৬ বছর খোঁজাখুঁজি করে পাওয়া যায় ধনকুবের আল ফায়েদের ধর্ষণের প্রমাণ
যুক্তরাজ্যের অভিজাত বিপণিবিতান হ্যারোডসের একসময় মালিক ছিলেন মিসরীয় ধনকুবের মোহামেদ আল ফায়েদ। গত বছর মারা যান তিনি। এরপর তাঁর বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ আনেন হ্যারোডসের পাঁচ নারী কর্মী। সম্প্রতি ‘আল ফায়েদ: হ্যারোডসের শিকারি’ শিরোনামে একটি প্রামাণ্যচিত্রও প্রকাশিত হয়েছে। এটি প্রকাশের পর হ্যারোডসের আরও অনেক সাবেক কর্মী বলেন, তাঁরা আল ফায়েদের যৌন নিপীড়ন বা ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন।
আল ফায়েদের এমন কর্মকাণ্ডের পক্ষে প্রমাণ জোগাড়ে ছয় বছর ধরে অনুসন্ধান চালিয়েছেন এক ব্যক্তি। ধনকুবের ফায়েদের যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন, নিজ বাগ্দত্তার এমন অভিযোগের পর তিনি প্রমাণ সংগ্রহে ওই খোঁজাখুঁজি শুরু করেন বলে জানান। ফায়েদের ধারাবাহিক ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের ঘটনা উদ্ঘাটনে কীভাবে সহায়তা করেছেন, সেই বিষয়ে বিবিসিকে বর্ণনা দেন তিনি।
হ্যারোডসে ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়ার ঘটনা আমার কাছে বর্ণনা করা সোফিয়ার জন্য ছিল খুব কষ্টের ব্যাপার। এখনো এ নিয়ে আতঙ্কে ভোগে তিনি।
কিটন স্টোন নামের এই ব্যক্তি বিবিসিকে বলেন, ফায়েদের ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের শিকার নারীদের সঙ্গে কথা বলে তিনি ‘ভয়ানক’ সব নথি জোগাড় করেছেন। আর এ কাজ করতে গিয়ে বছরের পর বছর বিশ্ব ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি।
কিটন এসব প্রমাণ গত বছর বিবিসির কাছে নিয়ে আসেন এবং প্রামাণ্যচিত্র ‘আল ফায়েদ: হ্যারোডসের শিকারি’ তৈরিতে সহায়তা করেন। প্রামাণ্যচিত্রে তুলে ধরা হয়, হ্যারোডসের নারী কর্মীদের ওপর মালিক আল ফায়েদের যৌন নিপীড়নের নানা তথ্যপ্রমাণ। হ্যারোডসের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ সে সময় ফায়েদের এসব কর্মকাণ্ডে কোনো হস্তক্ষেপ করেনি, বরং অভিযোগগুলো ধামাচাপা দেওয়ায় ভূমিকা রাখে।
কিটন বলেন, তাঁর বর্তমান স্ত্রী সোফিয়া স্টোন ১৯ বছর বয়সে হ্যারোডসে যোগ দেন। দায়িত্ব পান ব্যবসায়ী ফায়েদের একজন ব্যক্তিগত সহকারীর।
প্রামাণ্যচিত্রে তুলে ধরা হয়, হ্যারোডসের নারী কর্মীদের ওপর মালিক আল ফায়েদের যৌন নিপীড়নের নানা তথ্যপ্রমাণ। হ্যারোডসের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ সে সময় ফায়েদের এসব কর্মকাণ্ডে কোনো হস্তক্ষেপ করেনি, বরং অভিযোগগুলো ধামাচাপা দেওয়ায় ভূমিকা রাখে।
সোফিয়া ২০১৮ সালে (তখন কিটনের বাগ্দত্তা তিনি) কিটনকে জানান যে আল ফায়েদ তাঁকে যৌন নিপীড়ন, এমনকি ধর্ষণ করেছেন।
এ তথ্য কিটন এমন একসময় জানতে পারেন যখন সোফিয়ার জীবনবৃত্তান্ত নতুন করে লিখছিলেন তিনি। পরে জীবনবৃত্তান্তের ওপরের দিকে তিনি সোফিয়ার হ্যারোডসে কাজ করার বিষয়টি উল্লেখ করেন।
কিটন বলেন, ‘আমার ধারণা, আমার কেন, সবার কাছেই হ্যারোডস বিস্ময়কর ও সম্মানজনক প্রতিষ্ঠান। তাই বিপণীবিতানটিকে আমি খুব গুরুত্ব দিতাম।’ তিনি বলেন, ‘তার সামনে যখন নতুন জীবনবৃত্তান্ত দিলাম, সে যে প্রতিক্রিয়া দেখাল, সেটি আমার প্রত্যাশিত ছিল না।’
