রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের প্রয়াণ
রাজতন্ত্রের এক অনন্য অধ্যায়ের ইতি
রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ ছিলেন বিশ্বের সর্বাধিক পরিচিত রাজতন্ত্রের প্রতিভূ। ৭০ বছর রাজকার্য পরিচালনা করেন তিনি।
মাত্র ২৫ বছর বয়সে ব্রিটিশ রাজত্বের দায়িত্ব গ্রহণকারী রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের ৭০ বছরের রাজকার্য পরিচালনার অনন্য ইতিহাসের ইতি ঘটেছে। যুক্তরাজ্যে তাঁর মতো দীর্ঘ সময় সিংহাসনে আসীন থাকার রেকর্ড আর কারও নেই। ৯৬ বছর বয়সে রাজকার্য পরিচালনাও একটি বিরল ঘটনা। যুক্তরাজ্য ছাড়াও তিনি ছিলেন ১৪টি দেশ ও অঞ্চলের রানি। তিনি ৫৪ সদস্যের জোট কমনওয়েলথের প্রধান, যে দেশগুলোর অধিকাংশই অতীতে ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিল। এককথায় রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ ছিলেন বিশ্বের সর্বাধিক পরিচিত রাজতন্ত্রের প্রতিভূ।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে উইনস্টন চার্চিল যখন দায়িত্ব পালন করছিলেন, সে সময় পিতা রাজা ষষ্ঠ জর্জের মৃত্যুর পর তিনি উত্তরাধিকারী হিসেবে দায়িত্ব নেন। এরপর তাঁর অধীনে আরও ১৫ জন প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব পালন করেছেন। পঞ্চদশ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে লিজ ট্রাসকে মঙ্গলবার নিয়োগ দেওয়ার মাত্র ৪৮ ঘণ্টা পর তাঁর জীবনাবসান ঘটল। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর আগে অন্তত আরও দুজনের জন্ম তাঁর রানি হিসেবে অভিষিক্ত হওয়ার অনেক পরে। তাঁর জীবদ্দশায় তিনি শুধু যুক্তরাষ্ট্রেরই প্রায় এক ডজন প্রেসিডেন্টকে তাঁর প্রাসাদে স্বাগত জানিয়েছেন। তাঁর বড় ছেলে তৃতীয় চার্লস ৭৩ বছর বয়সে রাজা হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন বলে প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস জানিয়েছেন। চার্লসের রাজা হওয়ার বিষয়টি তাঁর তিন বছর বয়সের সময়েই ঠিক হয়ে ছিল। ক্ষমতা হস্তান্তরের পালা প্রত্যাশা অনুযায়ী সম্পন্ন হয়েছে। চার্লসের স্ত্রী ক্যামিলাকে পূর্ণ রানি না বলে কুইন কনসর্ট বলা হবে।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে হঠাৎ করে বাকিংহাম প্রাসাদ থেকে যখন জানানো হয় যে রানি চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে রয়েছেন, তখনই তাঁর স্বাস্থ্য নিয়ে জল্পনা শুরু হয়। তাঁর পরিবারের সদস্যরা যুক্তরাজ্যের নানা প্রান্ত থেকে স্কটল্যান্ডের বালমোরাল প্রাসাদে জড়ো হওয়ার পর স্থানীয় সময় সন্ধ্যা সাতটার কিছু আগে ঘোষণা করা হয় যে দুপুরে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। রানির মৃত্যুর পর কীভাবে তা প্রচার করা হবে, তাঁর শেষকৃত্যের আয়োজন এবং রাজা হিসেবে চার্লসের দায়িত্ব গ্রহণের বিষয়গুলো আগে থেকেই মোটামুটি পরিকল্পনা করা আছে। এ পরিকল্পনা অনুযায়ী রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের শেষকৃত্য রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় অনুষ্ঠিত হবে এখন থেকে ১০ দিন পর লন্ডনে। আগামী ১০ দিন লন্ডন, এডিনবরা, কার্ডিফ ও বেলফাস্টে বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা পালন করা হবে। রানির রাষ্ট্রীয় শেষকৃত্যে তিনি যেসব দেশের (যেমন অস্ট্রেলিয়া, কানাডা) রানি ছিলেন, সেসব দেশের নেতারা, বিশ্বের অন্যান্য রাজপরিবারের প্রতিনিধিরা এবং অন্যান্য দেশের সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানেরা অংশ নেবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
