দনবাস, খেরসন ও জাপোরিঝঝিয়া অঞ্চলে চলমান গণভোট নিয়ে পশ্চিমা গণমাধ্যমে জোরেশোরে চলছে সমালোচনা। এ ভোটকে ‘অবৈধ ও ভাঁওতাবাজি’ বলছে ইউক্রেন ও দেশটির পশ্চিমা মিত্ররা। তবে রুশ সংবাদ সংস্থা স্পুতনিকের এক প্রতিবেদনে ইউরেশিয়া–বিশেষজ্ঞ ও ইরানি বিশ্লেষক মেহেদি খোরসান্দ বলছেন ভিন্ন কথা।
খোরসান্দ বলেন, একধরনের আশঙ্কা থেকেই পশ্চিমারা এই গণভোটের বিরোধিতা করছে। কারণ, গণভোটের পর যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে, তাতে তারা অবস্থান বদলাতে বাধ্য হবে।
গতকাল শনিবার থেকে লুহানস্ক, দোনেৎস্ক, জাপোরিঝঝিয়া ও খেরসনে শুরু হয়েছে গণভোট। চলবে আগামী মঙ্গলবার পর্যন্ত। বিভিন্ন জরিপ বলছে, এসব এলাকার বাসিন্দাদের বড় অংশ রাশিয়ান ফেডারেশনে যোগ দেওয়াকে সমর্থন করে।
গত বুধবার রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন দেশবাসীর উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে গণভোটে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি দেশটিতে আংশিক সেনা সমাবেশের ঘোষণা দেন।
পুতিনের এ বক্তব্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর মিত্রদেশগুলো। এসব দেশ এ গণভোটকে ভুয়া বলে অভিহিত করেছে। ভোটের ফলাফলকেও স্বীকৃতি না দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।
তবে ডিপার্টমেন্ট অব ইকোনমিক ডিপ্লোমেসি অব দ্য মিউনিসিপ্যালটি অব তেহরানের প্রধান ও ইউরেশিয়া–বিশেষজ্ঞ মেহেদি খোরসান্দ বলেন, ইউরোপ আশঙ্কা করছে, গণভোট চলাকালে ইউক্রেনের অধীন থাকা আরও বেশি এলাকা ইউরোপীয় নীতি থেকে নিজেদের দূরে রাখতে চাইবে। এসব এলাকা সহায়তার জন্য রাশিয়ার প্রতি অনুরোধ জানাবে। এই বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, গণভোট ইউরোপের জন্য একধরনের হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। কারণ, প্রায় দুই শতাব্দী ধরে ইউরোপ এসব এলাকাকে স্বাধীন হতে চাপ দিচ্ছে।
খোরসান্দ বলেন, পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলো, বিশেষ করে ইউরোপীয় ও আমেরিকানরা রাশিয়াকে দুর্বল করতে এসব অঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদি দ্বন্দ্ব-সংঘাত জিইয়ে রাখতে চায়। তিনি জোর দিয়ে বলেন, চলমান গণভোট সংঘাতের অবসান ঘটানোর মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। আর এখানেই পশ্চিমাদের ভয়।
ইরানি এই বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, রাশিয়া নিরাপত্তার কারণে ইউক্রেনে বিশেষ সামরিক অভিযান শুরু করেছে। যদি ২০১৪ সালের উত্তেজনার পর ইউক্রেনের সরকার মিনস্ক চুক্তির বিধিনিষেধ মেনে চলত, তাহলে এ ধরনের সহিংসতা তাদের দেখতে হতো না।
২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে যুক্তরাষ্ট্র–সমর্থিত অভ্যুত্থানের পরে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চল কিয়েভের সামরিক জান্তার শাসন থেকে স্বায়ত্তশাসনের জন্য আহ্বান জানায়। এর পাল্টা প্রতিক্রিয়া হিসেবে পূর্বাঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমনে কিয়েভ সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান শুরু করে। রাশিয়া, জার্মানি, ফ্রান্স ও ইউক্রেন নিয়ে গঠিত দল দ্য নরমান্ডি ফোর দনবাসে রক্তপাত বন্ধে ও বিচ্ছিন্ন অঞ্চলগুলোকে স্বায়ত্তশাসন দিতে একটি রোডম্যাপ, মিনস্ক চুক্তি করে।
