পুতিন কি পারমাণবিক হামলা করেই ছাড়বেন
যুদ্ধে ইউক্রেনীয় বাহিনীর প্রতিরোধের মুখে ঠিক এ মুহূর্তে বেশ চাপে রয়েছে রাশিয়া। ইউক্রেনের খারকিভ অঞ্চলের দখল ছাড়তে হয়েছে রুশ সেনাদের। সদ্য রুশ ফেডারেশনের সঙ্গে যুক্ত করা দোনেৎস্ক ও খেরসনেও মস্কোর বিরুদ্ধে বড় অগ্রগতি অর্জন করেছেন ইউক্রেনীয় সেনারা। এরই মধ্যে আবার নিজ ভূখণ্ড রক্ষায় ‘সব শক্তি’ ব্যবহারের হুমকি দিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।
বিশ্বে সবচেয়ে বেশি পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে পুতিনের হাতে। তাঁর ‘সব শক্তি’ ব্যবহারের হুমকি থেকে পারমাণবিক হামলার বিষয়টি আলাদা করা যায় না বলে মনে করছেন বিশ্লেষকদের অনেকে। ১৯৪৫ সালে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক বোমা হামলার বিষয়ও তুলেছেন পুতিন। বলেছেন, বিশ্বে মার্কিনরাই প্রথম পারমাণবিক হামলার নজির গড়েছে।
সব মিলিয়ে কিছু প্রশ্ন উঠেছে। যেমন মরিয়া হয়ে পুতিন কি আসলেই পারমাণবিক বোমা হামলা করতে যাচ্ছেন? হামলা হলে এর ফলাফল কী হবে? আর যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে এ হামলার জবাব দেবে? প্রশ্নগুলোর জবাব দেওয়া হয়েছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার এক প্রতিবেদনে।
কার পারমাণবিক অস্ত্র বেশি
সংখ্যার দিক দিয়ে রাশিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র সবচেয়ে বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা প্রতিষ্ঠান ফেডারেশন অব আমেরিকান সায়েন্টিস্টের দেওয়া হিসাব বলছে, মস্কোর হাতে বর্তমানে আনুমানিক ৫ হাজার ৯৭৭টি পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে। অপর দিকে যুক্তরাষ্ট্রের এ অস্ত্র রয়েছে ৫ হাজার ৪২৮টি।
যে হিসাব দেওয়া হয়েছে, তাতে মজুত থাকা পারমাণবিক অস্ত্রের পাশাপাশি যেগুলোর মেয়াদ ফুরিয়েছে, সেগুলোও যুক্ত করা হয়েছে। তবে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মজুত করা পারমাণবিক অস্ত্র এত বেশি যে সেগুলো দিয়ে পুরো বিশ্ব কয়েকবার ধ্বংস করা যাবে। দেশ দুটির হাতে বিশ্বের মোট পারমাণবিক অস্ত্রের ৯০ শতাংশ রয়েছে।
যেকোনো সময় হামলা চালানোর জন্য ১ হাজার ৪৫৮টি পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েন রেখেছে মস্কো। যুক্তরাষ্ট্র মোতায়েন রেখেছে ১ হাজার ৩৮৯টি। এই অস্ত্রগুলো যুক্ত রয়েছে আন্তমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (আইসিবিএম), সাবমেরিন থেকে উৎক্ষেপণযোগ্য ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও বোমারু বিমানে।
সংখ্যার দিক দিয়ে রাশিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র সবচেয়ে বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা প্রতিষ্ঠান ফেডারেশন অব আমেরিকান সায়েন্টিস্টের দেওয়া হিসাব বলছে, মস্কোর হাতে বর্তমানে আনুমানিক ৫ হাজার ৯৭৭টি পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে। অপর দিকে যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে ৫ হাজার ৪২৮টি।
এদিকে কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্রের দিক দিয়ে বিবেচনা করলেও যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বহু এগিয়ে রাশিয়া। দেশটির হাতে যুক্তরাষ্ট্রের ১০ গুণ রয়েছে এ অস্ত্র। আর যুক্তরাষ্ট্রের ২০০টি কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্রের প্রায় অর্ধেকই মোতায়েন রয়েছে ইউরোপের বিভিন্ন ঘাঁটিতে।
কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্রগুলো যুদ্ধক্ষেত্রে ‘কৌশলগত’ উদ্দেশ্যে ব্যবহারের জন্যই তৈরি করা। সেগুলোর সক্ষমতা বড় পারমাণবিক বোমার চেয়ে বেশ কম। বড় বোমাগুলো নিমেষে মস্কো, ওয়াশিংটন ও লন্ডনের মতো বড় শহরগুলো ধ্বংস করে দিতে পারে।
যে ধরনের পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহৃত হতে পারে
রুশ ফেডারেশনের চেচনিয়া অঞ্চলের নেতা রমজান কাদিরভ সম্প্রতি বলেছেন, ইউক্রেনে তুলনামূলক কম ক্ষমতাসম্পন্ন কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের বিষয়টি বিবেচনা করতে পারে মস্কো। তাঁর ওই বক্তব্য অবশ্য আমলে নেয়নি রাশিয়া। এ নিয়ে ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেন, ‘রাশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের প্রধানদের অধিকার রয়েছে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গিগুলো তুলে ধরার। তবে এমন কঠিন মুহূর্তে তাঁদের এ ধরনের আবেগ এড়িয়ে চলা উচিত।’
বিশ্লেষকেরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধের জন্য রাশিয়ার দূরপাল্লার পারমাণবিক অস্ত্রগুলো প্রস্তুত রাখা হয়েছে। তবে স্বল্পপাল্লার কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্রগুলো তারা হুট করেই ব্যবহার করতে পারবে না। কারণ, সেগুলো তাৎক্ষণিক হামলার জন্য প্রস্তুত নেই।
পুতিন এখন ধাপ্পাবাজি করছেন। তবে এক সপ্তাহ বা এক মাস পর যখন তিনি বুঝতে পারবেন যুদ্ধে পরাজিত হয়েছেন, তখন কী হবে, তা বলা মুশকিল।ইউরি ফিওদোরভ, প্রাগভিত্তিক সামরিক বিশ্লেষক
জাতিসংঘের গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড নেশনস ইনস্টিটিউট ফর ডিজআর্মামেন্ট রিসার্চের (ইউএনআইডিআর) জ্যেষ্ঠ গবেষক পাভের পোডভিগের মতে, কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্রগুলো সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। হামলার জন্য সেগুলো বাংকার থেকে বের করতে হবে। এরপর সেগুলো ট্রাকে করে নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে ক্ষেপণাস্ত্রের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। এটা বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।
বিশেষজ্ঞদের কারও কারও অভিমত, পুতিন হঠাৎ হামলা চালানোর জন্য কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্রগুলো প্রস্তুত করার নির্দেশ দিতে পারেন। আরেকটা কৌশল রয়েছে। তা হলো হামলা না চালিয়ে অস্ত্রগুলো শুধু বাংকার থেকে বের করা। পুতিন হয়তো মনে করবেন, সেগুলো বাংকার থেকে বের করলেই যুক্তরাষ্ট্রের স্যাটেলাইটে ধরা পড়বে। এতে হামলা হতে পারে, এ ভয়ে ইউক্রেনকে অস্ত্রসহায়তা দেওয়া বন্ধ করবে পশ্চিমা দেশগুলো।
লন্ডনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের গবেষক সিদ্ধার্থ কৌশল বলেন, ‘আমার মনে হয়, রাশিয়া জুয়াটা এভাবেই খেলবে। উত্তেজনা সৃষ্টি করে তারা একই সঙ্গে বিরোধী পক্ষকে হুমকি দেবে আর আলোচনার টেবিলে বসার জন্য চাপ দেবে।’
কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্রগুলো যুদ্ধক্ষেত্রে ‘কৌশলগত’ উদ্দেশ্যে ব্যবহারের জন্যই তৈরি করা হয়েছে। সেগুলোর সক্ষমতা বড় পারমাণবিক বোমার চেয়ে বেশ কম। বড় বোমাগুলো নিমেষে মস্কো, ওয়াশিংটন ও লন্ডনের মতো বড় শহরগুলো ধ্বংস করে দিতে পারে।
তবে বিষয়টি পুরোপুরি নির্ভর করছে রাশিয়ার প্রতি বহির্বিশ্বের হুমকিকে পুতিন কীভাবে দেখছেন, তার ওপর। রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধকে পুতিন রাশিয়া ও পশ্চিমা দেশগুলোর অস্তিত্বের লড়াই বলে উল্লেখ করেছেন। বলেছেন, পশ্চিমা দেশগুলো তাঁর দেশকে ধ্বংসের পাঁয়তারা করছে আর রাশিয়ার প্রাকৃতিক সম্পদ দখলে নিতে চায় তারা।
