লড়াই এবার দুই জাটের প্রবীণ ও নবীনে

অজিত সিং ও সঞ্জীব বালিয়ান
অজিত সিং ও সঞ্জীব বালিয়ান
>

• উত্তর প্রদেশের মুজফফরনগর
• বিরোধী ঐক্যের অজিত সিংকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে বিজেপির সঞ্জীব বালিয়ানকে 

জানি না, উত্তর প্রদেশের এই পশ্চিম প্রান্তের লোকসভা বা বিধানসভার ভোট এখনো আরও কত বছর মুজফফরনগরময় হয়ে থাকবে।

৬ বছর আগে ২০১৩ সালের আগস্ট–সেপ্টেম্বর মাসে মুজফফরনগরে হিন্দু জাটদের সঙ্গে মুসলমানদের যে দাঙ্গা বেধেছিল, যার আগুন আশপাশের জেলাগুলোতেও ছড়িয়ে পড়েছিল, তাতে সরকারি হিসাবে মৃত্যু হয়েছিল ৬২ জনের। আহত প্রায় এক শ। আর ঘরছাড়া হয়েছিল ৫০ হাজারের বেশি মানুষ। এমন নয় যে ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ওটাই প্রথম। অগুনতি দাঙ্গা বছর বছর উত্তর প্রদেশে ঘটে। কিন্তু কেন যেন আজও পশ্চিম উত্তর প্রদেশে যেকোনো জেলার যেকোনো ভোটে মুজফফরনগরের দাঙ্গাই প্রধান ইস্যু। এবারেও তার নড়নচড়ন হচ্ছে না।

দাঙ্গার সেই আবহে এবারের অন্য চমক বিরোধী ঐক্য। সমাজবাদী পার্টি ও বহুজন সমাজ পার্টি একজোট হয়ে এই কেন্দ্রে প্রার্থী করেছে জোটের তৃতীয় সঙ্গী রাষ্ট্রীয় লোকদলের নেতা অজিত সিংকে। ৮০ বছরের এই জাট নেতার মোকাবিলা করতে হচ্ছে বিজেপির ঘরের ছেলে ৪৬ বছরের ডাকাবুকো নেতা সঞ্জীব বালিয়ানের, যিনি আগেরবার চার লাখ ভোটের ব্যবধানে জিতে লোকসভায় এসে নরেন্দ্র মোদির মন্ত্রিসভায় জায়গা পেয়েছিলেন।

এবারের লড়াই তাই বয়স্ক জাট বনাম নবীন জাটের। যদিও বিজেপির কথায়, তাদের জাট প্রার্থী এই জেলার ভূমিপুত্র, অন্য জাট ‘বহিরাগত’।

ভূমিপুত্র সঞ্জীব বালিয়ান ডাকাবুকো না হলে এমন বিতর্কিতও হতেন না। মুজফফরনগরের দাঙ্গায় তাঁর নাম বহু উচ্চারিত ও প্রচারিত। উত্তেজনা ছড়ানো, প্ররোচনা দেওয়া এবং অন্য বহু ধারায় তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল। আত্মসমর্পণ করে জামিনও নিতে হয়েছিল সঞ্জীবকে। জাট ও মুসলমানের মধ্যে ওই দাঙ্গায় সঞ্জীবের নাম ছড়িয়ে পড়ে দ্রুত। ক্রমেই তিনি হয়ে ওঠেন ওই তল্লাটের জাটদের রক্ষাকর্তা। মুজফফরনগরের মহাবীর চকে বিশাল নির্বাচনী কার্যালয়ে বসে তাঁর ভোট তদারকি কর্তা সত্য পাল তাই বলতে পারেন, জেলার জাট জনতা সঞ্জীবকে আঁকড়ে ধরে আছে ছয় বছর ধরে। মুসলমানদের হাত থেকে জাটদের জীবন ও সম্মান রক্ষা করেছেন তিনিই। জাট হলেও একটি ভোটও তাই বহিরাগত অজিত সিংয়ের দিকে যাবে না।

দাবি কতটা সত্য কতটা মিথ্যা, তা বোঝা যাবে ফল গণনার পর। তবে বিজেপি নেতারা মনে করিয়ে দিতে ছাড়ছেন না যে মুজফফরনগর বহিরাগত জাট চরণ সিংকেও রেয়াত করেনি। ১৯৬৮ সালে চরণ সিং এখানে জিততে পারেননি। পুত্র অজিতও পারবেন না।

পারবেন কি না, সেটা পরের কথা, কেন্দ্র ঘুরে দেখছি, বিজেপির প্রচারে স্থানীয় আশা–আকাঙ্ক্ষা ছাপিয়ে উপছে উঠছে একটিই বিষয়, নিরাপত্তা। সেই নিরাপত্তার দুটি দিক। একটি স্থানীয়। কেন্দ্রের মানুষদের মানসম্মান ও জীবন রক্ষা। অন্যটি দেশের নিরাপত্তা। দ্বিতীয় এই প্রশ্নে বড় হয়ে উঠেছেন নরেন্দ্র মোদি। বালাকোট, সার্জিক্যাল স্ট্রাইক, পাকিস্তানকে ‘উচিত শিক্ষা’ দেওয়ার মতো বিষয়গুলো। বিজেপি প্রচার করছে মোদির ‘দেশপ্রেম’, তাঁর ‘নির্ভীকতা’, এবং ‘নিঃস্বার্থ ত্যাগ’।

