ঐতিহাসিক জনসংখ্যাগত পরিবর্তনের মুখে চীন, সংকট বাড়িয়েছে করোনা
করোনার ‘উৎপত্তিস্থল’ চীনে ভাইরাসটির সংক্রমণের বিস্তার ঠেকাতে গত তিন বছর কঠোর বিধিনিষেধ জারি ছিল। বছরের পর পর এ বিধিনিষেধে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে দেশটির মানুষ। মানুষের জীবন নিয়ে তৈরি হয় অনিশ্চয়তা। করোনার কারণে অনিশ্চয়তার মুখে পড়া এমনই একজন ঝ্যাং কি। সাংহাইভিত্তিক একটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা তিনি। এই অনিশ্চয়তার মধ্যে সন্তান না নেওয়ার কথা ভেবেছিলেন ঝ্যাং।
তবে শুধু চীনই নয়, বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল ১০টি দেশের ৯টিতেই সন্তান জন্মদানের হার কমেছে। ২০২২ সালে চীনে এই হার ছিল ১ দশমিক ১৮ শতাংশ। দেশটির ইতিহাসে এই জন্মহার ছিল সবচেয়ে কম।
এরই মধ্যে গত বছরের শেষে এসে ‘শূন্য কোভিড নীতি’ থেকে সরে দাঁড়ায় চীন সরকার। এতে হঠাৎ করেই দেশটিতে করোনা সংক্রমণ বাড়তে থাকে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে হাসপাতালগুলোতেও রোগীদের ঠাঁই হচ্ছে না। পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ তা বোঝা যায় সম্প্রতি চীন সরকারের প্রকাশ করা কোভিডে মৃত্যুর পরিসংখ্যান থেকে।
সরকারি হিসাব বলছে, গত ৮ ডিসেম্বর থেকে ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশটিতে করোনায় প্রায় ৬০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
চীনের হাসপাতালগুলোতে করোনা রোগীর চাপে মা ও শিশুরাও চিকিৎসা নিতে চরম ভোগান্তিতে পড়ছে। এসব ঘটনা ঝ্যাং কির সন্তান নেওয়া—না নেওয়ার সিদ্ধান্তে বড় প্রভাব ফেলেছে। ৩১ বছর বয়সী ঝ্যাং বলেন, ‘শুনেছি সরকারি হাসপাতালগুলোতে সন্তানের জন্মদান ভয়াবহ একটি ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সব মিলিয়ে সন্তান নেব না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
শিশুর জন্মহার কমার মধ্য দিয়ে চীন জনসংখ্যা কমার একটি দীর্ঘ ও অপরিবর্তনীয় প্রক্রিয়ার মধ্যে ঢুকে পড়েছে। এটা চীন—এমনকি বিশ্বের ইতিহাসেও প্রথম। আগামী ৮০ বছরের কম সময়ে চীনের জনসংখ্যা ৪৫ শতাংশ কমতে পারে। ফলে সে সময় নতুন এক চীনকে দেখবে বিশ্ব।ওয়াং ফেং, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক
শুধু ঝ্যাংই নয়, করোনার কারণে সন্তান নেওয়ার বিষয়ে চীনের অনেক নাগরিকই তাঁদের সিদ্ধান্ত বদলেছেন। ফলে এর যে নেতিবাচক প্রভাব দেশটির জনসংখ্যার ওপর পড়েছে তা হয়তো ১৭ জানুয়ারি প্রকাশ পাবে। সেদিন ২০২২ সালে চীনের জনসংখ্যার বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরবে দেশটির সরকার। অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করছেন, ওই তথ্য প্রকাশিত হলে দেখা যাবে ২০২২ সালে চীনের জনসংখ্যা কমেছে। এর আগে ১৯৬১ সালে দেশটিতে মহা দুর্ভিক্ষের সময় জনসংখ্যা কমার ঘটনা ঘটেছিল।
ধারণা করা হচ্ছে, ২০২২ সালে চীনে শিশুর জন্ম রেকর্ড পরিমাণ কমেছে। গত বছরে দেশটিতে ১ কোটির কম শিশুর জন্ম হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। ২০২১ সালে চীনে ১ কোটি ৬০ লাখ শিশুর জন্ম হয়েছিল। এই সংখ্যাটাও ২০২০ সালের চেয়ে ১১ দশমিক ৫ শতাংশ কম। অর্থাৎ সন্তান জন্ম নেওয়ার হার দ্রুত কমছে। চীনের এই পরিস্থিতি বৈশ্বিক অর্থনীতি ও বিশ্বব্যবস্থায় বড় প্রভাব ফেলবে।
বিষয়টি নিয়ে কথা বলছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক ওয়াং ফেং। তাঁর ভাষ্যমতে, শিশুর জন্মহার কমার মধ্য দিয়ে চীন জনসংখ্যা কমার একটি দীর্ঘ ও অপরিবর্তনীয় প্রক্রিয়ার মধ্যে ঢুকে পড়েছে।
এটা চীন—এমনকি বিশ্বের ইতিহাসেও প্রথম। আগামী ৮০ বছরের কম সময়ে চীনের জনসংখ্যা ৪৫ শতাংশ কমতে পারে। ফলে সে সময় নতুন এক চীনকে দেখবে বিশ্ব।
