চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং তিন দিনের সফরে সোমবার মস্কোয় পৌঁছেছেন। তাঁর এই সফরকে ‘বন্ধুত্ব, সহযোগিতা ও শান্তির অভিযাত্রা’ বলা হচ্ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ইতি টানতে যুদ্ধবিরতিসহ চীনের দেওয়া ১২ দফা শান্তি প্রস্তাবের কয়েক সপ্তাহ পর সির এই সফর অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এ ছাড়া কয়েক দিন আগেই বেইজিংয়ের মধ্যস্থতায় সৌদি আরব ও ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের আকস্মিক ঘোষণা দেয় মস্কো। যদিও দীর্ঘদিন ধরে এই দুই দেশের সঙ্গে মস্কোর বৈরীর সম্পর্ক ছিল।
সফরে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে একান্তে বৈঠক করার কথা রয়েছে সির। দুই নেতার মধ্যে এটি হবে ৪০তম বৈঠক। পুতিনকে নিজের ‘সবচেয়ে ভালো বন্ধু’ হিসেবে অভিহিত করেছেন সি। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে বর্তমানে পুতিনের মাথার ওপর আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানার খড়্গ ঝুলছে।
শুধু সৌদি আরব-ইরানের বৈরিতা অবসানে চীনের মধ্যস্থতা এবং মস্কো ও কিয়েভের মধ্যে সংলাপের প্রস্তাবের কারণেই এ আশা জাগেনি; বরং পুতিনের সঙ্গে বৈঠকের পর সি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে ভার্চ্যুয়ালি বৈঠক করতে পারেন—এমন খবরে এই সফর ঘিরে এ প্রত্যাশার সৃষ্টি হয়েছে।
তৃতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া সি বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে চীনকে বৃহত্তর ভূমিকায় দেখতে আগ্রহী। ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে তাঁকে ঘিরে বড় ধরনের সাফল্য আশা করছেন অনেকে। এই সংঘাত দ্বিতীয় বছরে গড়িয়েছে। এই যুদ্ধে নিহত হয়েছেন হাজারো মানুষ। লাখো মানুষ হয়েছেন বাস্তুচ্যুত। এই সংঘাতের ফলে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। খাদ্যশস্য, সার ও জ্বালানি সরবরাহের স্বল্পতায় বিশ্বজুড়ে বেড়েছে মূল্যস্ফীতি।
শুধু সৌদি-ইরানের বৈরিতা অবসানে চীনের মধ্যস্থতা এবং মস্কো ও কিয়েভের মধ্যে সংলাপের প্রস্তাবের কারণেই এ আশা জাগেনি; বরং পুতিনের সঙ্গে বৈঠকের পর সি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে ভার্চ্যুয়ালি বৈঠক করতে পারেন—এমন খবরে এই সফর ঘিরে আশার সঞ্চার হয়েছে। যদি শেষ পর্যন্ত সি ও জেলেনস্কির মধ্যে এই বৈঠক হয়, তবে সেটি হবে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রুশ হামলার পর দুই নেতার মধ্যে প্রথম বৈঠক।
বৈশ্বিক শান্তি স্থাপনকারী
গত বছর পুতিনের সঙ্গে ‘সীমাহীন’ অংশীদারত্বের ঘোষণা দিয়েছিলেন সি। অধিকাংশ পর্যবেক্ষক বলছেন, ইউক্রেনে শান্তি প্রতিষ্ঠায় মধ্যস্থতার চেয়ে রাশিয়ার সঙ্গে এই ‘সীমাহীন’ অংশীদারত্বের বিষয়টি পোক্ত করতেই সির এই সফর। কারণ, বিবদমান দুটি পক্ষের কাউকেই যুদ্ধ বন্ধে প্রস্তুত কিংবা ইচ্ছুক বলে মনে হচ্ছে না।
জার্মান মার্শাল ফান্ড অব দ্য ইউনাইটেড স্টেটসের এশিয়া প্রোগ্রামের পরিচালক বোনি গ্লাসের বলেন, ‘যদি না এবং যতক্ষণ না রাশিয়া ও ইউক্রেনের লড়াইয়ের ইচ্ছা ফুরাচ্ছে এবং তারা সংঘাত এড়ানোর পথ না খোঁজে, তাহলে এর সমাপ্তি সম্ভব নয়। আমি মনে করি না, চীন এর মধ্যে নিজেকে জড়াতে চাইবে।’
গ্লাসের বলেন, ১২ দফা প্রস্তাবে চীনের অবস্থান ব্যাখ্যা করা হয়েছে এবং এটি শান্তি পরিকল্পনা নয়।
