পুতিন ও প্রিগোশিন: দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব যেভাবে বৈরিতায় রূপ নেয়
নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিক। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রাশিয়ার রাজনৈতিক অবস্থা তখন খুবই নাজুক। সে সময় দেশটির সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরে ইয়েভগেনি প্রিগোশিনের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ হয় ভ্লাদিমির পুতিনের। তিনি তখনো রাশিয়ায় রাষ্ট্রক্ষমতার কেন্দ্রে আসেননি। আর প্রিগোশিনের হাত ধরে ভাড়াটে যোদ্ধা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ভাগনার গ্রুপও গড়ে ওঠেনি।
সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরে জন্ম পুতিন ও প্রিগোশিনের। শহরটিকে রাশিয়ার সাংস্কৃতিক কেন্দ্রও বলা হয়। সেখানে রয়েছে রাশিয়ার বিখ্যাত হারমিটেজ আর্ট মিউজিয়াম ও ইম্পেরিয়াল উইন্টার প্যালেস। সেন্ট পিটার্সবার্গের আরেকটি পরিচয় আছে। তা হলো, এ শহর রাশিয়ার অপরাধের রাজধানী, শক্তিশালী সব অপরাধী চক্রের ঘাঁটি।
সেন্ট পিটার্সবার্গে পুতিন ও প্রিগোশিনের প্রথম সাক্ষাৎ কোন ঘটনাচক্রে হয়েছিল, তা জানা যায়নি। প্রিগোশিন তখন সবেমাত্র কারাগার থেকে ছাড়া পেয়েছেন। আর সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবির কর্মকর্তা হিসেবে পূর্ব জার্মানিতে এক অভিযান শেষ করে দেশে ফিরেছেন পুতিন। এরপর পা রাখার চেষ্টা করছেন রাজনীতিতে।
প্রিগোশিন প্রথম অপরাধী হিসেবে সাজা পান মাত্র ১৭ বছর বয়সে। তাই অপরাধ জগৎ তাঁর কাছে ততটাও অচেনা ছিল না। সত্তরে দশকে চুরির অপরাধে সাজা হয় তাঁর। তবে পরে ওই সাজা মওকুফ করা হয়। এরপর ১৯৮১ সালে ডাকাতির অভিযোগ ওঠে প্রিগোশিনের বিরুদ্ধে। সেবার আর পার পাননি। কারাগারে থাকতে হয় লম্বা সময়ের জন্য।
১৯৯০ সালে যখন প্রিগোশিন সাজা খেটে কারাগার থেকে বের হন, তত দিনে রাশিয়ায় চিত্রপট অনেকটা বদলে গেছে। সোভিয়েত নেতা লিওনিড ব্রেজনেভের জায়গায় ক্ষমতায় এসেছেন সংস্কারপন্থী নেতা মিখাইল গর্ভাচেভ। প্রিগোশিন তখন সেন্ট পিটার্সবার্গে হটডগ বিক্রি শুরু করেন। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে একটি রেস্তোরাঁ খোলেন তিনি। নাম রাখেন ‘দ্য ওল্ড কাস্টম হাউস’। ধারণা করা হয়, সেখানেই পুতিনের সঙ্গে তাঁর প্রথম দেখা হয়েছিল।
ওই একটি রেস্তোরাঁ দিয়ে শুরু করে পরে আরও কয়েকটি রেস্তোরাঁ খোলেন প্রিগোশিন। সেন্ট পিটার্সবার্গের বাইরে থেকেও রাজনীতিকেরা আসতেন তাঁর রেস্তোরাঁগুলোয় খাবার খেতে। শতাব্দী গড়ানোর পর পুতিন যখন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হলেন, তখন প্রিগোশিনের সঙ্গে তাঁর সখ্য আরও বাড়ল। তিনি একটা নাম পেলেন—‘পুতিনের পাচক’। একটি ছবিতে প্রিগোশিনকে পুতিন ও যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশকে খাবার খাওয়াতেও দেখা গেছে প্রিগোশিনকে।
পুতিনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন প্রিগোশিন। রুশ প্রেসিডেন্টেরও এমন একজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ দরকার ছিল যিনি কি না এটা নিশ্চিত করবেন, তিনি যে খাবার খাবেন সেগুলো নিরাপদ।
