কৃষ্ণসাগরে হামলা বন্ধে রাশিয়া–ইউক্রেন সমঝোতা

কৃষ্ণসাগরের কনস্তান্তা বন্দরে ক্ষতিগ্রস্ত শস্যবাহী কার্গো জাহাজ ‘আয়া’র একটি অংশ ঢেকে রাখা হয়েছে। ইউক্রেনের নৌবাহিনী বলেছে, জাহাজটিতে ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হেনেছিল। ১৯ সেপ্টেম্বরছবি: এএফপি

কৃষ্ণসাগরে দুই দেশের নৌযানে হামলা বন্ধে রাজি হয়েছে রাশিয়া ও ইউক্রেন। একে–অপরের জ্বালানি অবকাঠামোয় হামলা না চালানোর বিষয়েও একমত হয়েছে দুই দেশ। মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় এ দুই বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছায় মস্কো ও কিয়েভ। এই সমঝোতা শেষ পর্যন্ত কার্যকর হলে তা তিন বছরের বেশি সময় ধরে চলা রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের প্রচেষ্টায় বড় অগ্রগতি হবে।

সমঝোতা কার্যকরের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করা হবে বলে জানিয়েছে রাশিয়া ও ইউক্রেন। বুধবার কিয়েভে এক সংবাদ সম্মেলনে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেন, ‘এটা যদি রাশিয়া লঙ্ঘন করে, তাহলে আমি ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে সরাসরি প্রশ্ন করব। তারা লঙ্ঘন করলে আমরা রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা চাইব, অস্ত্র চাইব।’

আর কৃষ্ণসাগর নিয়ে সমঝোতার বিষয়ে ইউক্রেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রুস্তেম উমেরভ বলেছেন, কৃষ্ণসাগরের পূর্বাংশের বাইরে দিয়ে রুশ সামরিক নৌযানের যেকোনো ধরনের চলাচলকে সমঝোতার লঙ্ঘন হিসেবে ধরে নেবে কিয়েভ। একই সঙ্গে একে হুমকি বলে মনে করা হবে। তখন ইউক্রেনের নিজেদের রক্ষা করার পুরোপুরি অধিকার সৃষ্টি হবে।

রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে সমঝোতার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে হোয়াইট হাউস। পরে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ বলেন, ‘আমাদের (সমঝোতা মেনে চলার) নিশ্চয়তার প্রয়োজন পড়বে। আর কিয়েভের সঙ্গে চুক্তির তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে বলব, জেলেনস্কিকে ওয়াশিংটন নির্দেশ দিলেই কেবল এই নিশ্চয়তা পাওয়া যেতে পারে।’

সৌদি আরবে দুই বিষয় নিয়ে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে ঐকমত্য হয়। এর আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের উদ্যোগে ইউক্রেনে যুদ্ধবিরতির বিষয়ে দফায় দফায় আলোচনা হয়েছে। তিনি দ্রুত যুদ্ধ বন্ধের পক্ষে। তবে তাঁর প্রশাসনের অধীনে এই যুদ্ধ নিয়ে হোয়াইট হাউসের দৃষ্টিভঙ্গিতে বদল এসেছে। কিয়েভের প্রতি একাট্টা সমর্থনের বদলে এখন মস্কোর প্রতি বেশি সহানুভূতিশীল ওয়াশিংটন।

এর আগে গত সপ্তাহে ট্রাম্প ও পুতিনের মধ্যে টেলিফোনে আলাপ হয়। তাতে পুতিনের পক্ষ থেকে ৩০ দিনের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা হয়। তবে ইউক্রেন ও রাশিয়া পরস্পর জ্বালানি অবকাঠামোতে হামলা করবে না—এমন প্রস্তাবে পুতিন রাজি হন। ইউক্রেন জানায়, যথাযথ নথিভুক্ত জ্বালানি অবকাঠামোতে যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে তারা যোগ দিতে রাজি।

এদিকে মঙ্গলবার রাশিয়ার একজন আলোচক বলেছেন, ইউক্রেনে আংশিক যুদ্ধবিরতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় অন্য কয়েকটি দেশ ও জাতিসংঘকে যুক্ত করতে চায় রাশিয়া। সৌদি আরবে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার প্রতিনিধিদল ১২ ঘণ্টা আলোচনা করার এক দিন পর গ্রেগরি কারাসিন নামের ওই আলোচক রুশ বার্তা সংস্থা তাসকে বলেন, ‘আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, সর্বোপরি জাতিসংঘ এবং কয়েকটি দেশকে যুক্ত করে আলোচনা চালিয়ে যাব।’

ওয়াশিংটন বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে রাশিয়ার সঙ্গে সোমবার যুদ্ধ শেষ করার আলোচনা হয়েছে। তবে ইউক্রেন ও তার ইউরোপীয় মিত্ররা আশঙ্কা করছে, পুতিনের সঙ্গে ট্রাম্প এমন একটি চুক্তি করতে পারেন, যাতে রাশিয়ার দাবির কাছে নতি স্বীকার করা হবে। এতে ইউরোপের নিরাপত্তা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেছেন, কৃষ্ণসাগরে জাহাজের নিরাপত্তা ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে যেকোনো ধরনের চুক্তির সম্ভাব্যতা খতিয়ে দেখছে মস্কো ও ওয়াশিংটন।