২০২১ সালে চীনের জনসংখ্যা মাত্র ৪ লাখ ৮০ হাজার বেড়েছিল। সে বছর দেশটির জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ১৪১ কোটি ২৬ লাখে। জাতিসংঘের অনুমান বলছে, চলতি বছর থেকে চীনের জনসংখ্যা কমতে শুরু করবে। ফলে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যার দেশ হিসেবে শীর্ষ স্থান হারাবে। আর চলতি বছরেই চীনকে ছাড়িয়ে এই স্থান দখল করে নেবে ভারত।
তবে শুধু চীনই নয়, বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল ১০টি দেশের ৯টিতেই সন্তান জন্মদানের হার কমেছে। ২০২২ সালে চীনে এই হার ছিল ১ দশমিক ১৮ শতাংশ। দেশটির ইতিহাসে এই জন্মহার ছিল সবচেয়ে কম। অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থার (ওইসিডি) মান অনুযায়ী, একটি দেশের জনসংখ্যা স্থিতিশীল রাখতে জন্মহার ২ দশমিক ১ শতাংশ হতে হবে।
জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করতে ১৯৮০ সালে ‘এক সন্তান নীতি’ নেয় চীন। ২০১৫ সাল পর্যন্ত তা বলবৎ ছিল। তবে সেই চীন গত বছর আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করছে যে তাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার অনেকটা কমে গেছে। চীনের জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশনও বলছে, ২০২৫ সালের আগেই দেশের জনসংখ্যা কমতে শুরু করবে। এ পরিস্থিতিতে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং জানিয়েছিলেন, জন্মহার বাড়ানোর জন্য তাঁর সরকার নতুন নীতি প্রণয়ন করার কথা ভাবছে।
জনসংখ্যাবিদ সি ফুশিয়ানের ধারণা, ২০৫০ সালের মধ্যে চীনে ৬৫ বছর বা এরও বেশি বয়সী মানুষ মোট জনসংখ্যার ৩৭ শতাংশে গিয়ে ঠেকবে। অথচ ২০২২ সালেই এই হার ছিল ১৪ শতাংশ এবং ১৯৮০ সালে একই হার ছিল মাত্র ৫ শতাংশ।
প্রতিকূল পরিস্থিতি
জন্মহার বাড়ানোর জন্য ২০২১ সাল থেকে পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে চীন সরকার। সন্তান বেশি নিতে উৎসাহী করার জন্য করহার কমানো, মাতৃত্বকালীন ছুটির সময় বাড়ানো, স্বাস্থ্যবিমায় সুবিধা বাড়ানো, বাড়ি কেনা ও নির্মাণে প্রণোদনাসহ বিভিন্ন সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। তবে এসব পদক্ষেপের প্রভাব এখনো পড়তে শুরু করেনি।
শিশুদের বহনের জন্য বিশেষ গাড়ি (বেবি স্ট্রোলার) নিয়ে চীনের সার্চ ইঞ্জিন বাইডুতে মানুষের খোঁজখবর নেওয়ার ঘটনা ২০২২ সালে ১৭ শতাংশ কমেছে। ২০১৮ সালের তুলনায় এই কমার হার ৪১ শতাংশ। একই সময়ে শিশুদের খাওয়ানোর কাজে ব্যবহৃত বোতল নিয়ে খোঁজখবর নেওয়া এক–তৃতীয়াংশ কমেছে। পক্ষান্তরে, বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে খোঁজখবর নেওয়া আগের বছরের তুলনায় আট গুণ বেড়েছে।
এদিকে ভারতের চিত্র আবার উল্টো। দেশটি যে জনসংখ্যায় চীনকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে, তার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। গুগলের হিসাবে দেখা যাচ্ছে, ২০২২ সালে ভারতে শিশুদের জন্য বোতল নিয়ে গুগলে খোঁজখবর করার হার আগের বছরের চেয়ে ১৫ শতাংশ বেড়েছে। এ ছাড়া শিশুদের বিছানা নিয়ে খোঁজ প্রায় পাঁচ গুণ বেড়েছে।
চলতি মাসে ইউওয়া পপুলেশন রিসার্চ নামে চীনের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বলেছে, সন্তানের শিক্ষার ব্যয়ের চাপ, কলেজে ভর্তির জন্য পরীক্ষা দিতে ভয়াবহ ধরনের চাপ এবং তিন বছরের কম বয়সী শিশুদের নার্সারিতে ভর্তির হার মাত্র ৫ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে আসা চীনে জন্মহার কমানোর ক্ষেত্রে বড় প্রভাব ফেলেছে।
চীনে বয়স্ক মানুষের দেশে পরিণত হওয়ার অর্থনৈতিক প্রভাবও উল্লেখযোগ্য হবে। জনসংখ্যাবিদ সি ফুশিয়ানের ধারণা, ২০৫০ সালের মধ্যে চীনে ৬৫ বছর বা এরও বেশি বয়সী মানুষ মোট জনসংখ্যার ৩৭ শতাংশে গিয়ে ঠেকবে। অথচ ২০২২ সালেই এই হার ছিল ১৪ শতাংশ এবং ১৯৮০ সালে একই হার ছিল মাত্র ৫ শতাংশ।
সি ফুশিয়ান বলেন, ‘বয়স্ক মানুষের সংখ্যা দ্রুত বাড়লে চীনের অর্থনীতির গতি ধীর হবে, রাজস্ব কমবে, বাড়বে ঋণ। চীন ধনী হওয়ার আগেই বুড়ো হয়ে যাচ্ছে।’