যা–ই হোক, পুতিনের শাসনামলে রুশ গোয়েন্দা সংস্থা তার আগের অবস্থায় ফেরত যায়। এই বাহিনী আবারও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। আর এই সময় ক্রেমলিনের হয়ে বিভিন্ন কাজ করার সুযোগ পান প্রিগোশিন। বিশেষ করে, যে কাজ যেগুলো নিরাপত্তা বাহিনী বা গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষে করা সম্ভব ছিল না, এমন কিছু কাজ করার সুযোগ পান তিনি।
প্রিগোশিন এরপর বেশ কিছু গণমাধ্যম গড়ে তোলেন। এসব গণমাধ্যমের কাজ ছিল রাশিয়া ও সারা বিশ্বে নানা ধরনের মিথ্যা তথ্য প্রচার করা। তাদের হাত ধরে এমন কিছু আজগুবি গল্প তৈরি হতো, যেগুলো রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম প্রচারের সাহস পেত না।
এরপর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যখন জনপ্রিয় হতে শুরু করে, তখন ‘ট্রোল’ করার জন্য প্রতিষ্ঠান খোলেন প্রিগোশিন। এই প্রতিষ্ঠান রাশিয়ার মানুষদের এমন একটি পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দিয়েছিল যে তাঁরা আসলে ভাবতে শুরু করে, আসলে কিছুই সত্য নয়। আর এই সত্যের অনুসন্ধান করতে যাওয়া একেবারে বৃথা।
প্রিগোশিনের এই প্রতিষ্ঠানের নাম ইন্টারনেট রিসার্চ এজেন্সি। এর প্রতিষ্ঠার প্রায় এক দশক পর এসে তিনি স্বীকার করেন, ইন্টারনেট রিসার্চ এজেন্সির পেছনে তিনি ছিলেন।
এরপর ২০১৩ ও ২০১৪ সালের ঘটনা। ইউক্রেনের ক্রিমিয়া দখল করে রাশিয়া। এই সময় ভাড়াটে যোদ্ধা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ভাগনারের নাম শোনা যায়। সেই সময় ক্রিমিয়া ও ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে রাশিয়াপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সাহায্য করছিলেন ভাগনার যোদ্ধারা। প্রেসিডেন্ট পুতিনের কর্তৃত্ববাদকে সুসংহত করতে সেই সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছিলেন প্রিগোশিন ও তাঁর প্রতিষ্ঠান। যদিও রাশিয়ার আইনে এমন ভাড়াটে যোদ্ধা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান নিষিদ্ধ ছিল।
শুধু ইউক্রেন নয়, সিরিয়াতেও রাশিয়ার হয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে ভাগনার। এ ছাড়া আফ্রিকার লিবিয়া, মালি থেকে শুরু করে সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক পর্যন্ত তাদের কার্যক্রম বিস্তৃত ছিল। যদিও ক্রেমলিনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা অনুসারে, প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে প্রিগোশিনের বিশেষ কোনো সম্পর্ক নেই।
২০২২ সালের বসন্ত পর্যন্ত ক্রেমলিন এটা বলে আসছে, তাদের সঙ্গে ভাগনারের কোনো সম্পর্ক নেই। এ ছাড়া পুতিন কিংবা তাঁর প্রেস সচিব দিমিত্রি পেসকভ কখনোই জোর দিয়ে এটা বলেননি, প্রিগোশিনের বিষয়ে তাঁরা জানেন এবং তাঁর কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তাঁরা ওয়াকিবহাল। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ক্রেমলিনের অনুমতি ছাড়া এই ধরনের কর্মকাণ্ড ভাগনার বা প্রিগোশিনের পক্ষে চালানো সম্ভব ছিল না।
