মক্কার অপব্যবহার করছে সৌদি আরব!
সৌদি আরবের ক্ষমতাসীন বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ মুসলমানদের পুণ্যভূমির অপব্যবহার করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার আইনের অধ্যাপক খালেদ এম আবু এল ফাদেল সম্প্রতি দ্য নিউইয়র্ক টাইমসে মতামতধর্মী এক লেখায় এই অভিযোগ তুলেছেন।
১২ নভেম্বর নিউইয়র্ক টাইমসের অনলাইন সংস্করণে লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে। লেখক বলছেন, সৌদি বাদশাহ সালমান পদাধিকারবলে মক্কার প্রধান মসজিদ মসজিদুল হারাম (হারাম শরিফ) ও মদিনার মসজিদে নববির রক্ষণাবেক্ষণকারী। নিখুঁতভাবে বললে, সৌদি বাদশাহ দুই পবিত্র স্থানের সেবক। রাজকীয় সর্বোচ্চ পদে আসীন বাদশাহরা নানা সময়ে মক্কার প্রধান মসজিদের ইমামকে দিয়ে সৌদি রাজতন্ত্রের গুণগান গাইয়েছেন এবং শাসকদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দিতে ব্যবহার করেছেন।
খালেদ এম আবু এল ফাদেল বলছেন, ভিন্নমতাবলম্বী সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে তুরস্কে সৌদি দূতাবাসে হত্যার ঘটনার পর সারা বিশ্ব সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের দিকে আঙুল তোলে। আগের নানা সময়ের মতো এবারও সৌদি রাজতন্ত্র যুবরাজের কর্মকাণ্ডের সাফাই গাইতে মক্কার প্রধান মসজিদের ইমামদের ব্যবহার করেছে। এবার এটি এমন অবস্থায় পৌঁছেছে, যা আগে কখনোই দেখা যায়নি। এতে মক্কা ও মদিনার নিয়ন্ত্রক ও রক্ষণাবেক্ষণকারী হিসেবে সৌদি বাদশাহর নৈতিক অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
গত ১৯ অক্টোবর শুক্রবার প্রধান মসজিদের ইমাম শেখ আবদুল রহমান আল-সুদাইস জুমার নামাজের সময় লিখিত খুতবা পাঠ করেন। এটি বিভিন্ন কেবল টিভি চ্যানেল ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। লাখ লাখ মুসলিম এই খুতবা শোনেন। তাতে ইমাম সুদাইস বলেন, প্রতি শতাব্দীতে নবী হজরত মুহাম্মদের (সা.)–এর মতো একজন মুজাদ্দিদকে আল্লাহ পৃথিবীতে পাঠান। প্রত্যেক মুজাদ্দিদকেই তাঁর সময়ের নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়।
সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের প্রশংসা করে ইমাম সুদাইস বলেন, মুসলমানদের কাছে বিন সালমান স্বর্গীয় উপহারের সমতুল্য। তিনি বলেন, সৌদি যুবরাজ আল্লাহ প্রেরিত একজন মুজাদ্দিদ। চলতি যুগে ইসলামি বিশ্বাসকে পুনরুজ্জীবিত করতেই যুবরাজ সালমানের আগমন। ইমাম বলেন, ‘এই পুণ্যভূমিতে সংস্কার এবং আধুনিকতার পথ...স্বর্গীয়ভাবে অনুপ্রাণিত, তরুণ, উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও সংস্কারক যুবরাজের যত্ন ও মনোযোগের মধ্য দিয়ে চালিত হবে। যত চাপ ও হুমকিই আসুক না কেন, তাঁর উদ্ভাবনী ও অন্তর্দৃষ্টিমূলক দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী এই কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।’