পেসকভ সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা কারিগরি দিক নিয়ে আলোচনা করছি। এগুলো গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা হবে। রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেনকে নিয়ে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের কোনো আলোচনা হয়নি।’

আরও পড়ুন

অবশ্য রিয়াদে তিন দেশের কর্মকর্তারা একই হোটেলে ছিলেন; কিন্তু তারা পৃথকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে একে ‘শাটল কূটনীতি’ বলে মন্তব্য করা হয়।

পেসকভ বলেন, পুতিন ও ট্রাম্পের মধ্যে শিগগিরই আবার আলোচনা আয়োজনের পরিকল্পনা নেই। তবে প্রয়োজন পড়লে যেকোনো সময় তা আয়োজন করা হবে।

গত সপ্তাহে ট্রাম্প ও পুতিনের মধ্যে টেলিফোনে আলাপ হয়। তাতে পুতিনের পক্ষ থেকে ৩০ দিনের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা হয়। তবে ইউক্রেন ও রাশিয়া পরস্পর জ্বালানি অবকাঠামোতে হামলা করবে না এমন প্রস্তাবে পুতিন রাজি হন। ইউক্রেন জানায়, যথাযথ নথিভুক্ত জ্বালানি অবকাঠামোতে যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে তারা যোগ দিতে রাজি।

তবে সৌদি আরবে চলমান আলোচনার মধ্যেও পাল্টাপাল্টি হামলা চলছে। ইউক্রেনের বিমান বাহিনী জানিয়েছে, রাশিয়ার পক্ষ থেকে সোমবার রাতে পলতাভা ও কিয়েভ এলাকায় ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয়েছে।

ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রি সিবিহা বলেন, শান্তির বিষয়ে ফাঁপা বক্তব্য না দিয়ে রাশিয়ার উচিত বেসামরিক নাগরিকদের ওপর হামলা বন্ধ করা। রাশিয়া অভিযোগ করেছে, ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনী দুই রুশ সাংবাদিককে লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে। পূর্ব ইউক্রেনে গোলাবর্ষণে চালকসহ দুই সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। কিয়েভ এখনো এই ঘটনার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।

যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ৩০ দিনের যুদ্ধবিরতির চেয়েও বিস্তৃত নৌচুক্তির বিষয়ে চেষ্টা চালানো হয়েছে। ওয়াশিংটন বলছে, এ চুক্তি পরিপূর্ণ শান্তিচুক্তির আলোচনার পথ খুলে দেবে। পুতিনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, যেকোনো শান্তিচুক্তির আগে ইউক্রেনকে পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার ইচ্ছা ছাড়তে হবে। এ ছাড়া ইউক্রেনে রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে থাকা অঞ্চলগুলো থেকে সেনা সরাতে হবে। ইউক্রেনের পক্ষ থেকে ভূখণ্ড নিয়ে কোনো ছাড় দেওয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।

আরও পড়ুন

মঙ্গলবারের বৈঠকের আগে গত রোববার মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে রিয়াদে আলোচনা করেছিলেন ইউক্রেনের কর্মকর্তারা; কিন্তু সোমবার রাশিয়ার সঙ্গে বৈঠকে তাঁদের রাখা হয়নি।

গত সোমবার ট্রাম্প বলেন, যুদ্ধ বন্ধের আরও অনেক বিষয় আলোচনার টেবিলে উঠে এসেছে। তিনি বলেন, ‘আমরা এখন ভূখণ্ড ভাগাভাগি নিয়ে আলোচনা করছি। আমরা নিয়ন্ত্রণ রেখা, ক্ষমতা ও পাওয়ার প্ল্যান্টের মালিকানা নিয়ে কথা বলছি।’

হোয়াইট হাউসের পক্ষ থেকে আরও বলা হয়, সৌদি আরবে আলোচনার প্রাথমিক লক্ষ্য হলো কৃষ্ণসাগরে নৌপথ নিয়ে চুক্তি, যাতে জাহাজ চলাচল বাধাগ্রস্ত না হয়।

জাতিসংঘকে যুক্ত করতে আলোচনা

রাশিয়ান এক আলোচক মঙ্গলবার বলেছেন, ইউক্রেনে আংশিক যুদ্ধবিরতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় অন্য কয়েকটি দেশ ও জাতিসংঘকে যুক্ত করতে চায় রাশিয়া। সৌদি আরবে যুক্তরাষ্ট্র ও রুশ দল ১২ ঘণ্টা আলোচনা করার এক দিন পর গ্রেগরি কারাসিন সংবাদ সংস্থা তাসকে বলেন, ‘আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, সর্বোপরি জাতিসংঘ এবং কয়েকটি দেশকে যুক্ত করে আলোচনা চালিয়ে যাব।’

কারাসিন আরও বলেন, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে আলোচনা চ্যালেঞ্জিং থাকলেও ফলপ্রসূ হয়েছে। বাড়তি আলোচনায় জাতিসংঘ এবং অন্যান্য দেশকে যুক্ত করা হবে। তবে কোন কোন দেশকে যুক্ত করা হবে, তা প্রকাশ করেননি তিনি।

কারাসিন বলেন, অনেক সমস্যা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এ আলোচনা গঠনমূলক হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রও এতে আগ্রহী। এ নিয়ে মস্কো ও ওয়াশিংটন যৌথ বিবৃতিতে দেবে।