যুক্তরাষ্ট্র-ইউরোপ নয়, ই-কমার্সে নেতৃত্ব দেবে চীন
পশ্চিমারা নয়, চীনারাই ই-কমার্সের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। কারণ যুক্তরাষ্ট্র-ইউরোপের তুলনায় চীনের বাজার বড় ও সৃজনশীল। সেখানে ই-কমার্স শুধু প্রচলিত ধারার ই-কমার্সে আটকে নেই। ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট–এর প্রতিবেদনে উঠে এসেছে বৈশ্বিক ই-কমার্সের সেই চিত্র
এক দিকে চীন, আরেক দিকে পশ্চিমা বিশ্ব। ই-কমার্সের ভবিষ্যৎ কোন পথে? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে গত কয়েক মাসের অনলাইন কেনাকাটার ধরনের দিকে নজর দিতে হবে। মহামারিকালে অনলাইন কেনাকাটার ক্ষেত্রে যা ঘটেছে, বিশ্বে তা আগে কখনো ঘটেনি। বিশ্বের ধনী দেশগুলোর অধিকাংশ মানুষ অনলাইনে কেনাকাটায় রীতিমতো বিপ্লব ঘটিয়েছেন। আগে মানুষ শপিং মল বা স্টোরে গিয়ে যে পরিমাণ কেনাকাটা করতেন, মহামারিকালে সে চিত্র বদলে গেছে।
ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, গত এক দশকের তুলনায় গত বছরে অনলাইনে কেনাকাটায় মানুষ অর্ধেকের বেশি ব্যয় করা শুরু করেছে। বড়দিনের কেনাকাটার কথাই ধরা যাক। এবার শপিং মলে কেনাকাটার বদলে উপহার এসে পৌঁছেছে মানুষের দোরগোড়ায়।
পশ্চিমা দেশগুলোতেও ইতিমধ্যে চীনা ধাঁচের ব্যবসা মডেল দেখা যাচ্ছে। মহামারির সময়ে এই চল অনুসরণ করার হার বেড়েছে। পশ্চিমা প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবসায় বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা করছে। যার অনুপ্রেরণা চীন।
আমাজন, ওয়ালমার্টের মতো প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা অতিমানবীয় প্রচেষ্টায় অনলাইনের পণ্য মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে কাজ করেছেন। এতে বিনিয়োগকারীদের মুনাফা বেড়েছে তরতর করে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, পশ্চিমা এই ই-কমার্সের ধারা কি ভবিষ্যৎ ই-কমার্সের পথ নির্ধারণ করবে?
ইকোনমিস্টের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, পশ্চিমারা নয়, চীনারাই ই-কমার্সের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র-ইউরোপের তুলনায় চীনের বাজার বড় ও সৃজনশীল। সেখানে ই-কমার্স শুধু প্রচলিত ধারার ই-কমার্সে আটকে নেই। ই-কমার্সের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রযুক্তিসেবা, সামাজিক যোগাযোগের নেটওয়ার্কসহ নানা সেবা। এগুলোই চীনের ৮৫ কোটি ডিজিটাল গ্রাহকের জন্য কেনাকাটার বড় মাধ্যম হয়ে উঠেছে।
ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, চীনের ই-কমার্সের অগ্রগতির পাশাপাশি নিয়ন্ত্রকদের ভূমিকার দিকেও চোখ রাখতে হবে। তারা কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। এমনটাই দেখা গেছে আলিবাবার ক্ষেত্রে। আলিবাবা ও এর তারকা সহপ্রতিষ্ঠাতা জ্যাক মার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়েছে চীনে। আলিবাবার বিরুদ্ধে বিশ্বাসভঙ্গের তদন্ত শুরু করেছে চীনা কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া সহযোগী প্রতিষ্ঠান অ্যান্ট গ্রুপ থেকে এই প্রতিষ্ঠানের অনলাইন আর্থিক সেবা দেওয়া বিভাগকে আলাদা করে ফেলারও নির্দেশ দিয়েছে তারা। অথচ কয়েক সপ্তাহ আগে এটি চীনের সবচেয়ে মূল্যবান প্রতিষ্ঠান ছিল। তারা কোনো ছাড় দেয়নি।