তবে কিয়েভের পরবর্তী সরকারগুলো নিয়মিতভাবে মিনস্ক চুক্তি লঙ্ঘন করেছে। এ কারণে দনবাসে বৈধ স্বায়ত্তশাসন আসেনি। এ ছাড়া ইউক্রেনের সরকার ন্যাটোর সদস্য পদকে মূলনীতি হিসেবে নির্ধারণ করেছে। সামরিক প্রশিক্ষণ বাড়িয়েছে এবং দেশে অস্ত্রায়ণ করেছে।
খোরসান্দ বলেন, ২০১৪ সালের পর রাশিয়া বেসামরিকীকরণ, ন্যাটোতে যোগ না দেওয়া, পূর্বাঞ্চলের লুহানস্ক ও দোনেৎস্কের স্বায়ত্তশাসন নিয়ে ইউক্রেনের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা করেছে। তবে ২০১৪ সালের পর ইউক্রেনের সরকার দেশটির পূর্বাঞ্চলে রাশিয়ার ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ওপর গণহত্যা চালায়।
মিনস্ক চুক্তি মেনে চলতে কিয়েভের ওপর চাপ প্রয়োগের জন্য চুক্তির অন্তর্ভুক্ত প্যারিস ও বার্লিনের প্রতি বারবার আহ্বান জানিয়েছে মস্কো। তবে তাদের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। এরপর রাশিয়া ন্যাটোতে ইউক্রেনের যোগ দেওয়া ঠেকাতে খসড়া নিরাপত্তা চুক্তি করে। মস্কো এই খসড়া গত বছরের ডিসেম্বর মাসে যুক্তরাষ্ট্র ও ট্রান্স–আটলান্টিক জোটের দেশগুলোর কাছে হস্তান্তর করে। ওই খসড়ায় রাশিয়া তাদের দোরগোড়ায় ন্যাটো সম্প্রসারণ না করার প্রতিশ্রুতির কথা পশ্চিমা বিশ্বকে মনে করিয়ে দেয়।
রুশ সরকার সে সময় স্পষ্টভাবে জাতীয় নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার কথা জানিয়ে দেয়। পশ্চিমারা খসড়া চুক্তিতে থাকা বিষয়গুলো উপেক্ষা করলে রাশিয়া সামরিক কৌশল বেছে নেবে বলেও জানানো হয়। তবে এরপরও যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটো মস্কোর দেওয়ার প্রস্তাবের মূল বিষয়গুলো প্রত্যাখ্যান করে।
খোরসান্দ বলেন, এ অবস্থায় নিরাপত্তার সংকট কাটাতে বিশেষ সামরিক অভিযান শুরু করা ছাড়া রাশিয়ার সামনে আর কোনো পথ খোলা ছিল না। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা আশা করি, গণভোট শেষ হবে। লুহানস্ক, দোনেৎস্ক ও খেরসনের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাসিন্দা রাশিয়ায় যোগ দেওয়ার পক্ষে ভোট দেবেন। গণভোটের পর শত্রুতা শেষ হবে—এমন সম্ভাবনাও আমি উড়িয়ে দিচ্ছি না।’
রাশিয়া গত ২২ ফেব্রুয়ারি দোনেৎস্ক ও লুহানস্কের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেয়। তবে এই সিদ্ধান্তের পর এসব অঞ্চল রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে বাফার জোন হয়ে উঠেছে। রাশিয়ান ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত করা হলে এসব অঞ্চলের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে বলছেন খোরসান্দ। দ্য দনবাস রিপাবলিক, জাপোরিঝঝিয়া ও খেরসনের আঞ্চলিক কর্তৃপক্ষ ১৯ ও ২০ সেপ্টেম্বর ঘোষণা দিয়ে গণভোটের প্রতি ইচ্ছা প্রকাশ করেছে।
ইরানি বিশ্লেষক খোরসান্দ বলেন, মিনস্ক চুক্তিতে দনবাসের স্বায়ত্তশাসন পুরোপুরি গৃহীত হয়েছিল। এর আগে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ নিউজউইকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, লুহানস্ক পিপলস রিপাবলিক (এলপিআর), দোনেৎস্ক পিপলস রিপাবলিক (ডিপিআর), জাপোরিঝঝিয়া ও খেরসন অঞ্চল তাদের অধিকারের প্রয়োগ করেছে। রাশিয়ায় যোগ দিতে ইচ্ছুক বলে তারা যে ঘোষণা দিয়েছে, সেটি জাতিসংঘ সনদের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ বলেও মত দেন তিনি।
এই গণভোটের পর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ তাদের অবস্থান বদলাতে বাধ্য হবে, বলছেন খোরসান্দ। কারণ, গণভোটের পর রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে সহিংসতা নিরসনের সুযোগ সৃষ্টি হবে।