ফিরে দেখা ২০২৪
বিশ্বে জল-স্থল-আকাশে ভয়াবহ যত দুর্ঘটনা
দেখতে দেখতে আরেকটি বছর শেষ হয়ে যাচ্ছে। নির্বাচন, মূল্যস্ফীতি আর যুদ্ধের বছর ছিল ২০২৪। এ বছর বিশ্বের নানা প্রান্তে ঘটে যাওয়া বিশেষ বিশেষ ঘটনা নিয়ে পাঠকদের জন্য আমাদের বিশেষ আয়োজন।
২০২৪ সালে বেশ কয়েকটি বড় বড় উড়োজাহাজ, নৌকা, ট্রেন ও গাড়ি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এর কোনো কোনোটি ছিল অনেক বেশি প্রাণঘাতী। ২০২৪ সালের শুরুতেই বিশ্বে বড় ধরনের উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। একেবারে শেষ ভাগে এসে বছরের সবচেয়ে প্রাণঘাতী উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনাটি ঘটেছে।
শুরুতেই বিদায়ী বছরের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনার দিকে ফিরে দেখা যাক।
জাপান এয়ারলাইনস
২০২৪ সালের জানুয়ারিতে জাপান এয়ারলাইনসের ফ্লাইট ৫১৬ উড়োজাহাজের সঙ্গে জাপানি কোস্ট গার্ডের একটি উড়োজাহাজের সংঘর্ষ হয়। অবতরণের সময় টোকিও বিমানবন্দরের রানওয়েতে এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় পাঁচজন নিহত হন। তবে জাপান এয়ারলাইনসের উড়োজাহাজটির ৩৭৯ যাত্রী ও ক্রু সদস্য প্রাণে বেঁচে যান।
একই মাসে আলাস্কা এয়ারলাইনসের পরিচালনাধীন একটি বোয়িং ৭৩৭ ম্যাক্স ৯ উড়োজাহাজ অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিল। উড়োজাহাজটি ১৭১ জন যাত্রী ও ৬ জন ক্রু নিয়ে ওরেগন থেকে ক্যালিফোর্নিয়ার দিকে যাচ্ছিল। মাঝ আকাশে এর একটি অংশ (ডোর প্লাগ) ভেঙে পড়লে উড়োজাহাজটি জরুরি অবতরণ করে। তবে এ ঘটনায় কেউ নিহত হননি।
রাশিয়ার সামরিক উড়োজাহাজ
২০২৪ সালের জানুয়ারিতে বেলগোরোদের কাছে রাশিয়ার একটি সামরিক উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়। ওই উড়োজাহাজে করে ইউক্রেনীয় যুদ্ধবন্দীদের নেওয়া হচ্ছিল। এতে উড়োজাহাজটিতে থাকা ৭৪ আরোহীর সবাই নিহত হন। এর মধ্যে ৬৫ জন ইউক্রেনীয় সেনা এবং ৬ জন ক্রু সদস্য। ঘটনার পর রাশিয়া অভিযোগ করেছিল, ইউক্রেনই ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে উড়োজাহাজটিকে ভূপাতিত করেছে।
সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনস টারবুলেন্স
২০২৪ সালের মে মাসে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসের একটি বোয়িং ৭৭৭ উড়োজাহাজকে মাঝ আকাশে প্রতিকূল আবহাওয়ার (টারবুলেন্স) মুখোমুখি হতে হয়েছে। এতে উড়োজাহাজটির যাত্রীরা প্রচণ্ড ঝাঁকুনির কবলে পড়েন। সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসের পাইলটদের যেসব মারাত্মক ধরনের ঝাঁকুনির টারবুলেন্সের শিকার হওয়ার অভিজ্ঞতা আছে, তার একটি এটি। এ ঘটনায় এক ব্যক্তি হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। ৪০ জন গুরুতর আহত হন।
সৌর্য এয়ারলাইনস
২৪ জুলাই ২০২৪। নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়নের কিছুক্ষণ পরই সৌর্য এয়ারলাইনসের একটি উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়। ছোট আকারের এ উড়োজাহাজে ৩ জন ক্রু সদস্যসহ ১৯ জন আরোহী ছিলেন। এর মধ্যে ১৮ জনই নিহত হন। শুধু উড়োজাহাজটির পাইলট প্রাণে বেঁচে যান। তবে গুরুতর আহত ওই পাইলট উদ্ধার হওয়ার আগপর্যন্ত উড়োজাহাজটির অবস্থা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানাতে পেরেছিলেন।