ট্রেন্ড এখন চীনমুখী
গত ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে হালের ট্রেন্ড বা বর্তমান চলের বিষয়টি নির্ধারণে যুক্তরাষ্ট্রের দিকে চোখ রাখতে হয়েছে। কিন্তু এখন আর পশ্চিমে নয়, ট্রেন্ডের জন্য চোখ রাখতে হবে চীনের দিকে। কারণ, ই-কমার্সের ক্ষেত্রে চীনের শীর্ষে থাকার বিষয়টি একেবারে নতুন নয়। ব্যবসার আকার ধরলে ২০১৩ সালেই যুক্তরাষ্ট্রের বাজারকে ছাড়িয়েছে চীন। ডিজিটাল দুনিয়ায় লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে চীনের ই-কমার্স গ্রাহক। এখন দেশটির অনলাইনে খুচরা বিক্রির বাজার ২ লাখ কোটি মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গেছে, যা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের যোগফলের চেয়ে বেশি।
পশ্চিমা ই-কমার্স ব্যবসার চেয়ে চীনের ই-কমার্সের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। চীনা ই-কমার্সের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর গতিশীলতা। দেশটির বড় ই-কমার্সের ভিড়ে নতুন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান হিসেবে মেটুয়ান ও পিনডুয়োডুয়োর মতো প্রতিষ্ঠান উঠে এসেছে। তারা বড় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে তীব্র প্রতিযোগিতা করছে। তবে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, এখানকার প্রতিযোগিতা পশ্চিমা বিশ্বের মতো নয়। এখানকার ই-কমার্সগুলো প্রচলিত প্রযুক্তি বা ই-কমার্স ব্যবসার ধারা মানেনি। চীনা অনলাইন শপিং প্ল্যাটফর্মগুলো ডিজিটাল পেমেন্টস, গ্রুপ ডিলস, সামাজিক যোগাযোগ, গেম, ইনস্ট্যান্ট মেসেজিং, সংক্ষিপ্ত ভিডিও, লাইভ স্ট্রিমিংসহ সব সেবা এক জায়গায় এনেছে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ই-কমার্সের চীনা এ মডেল বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্য হবে কি না? কয়েক দশক ধরে সিলিকন ভ্যালির প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো চীনা উদ্যোগগুলোকে খাটো করে দেখে আসছে। নিজেদের সুরক্ষানীতির কারণেই মার্কিন ও চীনা ই-কমার্স শিল্পের মধ্যে সরাসরি সম্পর্ক খুবই কম। পশ্চিমা প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসার ধরন সহজে অনুমান করা যায়। যেমন ভিসা পেমেন্ট খাতে, আমাজন ই-কমার্স খাতে, ফেসবুক সামাজিক যোগাযোগ, গুগল সার্চে নিয়ে কাজ করছে। কিন্তু চীনের মডেল ভিন্ন। ই-কমার্স খাতে প্রচলিত রিটেইলরা কতটা অগ্রসর হবে, তার ওপর নির্ভর করছে এ খাতের সফলতা।
চীনের মডেলে ঝুঁকছে সবাই
ধনী দেশগুলোতে পশ্চিমা ই-কমার্সের ধারা চলমান থাকলেও এর বাইরে চীনা পদ্ধতিই বেশি অনুসরণ করা হচ্ছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার গ্রাব অ্যান্ড সি, ভারতের জিও, লাতিন আমেরিকা মার্কাডো লিব্রার মতো প্রতিষ্ঠান চীনা কৌশল থেকেই অনুপ্রেরণা নিয়েছে। তারা মূলত চীনের ‘সুপার অ্যাপ’ কৌশল গ্রহণ করেছে। অর্থাৎ একটি অ্যাপের মধ্যে সব ধরনের সুবিধা। এতে একটি অ্যাপের মধ্যেই নুডলস ডেলিভারি থেকে শুরু করে আর্থিক সেবাও পাওয়ার সুবিধা পাওয়া যায়।
