চীনের ‘পান্ডা কূটনীতি’ কী, এটা কীভাবে কাজ করে
চীন-অস্ট্রেলিয়ার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে কয়েক বছর ধরেই টানাপোড়েন চলছে। সম্পর্কোন্নয়নে চলতি সপ্তাহে অস্ট্রেলিয়া সফর করেন চীনা প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াং। সফরকালে দুই দেশের সুসম্পর্ক গড়ার সদিচ্ছার প্রতীক হিসেবে পান্ডা পাঠানোর প্রস্তাব দেন চীনের প্রধানমন্ত্রী।
সম্পর্ক এতটাই তিক্ত হয়েছিল যে ২০২০ সালে অস্ট্রেলীয় কৃষিপণ্য ও খনিজের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল বেইজিং। কূটনেতিক বিরোধ ডালপালা মেলে বাণিজ্য-অর্থনীতিতেও। অস্ট্রেলিয়ার বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার চীন। সম্পর্ক উষ্ণ করার প্রক্রিয়ায় এখন ভরসা করা হচ্ছে পান্ডার ওপর।
চীনা সংস্কৃতিতে পান্ডার আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। বহু বছর ধরে চীনে পান্ডাকে ‘বন্ধুত্বের দূত’ বিবেচনা করা হয়। ফলে বিশ্বজুড়ে মিত্রতা গড়তে চীন বিভিন্ন সময় পান্ডার ওপর ভরসা করেছে, এখনো করছে।
এ জন্য বন্ধুত্ব গড়তে চাওয়া দেশগুলোকে বিভিন্ন সময় পান্ডা উপহার দিয়েছে বেইজিং। পান্ডা উপহার দিয়ে বন্ধুত্ব গড়ার এই প্রচেষ্টা চীনের ‘পান্ডা কূটনীতি’ নামে পরিচিত।
কখন পান্ডা কূটনীতির শুরু
গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের যাত্রা শুরু হয় ১৯৪৯ সালে। ওই সময় থেকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজেদের ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে পান্ডার ওপর ভরসা করতে শুরু করে দেশটি। শুভেচ্ছাদূত হিসেবে বিভিন্ন দেশের চিড়িয়াখানায় পাঠানো হয় পান্ডা। এমনকি বিদেশি চিড়িয়াখানায় নির্দিষ্ট সময়ের জন্য পান্ডা ধার দেয় চীন।
১৯৫৭ সাল, চীনে মাও সে-তুংয়ের শাসন চলছে। সোভিয়েত শাসনের সূচনাকারী অক্টোবর বিপ্লবের ৪০তম বার্ষিকীতে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নকে ‘পিং পিং’ নামে একটি পান্ডা উপহার দেন মাও সে-তুং।
সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক পাকাপোক্ত করতে ১৯৫৯ সালে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে আরও একটি পান্ডা পাঠায় চীন। ১৯৬৫ থেকে ১৯৮০ সালের মধ্যে উত্তর কোরিয়াকে পাঁচটি পান্ডা দিয়েছিল চীন।
লিং লিং ও হিসিং হিসিং—বিশ্ব রাজনীতিতে আলোচিত দুটি পান্ডার নাম। সময়টা ১৯৭২ সাল। পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের বরফ গলাতে চাইছে চীন। ঐতিহাসিক সফরে বেইজিংয়ে যান তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন। নিক্সনের সফরকে স্মরণীয় করে রাখতে ওয়াশিংটনকে এই দুটি পান্ডা উপহার দেয় বেইজিং। চীনের পররাষ্ট্রনীতিতে অন্যতম বাঁকবদলের মুহূর্ত ধরা হয় এ ঘটনাকে।
লিং লিং ও হিসিং হিসিং—বিশ্ব রাজনীতিতে আলোচিত দুটি পান্ডার নাম। সময়টা ১৯৭২ সাল। পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের বরফ গলাতে চাইছে চীন। ঐতিহাসিক সফরে বেইজিংয়ে যান তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন। নিক্সনের সফরকে স্মরণীয় করে রাখতে ওয়াশিংটনকে এই দুটি পান্ডা উপহার দেয় বেইজিং। চীনের পররাষ্ট্রনীতিতে অন্যতম বাঁকবদলের মুহূর্ত ধরা হয় এ ঘটনাকে।
এর পর থেকে জাপান, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, স্পেনসহ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশকে ‘বন্ধুত্বের নিদর্শন’ হিসেবে পান্ডা দিয়েছে বেইজিং।
উপহারের পরিবর্তে ধার
একটা সময়ে চীনে পান্ডার সংখ্যা দ্রুত কমতে শুরু করে। এর জেরে পান্ডা কূটনীতিতে লাগাম টানতে বাধ্য হয় দেশটি।
১৯৮৪ সাল থেকে বন্ধুদেশগুলোকে পান্ডা উপহার দেওয়া বন্ধ করে বেইজিং। এর বদলে বিদেশি চিড়িয়াখানাগুলোকে পান্ডা ধার দেওয়া হয়। বিনিময়ে বছরপ্রতি ১০ লাখ ডলার পর্যন্ত ফি নেওয়া হয়। ১০ বছরের নির্দিষ্ট সময়সীমা পেরোলে ফেরত নেওয়া হয় সেসব পান্ডা।
পান্ডা লালন–পালন চিড়িয়াখানাগুলোর জন্য বেশ ব্যয়বহুল। তাই চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ দর্শনীর বিনিময়ে পান্ডার প্রদর্শনী করে। এর মধ্য দিয়ে আয় করার চেষ্টা করে।