খালেদ এম আবু এল ফাদেল বলেছেন, খাসোগি হত্যার ঘটনার প্রসঙ্গ তুলে মুসলমানদের সতর্ক করে দিয়েছেন প্রধান মসজিদের ইমাম। তিনি বলেছেন, মহান মুসলিম নেতা বিন সালমানের বিরুদ্ধে কিছু গণমাধ্যম গুজব ছড়াচ্ছে। এসব গণমাধ্যমের অসৎ উদ্দেশ্য আছে। সৌদি যুবরাজের বিরুদ্ধে ‘ষড়যন্ত্র চলছে’ উল্লেখ করে ইমাম সুদাইস বলেন, এই ষড়যন্ত্র ইসলাম ও মুসলমানদের ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র। মুসলমানদের সতর্ক করে এই ইমাম বলেন, ‘তাঁর আধুনিক সংস্কারগুলোর বিরুদ্ধে থাকা সব হুমকি আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা, শান্তি ও স্থিতিশীলতাকে শঙ্কার মুখে ফেলতে পারে।’ পরে সৌদি যুবরাজকে রক্ষার জন্য আল্লাহর কাছে মোনাজাত করেন ইমাম সুদাইস এবং সব ষড়যন্ত্রের পেছনে ইসলামের শত্রুরা জড়িত বলে মন্তব্য করেন। সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে পরোক্ষভাবে খলিফা উমরের সঙ্গেও তুলনা করেন এই ইমাম।
ইমামের এমন বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতেই খালেদ এম আবু এল ফাদেল সমালোচনা করে বলেছেন যে সৌদি যুবরাজ নিজের পিঠ বাঁচাতে মক্কা ও মদিনাকে ব্যবহার করছেন। একে ‘অপব্যবহার’ বলে অভিহিত করেছেন খালেদ। তাঁর মতে, গ্র্যান্ড মসজিদের কোনো ইমাম এর আগে সৌদি শাসকদের ‘মুজাদ্দিদ’ হিসেবে অভিহিত করেননি।
খালেদ মনে করেন, দুই মসজিদেই এখন লিখিত খুতবা পাঠ করা হয় এবং এই খুতবা সৌদি নিরাপত্তা বাহিনী অনুমোদন করে থাকে। এই দুই মসজিদের ইমামকে নিয়োগ দেন সৌদি বাদশাহ।
সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে হত্যা নিয়ে বেকায়দায় পড়েছে সৌদি আরব। সবচেয়ে বেশি ঝামেলায় আছেন যুবরাজ বিন সালমান। পরিস্থিতি এতটাই বেগতিক যে বরাবরের মিত্র যুক্তরাষ্ট্রও এখন পিঠ দেখাচ্ছে! সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের নির্দেশেই সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে হত্যা করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছে মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ। খাসোগি হত্যাবিষয়ক তদন্তের উপসংহারে এ মন্তব্য করা হয়েছে। তুর্কি সরকারের কাছ থেকে পাওয়া রেকর্ডিংসহ অন্যান্য সাক্ষ্য–প্রমাণ ও মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যের ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো গেছে বলে জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।
তুরস্কের ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেট ভবনে গত ২ অক্টোবর ব্যক্তিগত কাগজপত্র আনার প্রয়োজনে ঢোকার পর থেকে নিখোঁজ ছিলেন সৌদির খ্যাতনামা সাংবাদিক খাসোগি। শুরু থেকে তুরস্ক দাবি করে আসছে, খাসোগিকে কনস্যুলেট ভবনের ভেতর সৌদি চরেরা হত্যা করেছে। গত বছর সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ক্ষমতা গ্রহণের পর রোষানলে পড়েন খাসোগি। ওয়াশিংটন পোস্টে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে একের পর এক কলাম লেখেন তিনি। পরে খাসোগি দেশ ছেড়ে স্বেচ্ছানির্বাসনে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান।
অভিযোগ উঠেছে, যুবরাজের নির্দেশে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এ হত্যা সংঘটিত হয়েছে। প্রথমে অস্বীকার করলেও পরে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে সৌদি আরব স্বীকার করে, খাসোগিকে কনস্যুলেট ভবনের ভেতরে হত্যা করা হয়েছে। তবে খাসোগিকে হত্যা করা হয়েছে স্বীকার করলেও এতে রাজপরিবার জড়িত নয় বলে দাবি করছে সৌদি আরব। এখন পর্যন্ত খাসোগির মৃতদেহের কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। সৌদি আরবও এ বিষয়ে কোনো তথ্য দেয়নি।
আরও পড়ুন