ইকোনমিস্ট বলছে, বিভিন্ন গ্রাহক পণ্য নিয়ে কাজ করা বড় বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো চীনা ধারণাকে ব্যবসা কৌশলে রূপ দিতে পারে। যেমন বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ইউনিলিভার, এল’ওরেল, অ্যাডিডাস আমেরিকার চেয়ে এশিয়ায় বেশি আয় করে। তাই তাদের শীর্ষ কর্মকর্তারা ক্যালিফোর্নিয়া বা প্যারিসের চেয়ে এশিয়ার দিকেই বেশি ঝুঁকবেন। তাঁরা ডিজিটাল মার্কেটিং, ব্র্যান্ডিং, লজিস্টিকে এশিয়ার বাজারকেই বেশি গুরুত্ব দেবেন।
পশ্চিমা দেশগুলোতেও ইতিমধ্যে চীনা ধাঁচের ব্যবসা মডেল দেখা যাচ্ছে। মহামারির সময়ে এই চল অনুসরণ করার হার বেড়েছে। পশ্চিমা প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবসায় বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা করছে। যার অনুপ্রেরণা চীন। যেমন ফেসবুক তাদের শপিং সেবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে এবং তাদের লাইভ স্ট্রিমিং ও হোয়াটসঅ্যাপকে ব্যবসার কাজে লাগানোর সুযোগ দিচ্ছে। গত ডিসেম্বরে ওয়ালমার্ট চীনা ভিডিও অ্যাপ টিকটক প্ল্যাটফর্মে তাদের প্রথম লাইভশপিং আয়োজন করে। এটার শেয়ার কিনতেও আগ্রহী ওয়ালমার্ট। ফ্রান্সে গত প্রান্তিকে সবচেয়ে বেশি ডাউনলোড হওয়া অ্যাপের মধ্যে ষষ্ঠ অবস্থানে আছে চীনা উদ্যোক্তার তৈরি ই-কমার্স অ্যাপ ভোভা। পিনডুয়োডুয়োর প্রতিষ্ঠাতা এ অ্যাপটি তৈরি করেছেন।
চীনা মডেলে ভোক্তার লাভ
চীনা ধাঁচের ই-কমার্স ব্যবসা বাড়লে ভোক্তাদের জন্য তা ভালো হতে পারে। এতে পণ্যের দাম কমতে পারে। চীনে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতার সুফল পাচ্ছেন গ্রাহক। তাঁরা বিভিন্ন পণ্য কেনার ক্ষেত্রে ছাড় পান। এ ছাড়া ক্রেতাদের পছন্দের জায়গা তৈরি হয়। দেখা যায় নতুন নতুন উদ্ভাবন। তবে চীনা ই-কমার্স মডেল আবার একেবারে ত্রুটিহীন নয়। এরও ত্রুটি বের হতে সময় লাগবে না। পশ্চিমা ই-কমার্স দুনিয়ায় এ প্রচলন ঘটলে জালিয়াতির মতো স্বাভাবিক ঘটনা ঘটতে পারে।
তখনই নাক গলাতে হবে অ্যান্টি ট্রাস্টকে। ইতিমধ্যে আলিবাবার জ্যাক মার ক্ষেত্রে সে বিষয়টি লক্ষণীয়। চীনের অ্যান্টি ট্রাস্ট নিয়ন্ত্রকেরা প্রতিযোগিতা বাড়াতে তৎপর। এত দিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের নিয়ন্ত্রকেরা প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে প্রভাব রেখেছেন। তাঁদের এখন চীন নিয়ে গবেষণা করার সময় এসেছে। বিশেষ করে চীনা ই-কমার্স খাত কোন দিকে যাচ্ছে এবং তাদের এ ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়া দেখানোর জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
চীনের উদ্ভাবন নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের চিন্তার একটি ধারা রয়েছে। ইলেকট্রনিকস থেকে সৌর প্যানেলের মতো নানা ক্ষেত্রে চীনা নির্মাতাদের অগ্রগতিকে তারা অবহেলার চেখে দেখে অথবা নকল বলে প্রত্যাখ্যান করে। তারা এ উদ্ভাবনকে স্বীকৃতি দিতে চায় না। এরপর দেখা যায় সারা বিশ্বেই তা ধীরে ধীরে স্বীকৃতি পেতে থাকে। এখন ই-কমার্সের ক্ষেত্রে চীনা গ্রাহকদের স্বাদ ও অভ্যাস বৈশ্বিক হতে চলেছে। এটা দেখেই এখন শিখতে হবে।