ভোয়েপাস এয়ারলাইনস
চলতি বছরের ৯ আগস্ট ব্রাজিলে একটি উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়ে ৬২ আরোহী নিহত হন। ব্রাজিলের ভোয়েপাস এয়ারলাইনস পরিচালিত এটিআর-৭২ উড়োজাহাজটি ক্যাসক্যাভেল থেকে গুয়ারুলহোসে যাওয়ার সময় সাও পাওলোর ভিনহেদো এলাকার কাছে এটি বিধ্বস্ত হয়। উড়োজাহাজটি বিধ্বস্ত হওয়ার পরপরই এতে আগুন ধরে যায়। আরোহীদের মধ্যে ৫৮ জন ছিলেন যাত্রী এবং ৪ জন ক্রু সদস্য। এ ঘটনায় আরোহীদের সবাই নিহত যান। আরোহীরা আগুনে পুড়ে যাওয়ার কারণে তাঁদের পরিচয় শনাক্ত করার কাজটি কঠিন হয়ে পড়ে।
আজারবাইজান এয়ারলাইনস
বছরের শেষ ভাগে এসে বড় দুটি উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এর একটি ঘটেছে গত ২৫ ডিসেম্বর। এদিন মাঝ আকাশে কারিগরি ত্রুটি দেখা দেওয়ার পর আজারবাইজান এয়ারলাইনসের ফ্লাইট ৮৪৩২ কাজাখস্তানের আকতাউ এলাকার কাছে জরুরি অবতরণের সময় বিধ্বস্ত হয়। ফকার ১০০ উড়োজাহাজটিতে ৬৭ জন আরোহী ছিলেন। তাঁদের মধ্যে ৩৭ জন নিহত হন। আহত হন ২৯ জন।
পরে তদন্তে জানা যায়, চেচনিয়ায় যাওয়ার পথে রাশিয়ার একটি ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে উড়োজাহাজটি ভূপাতিত হয়েছে। উড়োজাহাজটি বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় ব্যাপক ক্ষোভ তৈরি হয়। একে কেন্দ্র করে সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলগুলোর আকাশসীমায় উড়োজাহাজ চলাচল–সংক্রান্ত বিধিনিষেধ জোরদার করার দাবি উঠেছে।
জেজু এয়ার
বছরের সবচেয়ে প্রাণঘাতী উড়োজাহাজ বিধ্বস্তের ঘটনাটি ঘটেছে গত ২৯ ডিসেম্বর। এদিন জেজু এয়ারের পরিচালনাধীন একটি ৭৩৭-৮০০ উড়োজাহাজ ১৭৫ যাত্রী, ৬ ক্রুসহ মোট ১৮১ আরোহী নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ায় বিধ্বস্ত হয়। দুই ক্রু জীবিত উদ্ধার হলেও অন্যরা নিহত হয়েছেন। উড়োজাহাজটির গন্তব্য ছিল ব্যাংকক থেকে দক্ষিণ কোরিয়ার মুয়ান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। দক্ষিণ কোরিয়ার স্থানীয় সময় সকাল ৯টার কিছু সময় পর উড়োজাহাজটি মুয়ান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণের সময় রানওয়েতে বিধ্বস্ত হয়। দক্ষিণ কোরিয়ায় হওয়া সবচেয়ে প্রাণঘাতী উড়োজাহাজ বিধ্বস্তের ঘটনাগুলোর একটি এটি।
ঠিক কী কারণে উড়োজাহাজটি বিধ্বস্ত হয়েছে, তা এখনো নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। তবে ধারণা করা হচ্ছে, পাখির আঘাতে উড়োজাহাজের ল্যান্ডিং গিয়ার অকার্যকর হয়ে পড়েছিল।
নৌকাডুবি
বিদায়ী বছরে বেশ কয়েকটি বড় নৌকাডুবির ঘটনা ঘটেছে। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিউনিসিয়ার উপকূলে ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। ওই নৌকায় প্রায় ৫২ জন অভিবাসনপ্রত্যাশী ছিলেন। তাঁরা ভূমধ্যসাগর হয়ে ইউরোপে যাচ্ছিলেন। সাগরপথে লিবিয়া হয়ে এই ব্যক্তিরা ইউরোপে যাচ্ছিলেন। ১৫ ফেব্রুয়ারি নৌকায় অগ্নিকাণ্ডে প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। মৃতদের ৯ জনের মধ্যে ৮ জনই বাংলাদেশি। নিহত অন্যজন পাকিস্তানের নাগরিক।
এ বছরের জুনে কঙ্গো প্রজাতন্ত্রে একটি নৌকা ডুবে ৮০ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। মাই-এনডোম্বে প্রদেশের মুশি শহর থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরের কোয়া নদীতে এ দুর্ঘটনা ঘটে।