বিরোধীরা এসবের ধারে–কাছে দিয়েও হাঁটছে না। শহর থেকে বিশ মাইল দূরে পূর্ব বালিয়ান গ্রামের জনসভায় অজিত সিং জোর দিলেন স্রেফ দুটি বিষয়ের ওপর। প্রথমটা চিনিকলের কাছে চাষিদের বকেয়া আখের দাম মেটানোর প্রতিশ্রুতি, অন্যটা রাজ্যের স্বার্থে বিরোধী ঐক্যকে জোরদার করা। আখের বকেয়া দাম জমে যাওয়া চাষিদের কাছে সমস্যা ঠিকই, কিন্তু সেই সমস্যা স্থানীয় চাষিরা মৌসুমি সর্দি–কাশি–জ্বরজ্বালার মতো মেনেও নিয়েছেন। অজিত সিং মানুষকে বোঝাচ্ছেন, বিরোধীদের এ ঐক্য জোরদার রাখার অর্থ সব সম্প্রদায় ও জাতের উন্নয়ন। বিজেপির মতো ‘একপেশে’ বিকাশ নয়।

আখচাষিদের সমস্যাটা বহুজন সমাজ পার্টির স্থানীয় নেতা সামসাদ আহমেদ ব্যাখ্যা করলেন এভাবে। আখের ন্যূনতম সংগ্রহমূল্য কেন্দ্রীয় সরকার বেঁধে দেয় প্রতিবছর। সেই দামের ওপর আরও কিছুটা বাড়িয়ে দেয় রাজ্য সরকার। এদিকে চিনির সর্বোচ্চ দামও সরকার বেঁধে দেয়। সমস্যাটা এখানেই।

সমস্যাটা নিতান্তই রাজনৈতিক। বাগপত সমবায় চিনিকলের কর্তা অনিল কুমার বলছিলেন, চাষি বেশি দাম চান। আবার মিলমালিকও লোকসান চান না। গোলমাল ওই বেঁধে দেওয়া দরে।

সামসাদ আহমেদ বললেন, পশ্চিম উত্তর প্রদেশের জমি খুব মিষ্টি। আখ দারুণ ফলে। পানি কম লাগে—খাটনিও। একবার আখ বুনলে দুই বছর ফলন নিশ্চিত। চাষিও জানেন, ফলন শেষে দাম না পাওয়ার আশঙ্কা নেই। ভোট পেতে রাজ্য সরকারও প্রতিবছর সংগ্রহমূল্য বাড়ায়। মিল মালিকদের লোকসান পোষানো হয় নানাভাবে। অর্থনীতির সমস্যা রাজনীতির রঙে চোবানো।

এবার নতুন এক সমস্যা ভুঁইফোড়ের মতো মাথাচাড়া দিয়েছে। ছেড়ে দেওয়া গবাদিপশু। সমস্যাটার জন্মদাতা বিজেপিই। ভারত জয় শুরু হওয়ার পর থেকেই বিজেপি গোমাতা রক্ষার নীতি গ্রহণ করে। রাজ্যে রাজ্যে নিষিদ্ধ হতে থাকে গো নিধন। একের পর এক কষাইখানা বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ হয় গো হাটে কেনাবেচা। গরু পাচার রুখতে তৈরি হয় বাহিনী। তাদের পিটুনিতে প্রাণ যাচ্ছে নিরীহ মানুষদের। নষ্ট হতে থাকে গরু–বাছুর বেচাকেনার স্বাভাবিক অর্থনৈতিক চক্র। বুড়ো গরু বেচে নতুন কেনার মধ্যে যে অর্থনৈতিক যুক্তি চাষি বা গৃহস্থের থাকে, হিন্দুত্বের বিকাশ ঘটানোর মধ্য দিয়ে তা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। উপায়ান্তর না থাকায় হাজারে হাজারে গরু–মহিষ–ষাঁড়ের ঠিকানা আজ রাস্তা। খেতের ফসল সামলানো দায় হয়ে পড়েছে চাষিদের। ধর্ম রক্ষা করতে গিয়ে অর্থনীতি চৌপাট। এমন সমস্যায় গোবলয়ের জনতা আগে পড়েনি।

অজিত সিং সমস্যার সমাধান করবেন বলছেন, কিন্তু কীভাবে তা অনুচ্চারিত থাকছে। কারণ, এলাকায় এলাকায় গোশালা খোলা বাজে অর্থনীতি হলেও হৃত অর্থনীতির স্বাভাবিক চক্র ফিরিয়ে আনার কথা বলা হবে হিন্দুত্বে আঘাত দিয়ে হারাকিরির শামিল। বিরোধীরা তাই সতর্ক। নির্ভয় পদক্ষেপ তাই জাতপাতের চেনা ছক। সবাইকে একজোট করে এগোনো।

সেখানেই এগিয়ে মহাজোট। অনগ্রসর সমাজবাদী, তপসিলভুক্ত দলিত বহুজন সমাজ ও মুসলমানদের সঙ্গে জাট বেরাদরির এমন মিলচাল মুজফফরনগর আগে দেখেনি। জাট ও মুসলমানকে এক ঘাটে জল খাওয়ানোর দায়িত্ব অজিত সিংয়ের। প্রার্থী না দিয়ে কংগ্রেসও জানিয়েছে তার সমর্থন। এই জোটবদ্ধতার বিপ্রতীপে একজনই পাহাড়ের মতো খাড়া। একজনই চ্যালেঞ্জার। অদ্বিতীয় নরেন্দ্র মোদি। অজিত সিংয়ের লড়াইও তাঁরই বিরুদ্ধে।