা চালাবে।
আগস্টে ইউক্রেনীয় বাহিনী অভিযান চালিয়ে কুরস্কের ২৮টি বসতির প্রায় এক হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা দখল করে নিয়েছে। রাশিয়ায় উত্তর কোরিয়া থেকে পাঠানো সেনাদের কুরস্কের কাছে মোতায়েন করা হয়েছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে।
ব্রিটিশ গবেষণাপ্রতিষ্ঠান চাথাম হাউসের রাশিয়া ও ইউরেশিয়া প্রোগ্রামের অ্যাসোসিয়েট ফেলো তিমোথি অ্যাশ বলেছেন, ‘রাশিয়ার অস্ত্র ও সেনা সরবরাহব্যবস্থায় ইউক্রেনের হামলা চালানোর প্রয়োজন। কিন্তু দেশটির নিজস্ব ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা দিয়ে এটি সম্ভব নয়।’
অ্যাশের ধারণা, ভবিষ্যতে দর-কষাকষিতে ইউক্রেন যাতে আরও বেশি সুবিধা পায়, সে লক্ষ্যেও দেশটিকে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি দেওয়ার ওই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকতে পারে বাইডেন প্রশাসন।
এদিকে বাইডেন প্রশাসনের এ সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে মস্কো। তারা বলেছে, এ সিদ্ধান্ত বর্তমান উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে তুলবে। একই সঙ্গে ইউক্রেন যদি দূরপাল্লার মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র রাশিয়ার ভূখণ্ডে হামলায় ব্যবহার করে, তবে এর যথোপযুক্ত জবাব দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে ক্রেমলিন।
এ বিষয়ে রুশ আইনপ্রণেতা মারিয়া বুতিনা বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের এ সিদ্ধান্তে বিশ্বজুড়ে সংঘাত শুরুর ঝুঁকি তৈরি হবে। তা ছাড়া দুই মাস আগেই রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন দূরপাল্লার এসব মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারের পরিণাম সম্পর্কে হুঁশিয়ার করে দেন।
রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমকে পুতিন বলেছিলেন, ‘যদি এমনটা ঘটে, তবে মনে রাখতে হবে, এ সংঘাতের রূপে বদল আসবে। আমাদের জন্য যে ধরনের হুমকি তৈরি হবে, সে অনুযায়ী আমরা যথাযথ সিদ্ধান্ত নেব।’