‘জীবনবৃত্তান্ত দেখে সে কান্নায় ভেঙে পড়ে। বলতে থাকে, আমি কেন তার নাম (হ্যারোডস) সেখানে লিখলাম। সে সেটি মুছে ফেলতে বলে’, বলেন কিটন। পরে হ্যারোডসে চাকরি করার সময়কালে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা জানলাম।
এরপর আল ফায়েদকে নিয়ে সোফিয়ার অভিযোগের বিষয়ে অনুসন্ধানে নামার সিদ্ধান্ত নেন কিটন। শুরু হয় এক দীর্ঘযাত্রা। সে যাত্রায় বেরিয়ে আসে আল ফায়েদের ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের সপক্ষে নানা প্রমাণ। এ নিয়ে নির্মিত হয় প্রামাণ্যচিত্রও।
প্রামাণ্যচিত্রটি তৈরিতে পরামর্শকের কাজ করেন কিটন স্টোন। বলেন, ‘হ্যারোডসে ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়ার ঘটনা আমার কাছে বর্ণনা করা সোফিয়ার জন্য ছিল খুব কষ্টের ব্যাপার। এখনো এ নিয়ে আতঙ্কে ভোগে সে।’
সোফিয়া তাঁর বাগ্দত্তা কিটনকে বলেছিলেন, হ্যারোডসে তিনি ১৯৮৮ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত কাজ করেন। এ সময় আল ফায়েদ তাঁকে একাধিকবার ধর্ষণের চেষ্টা চালান। অন্তত একবার ধর্ষণ করতেও সক্ষম হন। অফিসের ভেতর-বাইরে সব জায়গায় তাঁকে বিরামহীনভাবে যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন করেন তিনি। ব্যক্তিগত হেলিকপ্টার ও উড়োজাহাজে যাত্রার সময়ও বাদ যায়নি তা থেকে।
কিটন আরও বলেন, ‘আমার জানার খুব আগ্রহ ছিল, ধর্ষণ ও নিপীড়নের শিকার কর্মীরা কেন প্রতিষ্ঠানটি ছেড়ে চলে যাননি। প্রকৃতপক্ষে, তাঁরা যেতে পারেননি, তাঁদের হুমকি দেওয়া হয়েছে, চুপ করিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাঁরা ছিলেন আতঙ্কে।’ একই কারণে সোফিয়াও হ্যারোডস ছেড়ে চলে যেতে পারেননি বলে জানান কিটন।
কিটন আরও বলেন, ফায়েদের ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়া অনেক নারীর অভিজ্ঞতাও তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার মতো নয়।
বার্মিংহাম ও লন্ডনে থাকাকালে কিটন-সোফিয়া দম্পতি আল ফায়েদের ধর্ষণের প্রমাণ সংগ্রহে এখানে–সেখানে যান। শেষমেশ স্ট্যাফোর্ডশায়ারের ছোট শহর লিচফিল্ডে থিতু হন।
আল ফায়েদের যৌন নিপীড়ন ও ধর্ষণের সব ঘটনা ঘটেছে যুক্তরাজ্যের লন্ডন, ফ্রান্সের প্যারিস ও সেন্ট ত্রোপেজ এলাকা এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবিতে। ভুক্তভোগী নারীদের হয়ে কাজ করা আইনজীবী ব্রুস ড্রামমন্ডের ভাষ্যমতে, হ্যারোডসের ভেতরে দুর্নীতি ও নিপীড়নের যে জাল বোনা হয়েছিল, তা ছিল অবিশ্বাস্য ও খুবই অন্ধকারের।
ভুক্তভোগী এমনই এক নারী হ্যারোডসের ‘অন্ধকার’ জগতের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, লন্ডনের পার্ক লেনের একটি বাসায় তাঁকে ধর্ষণ করেছিলেন ফায়েদ। এতে তাঁর সম্মতি ছিল না। সেটা ফায়েদকেও জানিয়েছিলেন, তবে কোনো কাজ হয়নি।
লন্ডনের মেফেয়ার এলাকার আরেক নারীও ফায়েদের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ এনেছেন। ঘটনার সময় তিনি ছিলেন একজন কিশোরী। ওই নারী বলেন, ফায়েদ একজন রাক্ষসের মতো ছিলেন। একজন যৌন নিপীড়নকারী তিনি। তাঁর মধ্যে কোনো নৈতিকতা ছিল না। হ্যারোডসের সব কর্মী তাঁর কাছে ছিলেন ‘খেলনার’ মতো।
আল ফায়েদ ২০২৩ সালের আগস্টে মারা যান। মৃত্যুর আগে তাঁর বিরুদ্ধে ওই সব অভিযোগ নিয়ে কিছু একটা ঘটতে চলেছে, বিষয়টি তিনি বুঝেছিলেন বলে জানান কিটন।