নির্ধারিত সময়সীমা শেষে বা চুক্তি শেষ হলে বিদেশি চিড়িয়াখানায় থাকা পান্ডা চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ফিরিয়ে আনা হয়। এমনকি বিদেশের চিড়িয়াখানায় থাকা অবস্থায় জন্ম নেওয়া দুই থেকে চার বছর বয়সী শাবকও চীনে আনা হয়। যুক্ত করা হয় চীনের পান্ডা প্রজনন কর্মসূচিতে।
পান্ডা কূটনীতি যেভাবে কাজ করে
বিভিন্ন সময় চীন তার ব্যবসায়িক অংশীদারদের পুরস্কৃত করতেও পান্ডা উপহার দিয়েছে। ২০২৩ সালে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, এর আগে কানাডা, ফ্রান্স ও অস্ট্রেলিয়ায় পান্ডা পাঠানোর মধ্য দিয়ে ইউরেনিয়াম চুক্তি থেকে শুরু করে বিভিন্ন বাণিজ্য চুক্তির পথ সুগম করে নিয়েছে বেইজিং।
এ ছাড়া সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের সঙ্গে চীনের পান্ডা দেওয়ার চুক্তিকে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ বলছেন বিশ্লেষকদের অনেকেই। কখনো কখনো কোনো দেশের প্রতি চীনাদের গোস্যা প্রকাশের জন্য কিংবা সম্পর্কে টানাপোড়েনের প্রকাশ হিসেবে পান্ডা ব্যবহারের ঘটনা ঘটেছে।
কখনো কখনো কোনো দেশের প্রতি চীনাদের গোস্যা প্রকাশের জন্য কিংবা সম্পর্কে টানাপোড়েনের প্রকাশ হিসেবে পান্ডা ব্যবহার করার ঘটনা ঘটেছে। ২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে দুটি পান্ডা ফিরিয়ে নেয় চীন। এই দুটির নাম তাই শান ও মেই লান। ওই সময় তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তিব্বতের ধর্মীয় নেতা দালাই লামার সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। এ বৈঠক নিয়ে চীন আগে থেকেই উদ্বেগ জানিয়ে আসছিল। কর্ণপাত করেননি ওবামা। বৈঠকের জেরে দুটি পান্ডাকে প্রত্যাহার করে নেয় বেইজিং।
২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে দুটি পান্ডা ফিরিয়ে নেয় চীন। এই দুটির নাম তাই শান ও মেই লান। মার্কিন ভূখণ্ডে চীনা পান্ডার ঘরে তাই শান ও মেই লানের জন্ম।
ওই সময় তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তিব্বতের ধর্মীয় নেতা দালাই লামার সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। এ বৈঠক নিয়ে চীন আগে থেকেই উদ্বেগ জানিয়েছিল। কর্ণপাত করেননি ওবামা। বৈঠকের জেরে দুটি পান্ডাকে ফিরিয়ে নেয় বেইজিং।
আরেকটি পান্ডা শাবককে (নাম ইয়া ইয়া) ২০ বছরের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে ধার দিয়েছিল চীন। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে শীতলতার জেরে ২০২৩ সালের এপ্রিলে ইয়া ইয়াকে ফেরত আনা হয়। চীনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পশুপ্রেমী অনেকের অভিযোগ, টেনেসির চিড়িয়াখানায় পান্ডাটির যথাযথ যত্ন নেওয়া হতো না।
গত বছরের নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আরও তিনটি পান্ডা ফিরিয়ে নেয় চীন। এখন মার্কিন মুলুকে মাত্র চারটি চীনা পান্ডা আছে। ওই সময় চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ইঙ্গিত দেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রে আরও পান্ডা পাঠাতে প্রস্তুত আছেন।
মার্কিন কর্তৃপক্ষ গত মাসে জানায়, চীনের কাছ থেকে এক জোড়া জায়ান্ট পান্ডা পাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এই জোড়া পান্ডাকে ওয়াশিংটনের স্মিথসোনিয়ান জাতীয় চিড়িয়াখানায় রাখা হবে। চলতি বছরের শেষ নাগাদ ‘বাও লি’ ও ‘কিনং বাও’ নামে দুটি পান্ডা যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানীতে পৌঁছানোর কথা রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ফার্স্ট লেডি জিল বাইডেন এক ভিডিও বার্তায় চীনের কাছ থেকে এই দুটি জায়ান্ট পান্ডা পাওয়ার কথা ঘোষণা দিয়ে বলেন, এটি একটি ‘ঐতিহাসিক মুহূর্ত’।
চীনের পক্ষ থেকে এর অর্থ হলো, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে দেশটি নিজেদের আরও উন্মুক্ত করছে।
পান্ডা কি এখনো বিপন্ন
চীনের অভ্যন্তরীণ সংরক্ষণ কর্মসূচি বলছে, দেশটিতে পান্ডা এখন আর বিপন্ন নয়। তাই পান্ডার নাম বিপন্নের তালিকা থেকে অরক্ষিত বা ঝুঁকিতে থাকা প্রাণীর তালিকায় উন্নীত করা হয়েছে।
গত শতকের আশির দশকে চীনে বন্য জায়ান্ট পান্ডার সংখ্যা ছিল প্রায় ১ হাজার ১০০। গত বছর এ সংখ্যা ১ হাজার ৯০০–তে উন্নীত হয়েছে।
এ ছাড়া বর্তমানে বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন চিড়িয়াখানা ও প্রজননকেন্দ্রে ৭২৮টি পান্ডা রয়েছে।