চীন সত্যিই গ্লোবাল সাউথকে ইঙ্গিত দিতে চায় যে তারা একটি দায়িত্বশীল বৃহৎ শক্তি। এটি লক্ষণীয় যে চীন তার নিজস্ব অবস্থান খোলাখুলিভাবে উপস্থাপন করছে, যখন এটি মূলত ইউরোপেরই যুদ্ধ। এটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চীনের সম্পৃক্ততার সত্যিই নতুন মাত্রা।
ইউক্রেন যুদ্ধের বার্ষিকীতে চীনের এসব প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, যেখানে এই সংঘাতের বিষয়ে চীনের অস্পষ্ট অবস্থানের বিষয়টিই প্রতিফলিত হয়েছে। চীনের নথিতে একদিকে ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বের প্রতি সমর্থন জানানো হয়েছে এবং দ্রুত যুদ্ধ বন্ধে সমাধানের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে এই সংকটের জন্য বেইজিংয়ের ভাষায় কথিত ‘স্নায়ুযুদ্ধের মানসিকতাকে’ দায়ী করা হয়েছে, আর সেটা হলো পূর্ব দিকে ন্যাটোর বিস্তার এবং রাশিয়ার নিরাপত্তা উদ্বেগ পশ্চিমাদের উপেক্ষা করা। চীন রাশিয়ার ওপর পশ্চিমাদের একতরফা নিষেধাজ্ঞার নিন্দা জানিয়েছে, যদিও গত বছর এসব নিষেধাজ্ঞার অধিকাংশই মেনে চলেছে বেইজিং।
গ্লাসের বলেন, ‘শান্তি প্রস্তাবে মানবিক সহায়তার প্রয়োজনীয়তার ওপর একটি পূর্ণ অনুচ্ছেদ রয়েছে, কিন্তু চীন সেই সহায়তা কোথায় দিয়েছে? সুতরাং, এটি কোনো শান্তি পরিকল্পনা নয়, চীন শান্তি স্থাপনকারীর ভূমিকাও পালন করছে না।’
এই বিশ্লেষক আরও বলেন, সৌদি-ইরান চুক্তির শিক্ষা হলো চীন সুযোগ নিতে পটু। এর মানে এই নয় যে চীন এখন বৈশ্বিক বিরোধ অবসানে গুরুত্বপূর্ণ মধ্যস্থতাকারী হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘এটি ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছিল, সৌদি আরব ও ইরান সম্পর্ক উন্নয়নের পথ খুঁজছিল। আর সেটার চূড়ান্ত রূপ দেওয়ার সুযোগটি নেয় চীন।’ গ্লাসের বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ক্ষেত্রে সেই সময়টি এখনো আসেনি।’
সোমবার রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় পত্রিকা রোসিসকায়া গেজেটে বলা হয়, ইউক্রেন সংঘাত থেকে বেরিয়ে আসতে ‘যৌক্তিক পথ’ খুঁজে বের করার আহ্বান জানিয়েছেন সি। তিনি বলেছেন, চীনের শান্তি প্রস্তাব সংকটের পরিণতি নিরপেক্ষ করতে ও একটি রাজনৈতিক নিষ্পত্তির দিকে এগিয়ে যেতে গঠনমূলক বিষয় হিসেবে কাজ করবে।
দায়িত্বশীল, বৃহৎ শক্তি
কিছু বিশ্লেষক বলছেন, রাশিয়ার ওপর চীনের প্রভাব, সেই সঙ্গে বৈশ্বিক রাজনীতিতে দায়িত্বশীল তৃতীয় শক্তি হিসেবে বিবেচিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকে ইউক্রেনে যুদ্ধবিরতি ও সংলাপের বিষয়ে পুতিনকে ‘ক্ষুদ্র পদক্ষেপ’ গ্রহণে চাপ দিতে পারেন সি।
ইয়েল ল’ স্কুলের পল সাই চীনা সেন্টারের গবেষক মোরিৎস রুডলফ বলেছেন, ‘চীন সত্যিই গ্লোবাল সাউথকে ইঙ্গিত দিতে চায় যে তারা একটি দায়িত্বশীল বৃহৎ শক্তি। এটি লক্ষণীয় যে চীন তার নিজস্ব অবস্থান খোলাখুলিভাবে উপস্থাপন করছে, যখন এটি মূলত ইউরোপেরই যুদ্ধ। এটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চীনের সম্পৃক্ততার সত্যিই নতুন মাত্রা। আমি মনে করি, দেশটি এ অবস্থানেই থাকবে।’
রুডলফ বলেন, যদি রাশিয়া সফর শেষে সি ইউরোপের অন্যান্য রাজধানী ভ্রমণ করেন যেমনটা ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে এবং তিনি যদি পুতিনের সঙ্গে বৈঠকের পরপরই জেলেনস্কির সঙ্গে কথা বলেন, এতে বোঝা যাবে সি বস্তুত সক্রিয় ভূমিকা পালনের চেষ্টা করছেন।