রানির মৃত্যুর পর থেকেই শুরু হয়েছে বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা। আজ শুক্রবার মধ্যদুপুরে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবে ও সেন্ট পলস ক্যাথেড্রালে ঘণ্টা বাজানো হবে। হাইড পার্ক ও টাওয়ার হিলে আনুষ্ঠানিক কামান দাগিয়ে সম্মান জানানো হবে।
গত বছরের এপ্রিলে ৯৯ বছর বয়সে তাঁর স্বামী প্রিন্স ফিলিপের মৃত্যু হলে রানি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। কিছুদিন ধরে তাঁর স্বাধীনভাবে চলাফেরাতেও সমস্যা দেখা দেয়। প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ ও নিয়োগের আগে আনুষ্ঠানিক সাক্ষাতের বিষয়টি ঐতিহ্যগতভাবে লন্ডনের বাকিংহাম প্রাসাদে হলেও বরিস জনসনের বিদায় এবং লিজ ট্রাসের নিয়োগের আনুষ্ঠানিকতা স্কটল্যান্ডের বালমোরাল প্রাসাদে অনুষ্ঠিত হয়। এরপর বুধবার রানির প্রিভি কাউন্সিলের সভায় অংশ নেওয়ার কথা থাকলেও অসুস্থতার কারণে তা বাতিল হয়। কয়েক মাস আগে রানি তাঁর শাসনকালের ৭০ বছর পূর্তির অনুষ্ঠানগুলোর সব কটিতেও অংশ নিতে পারেননি।
রানি এলিজাবেথের শাসনকাল অবশ্য একাধিকবার সংকটের মুখেও পড়েছে। যার মধ্যে সবচেয়ে বড় সংকটটি হয় চার্লস যখন যুবরাজ ছিলেন, এখন থেকে ২৫ বছর আগে এক দুর্ঘটনায় রাজকুমারী ডায়ানার মৃত্যুর পর। মৃত্যুর কয়েক বছর আগে রাজকুমারী ডায়ানার সঙ্গে চার্লসের বিচ্ছেদ ঘটে ক্যামিলার সঙ্গে প্রণয়কে কেন্দ্র করে।
পরিস্থিতি সামাল দিতে তখন রানিকে যথেষ্ট কৌশলী হতে হয়েছিল। এরপর রানির আরেক পুত্র রাজকুমার এন্ড্রুর উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাত্রা নিয়ে কেলেঙ্কারি ফাঁস হলে রাজপরিবারের জন্য বিব্রতকর অবস্থা তৈরি হয়। একইভাবে রানির প্রপৌত্র প্রিন্স হ্যারির অশ্বেতাঙ্গ প্রেমিকাকে বিয়ে করা নিয়ে তুমুল আলোচনা হয়। রাজপরিবারের ভেতরের অনেক অপ্রিয় কথা হ্যারি ও তাঁর স্ত্রী মেগান মেরকেল সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ করে দেওয়ায় বড় ধরনের আলোড়ন তৈরি হয়। হ্যারি ও মেগান জুটি রাজপরিবারের সব সুযোগ–সুবিধা হারান এবং যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। এসব বিতর্ক রাজতন্ত্রের জন্য সাময়িক চ্যালেঞ্জ তৈরি করলেও রানি তা বেশ ভালোভাবেই মোকাবিলা করেন। তাঁর রাজ্য শাসনের ৭০ বছর পূর্তির উৎসবে রাজপরিবারের প্রতি অবিশ্বাস্য রকম সমর্থনের প্রতিফলন ঘটে।
রানি এলিজাবেথ যে অনন্য ইতিহাস তৈরি করে গেছেন, সেই ভাবমূর্তি ধরে রাখার এক কঠিন চ্যালেঞ্জ এখন বর্তাল রাজা তৃতীয় চার্লসের ওপর। তিনি তাঁর মায়ের গুণাবলি রাজকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে কতটা আয়ত্ত করতে পেরেছেন, এখন তা প্রমাণের পালা শুরু হলো।