গত ১ জুলাই মৌরিতানিয়ার এনডিয়াগো শহর থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে আটলান্টিক মহাসাগরে মাছ ধরার বড় একটি নৌকা ডুবে যায়। পরে অভিযান চালিয়ে ওই নৌকায় থাকা ৮৯ জনের মরদেহ উদ্ধার করেন দেশটির কোস্টগার্ডের সদস্যরা। মৌরিতানিয়ার স্থানীয় প্রশাসন ও রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা তখন জানিয়েছিল, নৌকার আরোহীরা অবৈধভাবে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন।
বছরের শেষ ভাগে এসে গত ১৯ ডিসেম্বর আরেকটি বড় নৌকাডুবির ঘটনা ঘটেছে। এদিন মরক্কো উপকূলে নৌকা ডুবে কমপক্ষে ৬৯ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানায় মালি কর্তৃপক্ষ। নৌকার আরোহীদের ২৫ জন মালির নাগরিক। নৌকাটি পশ্চিম আফ্রিকা থেকে স্পেনের ক্যানারি দ্বীপের দিকে যাচ্ছিল। নৌকায় ৮০ জন যাত্রী ছিলেন।
ট্রেন দুর্ঘটনা
২০২৪ সালের জুনে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে যাত্রীবাহী ট্রেন কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের সঙ্গে একটি মালবাহী ট্রেনের সংঘর্ষে ১৫ জন নিহত হন। আহত হন আরও বেশ কয়েকজন।
সেপ্টেম্বরে মিসরের কায়রোতে দুটি যাত্রীবাহী ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এ ঘটনায় ৩ জন নিহত ও ২৯ জন আহত হন।
অক্টোবরে ওয়েলসে দুটি ট্রেনের সংঘর্ষের ঘটনায় একজন নিহত হন এবং আহত হন ৪ জন।
সড়ক দুর্ঘটনা
২১ আগস্ট ইরানের মধ্যাঞ্চলীয় প্রদেশ ইয়াজদে একটি বাস উল্টে ২৮ জন নিহত হন। আহত হন ২৩ জন। ইরানের ট্রাফিক পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। ওই সময় মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দৌহিত্র ইমাম হোসেন বিন আলী (রা.)-এর শাহাদাতবার্ষিকীর ৪০তম দিবস উপলক্ষে লাখো শিয়া মুসল্লি ইরাকের কারবালায় জড়ো হচ্ছিলেন। এই বাসে পাকিস্তানিরাও সেখানে যাচ্ছিলেন।
৪ নভেম্বর ভারতের উত্তরাখন্ড রাজ্যে একটি যাত্রীবাহী বাস খাদে পড়ে অন্তত ৩৬ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অনেকে। উত্তরাখন্ডের আলমোড়া জেলায় একটি পাহাড়ি এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে।
২৪ নভেম্বর ব্রাজিলের আলাগোয়াস রাজ্যে একটি যাত্রীবাহী বাস খাদে পড়ে ২৩ জন নিহত হন। রাজ্যের ইউনিয়াও দোস পালমারেস শহরের কাছে দুর্গম একটি পার্বত্য সড়কে এ দুর্ঘটনা ঘটে।
২১ ডিসেম্বর ব্রাজিলে এক বাস দুর্ঘটনায় অন্তত ৩৮ জন নিহত হয়েছেন। স্থানীয় সময় ভোরে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মিনা জেরাইসে মহাসড়কে এ দুর্ঘটনা ঘটে। স্থানীয় পুলিশের ভাষ্যমতে, দেশটির মহাসড়কগুলোয় ২০০৭ সালের পর এত বড় দুর্ঘটনা ঘটেনি।
বছরের একেবারে শেষে এসে বিশ্বে ২৯ ডিসেম্বর বড় একটি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এদিন আফ্রিকার দেশ ইথিওপিয়ায় যাত্রীবোঝাই একটি ট্রাক নদীতে পড়ে অন্তত ৬০ জন নিহত হন। দেশটির রাষ্ট্রায়ত্ত সম্প্রচারমাধ্যম ইবিসি জানিয়েছে, এ সড়ক দুর্ঘটনার শিকার মানুষেরা একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাচ্ছিলেন।
তথ্যসূত্র: ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস, দ্য টেলিগ্রাফ ইন্ডিয়া, এএফপি, আল–জাজিরা, রয়টার্স, সিএনএন