গত বছরের নভেম্বরে প্রিগোশিনকে সেন্ট পিটার্সবার্গে ভাগনার সেন্টার খুলতে দেখা যায়। এ ছাড়া রাশিয়ার সেনাবাহিনী ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সমালোচনা করতেও দেখা যায় তাঁকে। প্রিগোশিনের এই সমালোচনা আরও বাড়ে যখন ইউক্রেনের বিভিন্ন জায়গা থেকে রুশ বাহিনী সরে যায়।
প্রিগোশিন একপর্যায়ে অভিযোগ করেন, ভাগনার যোদ্ধাদের অর্জনের স্বীকৃতি দিচ্ছে না রাশিয়ার নিয়মিত বাহিনী। এরপর সরাসরি রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু এবং রুশ বাহিনীর চিফ অব স্টাফ ভ্যালেরি গেরাসিমভের কড়া সমালোচনা করেন তিনি। প্রিগোশিনের অভিযোগ, গোলাবারুদ সরবরাহ না করার কারণে ইউক্রেনের বাখমুতে ভাগনারের হাজার হাজার যোদ্ধা মারা পড়ছেন।
এরপর আরও খ্যাপাটে আচরণ করতে দেখা যায় প্রিগোশিনকে। একটা সময় তিনি প্রেসিডেন্ট পুতিনের সমালোচনা করেন। তাঁকে দাদা (বৃদ্ধ) বলে সম্বোধন করেন। প্রিগোশিন বলেন, ‘এই যুদ্ধে আমরা কীভাবে জিতব, যদি দাদা বোকা হন।’
এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয়। প্রিগোশিন সরাসরি পুতিনের নাম বলেননি, তবে রাশিয়ার লোকজন এটা ধরে নেন, প্রিগোশিন আসলে পুতিনকে জড়িয়েই এই কথাগুলো বলেছেন।
রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও প্রিগোশিনের মধ্যে বিরোধ আরও বেড়ে যায়। প্রিগোশিন এই যুদ্ধের ভবিষ্যৎ নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। একপর্যায়ে রাশিয়ার নিয়মিত বাহিনীর অধীন ভাগনার গ্রুপকে যুক্ত হতে চাপ দেওয়া হয়। কিন্তু গত জুনের শেষ দিকে বিদ্রোহ করে বসেন প্রিগোশিন। বিদ্রোহের অংশ হিসেবে মস্কোর উদ্দেশে রওনা দেয় ভাগনার বাহিনী।
এ প্রসঙ্গে একটি সূত্র বিবিসিকে বলেছে, রাশিয়ার নিয়মিত বাহিনীর সঙ্গে যে বিরোধ ছিল, সেই বিষয়ে পুতিনের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেই বিদ্রোহ করেছিলেন প্রিগোশিন। কারণ, তাঁর ভয় ছিল, রাশিয়ার নিয়মিত বাহিনীর অধীন গেলে ভাগনারের যে স্বায়ত্তশাসন, তা হারাবেন প্রিগোশিন।
এই বিদ্রোহের মধ্যে ভাগনার যোদ্ধারা দুটি সামরিক হেলিকপ্টার, একটি উড়োজাহাজ ভূপাতিত ও ১৫ রুশ সেনাকে হত্যা করেন। এরপর ক্ষেপে যান পুতিন। প্রিগোশিনের নাম উচ্চারণ না করলেও তাঁকে বিশ্বাসঘাতক বলে আখ্যা দেন।
ভাগনারের বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়। এরপর ৩০ কমান্ডারসহ প্রিগোশিনের সঙ্গে দেখা করেন পুতিন। ক্রেমলিনে তিন ঘণ্টা ধরে তাঁদের বৈঠক হয়। তবে এই বৈঠকের আগেই ক্রেমলিনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, ইউক্রেনে ভাগনার যোদ্ধারা আর যুদ্ধে করবেন না।
ওই বৈঠকের পর প্রিগোশিনের ভাগ্য নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, তবে প্রিগোশিন বিশ্বাস করতেন, আফ্রিকাই তাঁর ভবিষ্যৎ। এই আফ্রিকা থেকে তাঁকে একটি ভিডিও প্রকাশ করতে দেখা যায়।
কিন্তু প্রিগোশিন অধ্যায়ের যবনিকা পতন হয়। রাশিয়ার ইতিহাসের অন্যান্য চরিত্রের মতো তাঁরও যাত্রা সাঙ্গ হয়। প্রিগোশিন— এক ব্যক্তি যাকে ক্রেমলিনের নিষ্ঠুরতম নীতিগুলি কার্যকর করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল; তবে তিনি নিজেই নির্মমভাবে শাস্তি পেয়েছেন এবং শেষ পর্যন্ত ধ্বংস হয়েছেন।
অথবা পুতিনের মতো করে বলা যেতে পারে, প্রিগোশিনের কপাল মন্দ এবং তিনি জীবনে বড় ভুল করেছিলেন।