নিজ ভূখণ্ড রক্ষায় পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি মিথ্যা নয় বলেও উল্লেখ করেছেন রুশ প্রেসিডেন্ট। যদিও কয়েকজন বিশ্লেষক তাঁর এ ভাষ্যকে ‘ধাপ্পাবাজি’ আখ্যা দিয়েছেন। তবে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে ওয়াশিংটন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, ১৯৬২ সালের পর থেকে পারমাণবিক হামলার এমন ঝুঁকি আর কখনো দেখা যায়নি।
প্রাগভিত্তিক সামরিক বিশ্লেষক ইউরি ফিওদোরভ বলেন, ‘পুতিন এখন ধাপ্পাবাজি করছেন। তবে এক সপ্তাহ বা এক মাস পর যখন তিনি বুঝতে পারবেন যে যুদ্ধে পরাজিত হয়েছেন, তখন কী হবে, তা বলা মুশকিল।’
পুতিন পারমাণবিক হামলা চালাবেন কি না, এমন প্রশ্ন করা হয়েছিল মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর পরিচালক উইলিয়াম বার্নসকেও। জবাবে তিনি বলেন, পুতিনের হুমকিগুলো খুব গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। তবে পারমাণবিক হামলা হতে যাচ্ছে, তার বাস্তব কোনো প্রমাণ আপাতত মার্কিন গোয়েন্দাদের হাতে নেই।
যুক্তরাষ্ট্র কী করবে
পুতিন পারমাণবিক হামলা চালালে ‘রাশিয়াকে এর মারাত্মক পরিণতি’ ভোগ করতে হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে হোয়াইট হাউস।
এমন ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সামনে থাকা বিকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে অসামরিক পন্থায় জবাব (যেমন কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালানো), পাল্টা পারমাণবিক হামলা ও প্রচলিত সামরিক পদ্ধতিতে জবাব। পাল্টা পারমাণবিক হামলায় উত্তেজনার ঝুঁকি বাড়াবে আর প্রচলিত সামরিক পন্থায় জবাবে রাশিয়ার সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে যুক্তরাষ্ট্র।
অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ও সিআইএর সাবেক প্রধান ডেভিড পেট্রাউস বলেন, মস্কো পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করলে ওয়াশিংটন ও এর মিত্র ন্যাটো জোট ইউক্রেনে সব রুশ সেনা ও সমরাস্ত্র এবং কৃষ্ণসাগরে মস্কোর সব নৌবহর ধ্বংস করবে।
ক্রেমলিনের ওপর যাঁরা নজর রাখছেন, তাঁরা কোনো পারমাণবিক হামলা যুদ্ধক্ষেত্রে রাশিয়াকে সহায়তা করবে কি না, সে বিষয়ে নিশ্চিত নন। এর আংশিক কারণ, ইউক্রেনে রাশিয়ার সাম্প্রতিক সামরিক ক্ষতি পুষিয়ে যুদ্ধের মোড় ঘোরাতে ওই হামলা মস্কোকে কীভাবে সহায়তা করবে, তা আঁচ করতে পারছেন না তাঁরা।
তবে ‘পারমাণবিক অস্ত্র কোনো জাদুর কাঠি নয়’, বলেন ইউনাইটেড নেশনস ইনস্টিটিউট ফর ডিজআর্মামেন্ট রিসার্চের জ্যেষ্ঠ গবেষক আন্দ্রে বাকলিটস্কি। তিনি আরও বলেন, ‘এটি এমন কিছু নয় যে আপনি শুধু ব্যবহার করলেন আর আপনার সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেল।’
ন্যাটোর সেনারা রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধে সরাসরি অংশ নিলে মস্কোর হিসাব–নিকাশ পাল্টে যেতে পারে।
অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল লিওনিড রেশেতনিকভ দীর্ঘ ৪০ বছরের বেশি সোভিয়েত ইউনিয়ন ও রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থার হয়ে কাজ করেছেন। ইউক্রেন–রাশিয়া যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি বিষয়ে তিনি বলেন, ইউক্রেনকে অস্ত্র, গোয়েন্দা তথ্য, প্রশিক্ষক ও স্বেচ্ছাসেবক দিয়ে ইতিমধ্যে এ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্র এবং বিশেষ করে ইউরোপের দেশগুলো। এ অংশগ্রহণ যদি আরও বাড়তে থাকে, তবে এটি বৈশ্বিক যুদ্ধে রূপ নেওয়ার ঝুঁকি তৈরি করবে; যে যুদ্ধে ব্যবহৃত হতে পারে পারমাণবিক অস্ত্র।
অনুবাদ: মো. আবু হুরাইরাহ্ ও শেখ নিয়ামত উল্লাহ